এই লেখার শিরোনামে একটি বিখ্যাত সিনেমার নাম লুকিয়ে আছে। তবে কায়দা করে একটি বাড়তি চন্দ্রবিন্দু যুক্ত করা হয়েছে। কেন হয়েছে? তার উত্তর মিলবে এই লেখার শেষে। ‘মা, তুমি এই বনে এক রাত থাকো। কাল এসে তোমাকে নিয়ে যাব’—এ কথা বলে ৫০ বছর বয়সী মাকে শাল-গজারির বনে ফেলে যান তার সন্তানেরা। তিনি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত সন্দেহে সন্তানেরা এমনটা করেন। পরে দিবাগত রাত দেড়টার দিকে উপজেলা প্রশাসন তাকে বন থেকে উদ্ধার করে ঢাকায় পাঠায়। (সূত্র: প্রথম আলো, ১৪ এপ্রিল ২০২০)
পুরো পরিবারকে আঁকড়ে ধরে ছিলো সেই মা। বয়স হয়ে গেছে, তবুও সন্তানদের যত্ন নিতেন। তার এক ছেলে, দুই মেয়ে ও জামাতারা গাজীপুরের সালনায় একটি পোশাক কারখানায় চাকরি করেন। সবাই মিলে সালনায় একটি ভাড়া বাসায় থাকেন। বাড়িটি নিশ্চই কোন কয়েক ঘরওয়ালা ফ্লাটবাসা ছিলো না, জনমানবপূর্ণ এলাকায় থাকতেন। ওই সব এলাকায় থাকাটা বেশ কষ্টকর, পানি নিতে হয় দূর থেকে, বিদ্যুৎ থাকে না, গ্যাস থাকে একবেলা। এরমধ্যেও তাদের মমতাময়ী মা তারা কাজে যাওয়ার পর ঘরের সকল কাজ নিজ হাতেই করতেন। বয়স হয়ে গিয়েছে কিন্তