এই জনপদে ভয়াবহ মহামারী চলছে। একজন বাবা দাঁড়িয়ে আছেন। হাতে তাঁর শিশুপুত্রের লাশ। পৃথিবীর সবচেয়ে ভারী বস্তুটি কী নিদারুণ কষ্টে আদরে বুকে নিয়ে আছেন বাবা! সাদা কাফনবন্দী লাশের আলোকচিত্র, সাতটি চৈত্রস্নাত নতমুখি মুখ, ঘাসজড়ানো অদ্ভুত মায়াবী মাটির আলোকচিত্রটি লক্ষ্য করুন। চট্টগ্রামের পটিয়ার ঘটনা। এই ছবিটির ত্রিভুজ যোগাযোগ আমাকে বারবার ছবিটা পাঠ করতে আগ্রহী করে। বাবার প্রতিকৃতিটি যেন অপেক্ষা করছে; তাঁর অভিঘাত আমাদের মতো দর্শক-শ্রোতার দিকে। শ্বেতশুভ্র পিপিই গায়ে ব্যক্তিরা নিজেকে বাঁচাতে চায় আসন্ন মৃত্যুভাইরাস থেকে। সবুজ জমিন এখানে বিষাদের প্রতীক। আলোকচিত্রটি চিহ্নবিদ্যা অনুযায়ী ভাবার অবকাশ এনে দেয়। আলোকচিত্রটি বর্তমান বাংলাদেশের রূপকে একটি চিহ্নে প্রকাশ করে।
চট্টগ্রামে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে এক প্রতিবন্ধী শিশুর (৬) মৃত্যু হয়েছে। জানা যায়, ’সোমবার ভোরে হাসপাতালের আইসোলেশন ইউনিটে তার মৃত্যু হয়। এ নিয়ে চট্টগ্রামে নভেল করোনাভাইরাসে দুজনের মৃত্যু হলো। (সূত্র: চট্টগ্রামে করোনায় প্রাণ গেল ৬ বছরের শিশুর, যুগান্তর, ১৩ এপ্রিল ২০২০) খবরে প্রকাশ, চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. অসীম কুমার নাথ এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, পটিয়ার হাইদগাঁও থেকে আনা শিশুটি জ্বর, সর্দি, কাশি ও ডায়রিয়ায় ভুগছিল। রোববার গভীর রাতে নভেল করোনাভাইরাস শনাক্তের পর শিশুটিকে জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ভোরে সেখানেই শিশুটির মৃত্যু হয়। পটিয়ায় ওই শিশুর দাফনের ব্যবস্থা করেছে স্থানীয় প্রশাসন।
হায়রে মানুষ, আর কত অহংকার তোমার? আজ আমাদের করোনাক্রান্তিতে কোন তলস্তয় নেই, থাকলে লিখতেন, ‘কতটুকু জমি দরকার?’। আসলেই কতটুকু জমি দরকার আমাদের? খোদা উত্তর দিবেন, এই নাও, সাড়ে তিন হাত; দাফন করো তোমার সভ্যতাকে। প্রিয় পাঠক, আমাদের হয়তো শেষ দেখা হয়ে গেছে? আমরা মারা যাবো লাখে লাখে? হ্যাঁ, আমাদের শেষ দেখা হয়ে গিয়েছে। আমরা হয়তো মারা যাবো। সবাই। গণমৃত্যুতে। লাখে লাখে। জীবন-মরণ সীমানা ছাড়িয়ে আমরা দাঁড়িয়ে আছি এক ভয়াবহ সংকটের মুখে। দুঃখ শুধু একটাই, আমি বা আমরা জন্মেছিলাম ভুল সময়ে। করোনায় বেঁচে গেলেও করোনার পর আদৌ স্বাভাবিক হবো কি আমরা? হয়তো তখন বলবো, দেখে যা নিখিলেশ, কিভাবে মরার মত বেঁচে আছি!
সমাজবিজ্ঞান তথা যোগাযোগবিদ্যার ছাত্র হিসেবে আমরা এই পরিস্থিতিকে দেখতে পারি, আধুনিক সভ্যতার উন্মেষের পর পুঁজিবাদী ব্যবস্থার দীর্ঘস্থায়ী সংকট। করোনা রুখতে গিয়ে আমরা অসহায় হয়ে দেখছি এক অদৃশ্য জীবাণু কিভাবে এই সুদৃশ্য পৃথিবীকে অচল করে দিলো! কিন্তু প্রশ্ন হলো, পৃথিবী কি আসলেই সুদৃশ্য ছিলো? না। ক্যাপিটালিজম এই পৃথিবীতে যে গতি এনেছিলো, আজ সে নিজের কবর খুঁড়ছে। বহুল আলোচিত ‘ডিজাস্টার ক্যাপিটালিজম’র মৃত্যু ঘনিয়ে আসছে। দুর্যোগ-পুঁজিবাদের পর এক নতুন পৃথিবী গড়ে ওঠার সম্ভাবনার কথা বলছেন অনেকেই। করোনা আমার কাছে একটি ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ রোগই নয় কেবল; বরং সে সার্বজনীন, বিজ্ঞানভিত্তিক, একমুখী, শ্রেণীবৈষম্যহীন, যুক্তিবাদী এবং সাম্যবাদী রোগ। এটি একটি জাত, পাত, আশরাফ, আতরাফ ভেদাভেদহীন এমন রোগ যা ‘সকলের জন্য ভাইরাস’ নিশ্চিত করতে পৃথিবীর দেশে দেশে অবিরাম শ্রেণীসংগ্রাম করে চলছে। কোথাও তার বিপ্লব ব্যর্থ হচ্ছে, কোথাও বিপ্লব সফল হচ্ছে। সারা পৃথিবী আজ তাই নতুন বিপ্লবী পার্টির (করোনার প্রতিষেধক) খোঁজ করতে বাধ্য!
এই ছবিতে বিষাদের যে প্রকাশ, তা আমাদের নতুন বছরের সূচনাকে হতাশায় ডুবিয়ে দেয়। সংবেদনশীল মানুষের তীব্র মানসিক প্রতিক্রিয়ায় নতুন বছরটি ভয়াবহতার ইঙ্গিত দেয়। দেশের চলমান করোনা পরিস্থিতি বিবেচনায় এমন ছবি আমাদেরকে ভয় আর আতঙ্কের জনপদের কথাই বারবার মনে করিয়ে দেয়। ছবিতে সবুজ জমিন, বাঁকা হয়ে থাকা শিশুর লাশ ও বাবার মধ্যে আপতিক সম্পর্কটি দেখা যেতে পারে। এখানে শিশু ও বাবার পারষ্পরিক সম্পর্ক আমাদের কেন্দ্রিয় পাঠ। হয়তো এই আপাত শান্ত-স্নিগ্ধ নিরীহ ছবিটির মধ্যে কোন আবেদন খুজে পাবেন না অনেকেই। কিন্তু বাস্তবের সাথে অনেক মিল খুঁজে পাওয়া যাবে এই আলোকচিত্রের চিহ্নবিদ্যার ব্যাখ্যায়। সম্পর্কটি চিহ্নবিদ্যার কারণে তৈরি করা একটি আপতিক সম্পর্ক। তাই শিশুর লাশের ছবির (বস্তু) সাথে বাবার ইমেজের (চিহ্নবাহক) সম্পর্ককে আমরা দেখতে পারি ভগ্নরেখা দিয়ে। অন্যদিকে, যারা প্রতিরোধী পোশাক গায়ে দণ্ডায়মান তার সাথে সম্পর্ক হবে সরাসরি, তাই এই দুটি সম্পর্ককে দেখানো হবে অভগ্নরেখা দিয়ে। শিশুর ছবি এখানে ‘বস্তু’। একটি অপাপবিদ্ধ মৃত কিশোরের কাফন, কাফনটি যেন বা এজলাসে বসা বিচারক, যে আমাদের সকলকে অপরাধী সাবস্ত্য করছে! আর লুঙ্গি পরা মুখে মাস্ক পরা বাবাটি এখানে ‘চিহ্নধারক’। আর, শ্বেতশুভ্র পোশাক পরা নিরাপদে থাকতে চাওয়ার আকুতি যেন বাংলাদেশের ভয়ের সংস্কৃতির মধ্যে জড়সড় হয়ে টিকে থাকা নাগরিকবৃন্দ! যা দেখামাত্রই পাঠক-দর্শকের কাছে যে ভাবটির উদয় হতে পারে তা হলো চিহ্নবাহক। সামগ্রিকভাবে এই ছবির ত্রিভুজ পাঠ আমাকে বাংলাদেশে ভয়ের সংস্কৃতির ঐতিহাসিক উপস্থিতিকেই সিগনিফাই করছে।
ভয়ের সংস্কৃতির প্রাবল্য ও আধিপত্য বোঝার জন্য আজকের বাংলাদেশের বুকে এই ছবিটি একটি ‘উত্তম নমুনা’। কিশোর আমাদের সময়ের অভিমন্যু। যে করোনার ক্ষমতা-চক্রবুহ্যের মধ্যে নিষ্ঠুর আক্রমণের শিকার। হ্যাঁ, মহাভারতের অভিমন্যু! মহারথীদের সম্মিলিত অন্যায় আক্রমণে যার মৃত্যু হয়েছিল। অভিমন্যু মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও কৌরবদের চক্রব্যুহ ভেদ করার সংকল্প করেছিলেন। ঠিক যেভাবে এই দেবশিশু করোনার ক্ষমতাচক্রব্যুহের নিশ্চিত পরিণতি জেনেও পিতার হাতে লাশ হয়ে আছে। এই আলোকচিত্র করোনাক্রান্ত বাংলাদেশের নিদারুণ বিষাদময়তার অবয়ব দান করেছে।
হে মানুষ, ইস্রাফিলের শিঙ্গাধ্বনি শুনতে পাচ্ছো? কত নিষ্ঠুর হলে পরে তুমি মানুষ তোমাকে এই ছবি দেখতে হচ্ছে? ওই দেখো পিতার হাতে নিথর সন্তান! ওই দেখো, শ্বেতশুভ্র দেবদূতেরা দাঁড়িয়ে আছে আরেক দেবশিশুকে গন্তব্যে পৌঁছাতে! আজ থেকে প্রতিদিন জান্নাতের দরজা ধরে বাপের জন্য অপেক্ষা করবে এই পাখিটি! কিংবা আমরা পাঠ করতে পারি, মহাভারতকেও। বীর অভিমন্যুর শব কাঁধে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের মহাশ্মশানে হতবাক দাঁড়িয়ে আছে বাবা অর্জুন! পাশে দাঁড়িয়ে আছে ছয় মহারথী ভীষ্ম, কর্ণ, জয়দ্রথ, বিদুর, শল্য। যারা এই করোনা(কুরু)ক্ষেত্রের নির্বিকার দর্শক! এটাই আমাদের নববর্ষের বিষাদময়তা। নববর্ষ শুরু হলো যে ব্যাথা, আতঙ্ক, দুঃখ আর ভয় নিয়ে; সেটি কাটিয়ে উঠতে পারবো তো? সবাই মিলে পারবো কি প্রিয়জনদের সাথে পুনরায় মিলিত হতে? ক্ষুদ্র সে আশা নিয়ে বেদনার বালুচরে বেঁচে থাকি! বিষাদময় নববর্ষে কবিগুরুকে স্মরণ করি, ‘সকাতরে ওই কাঁদিছে সকলে, শোনো শোনো পিতা।/ কহো কানে কানে, শুনাও প্রাণে প্রাণে মঙ্গলবারতা।।/ ক্ষুদ্র আশা নিয়ে রয়েছে বাঁচিয়ে, সদাই ভাবনা।/ যা-কিছু পায় হারায়ে যায়, না মানে সান্ত্বনা।’
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)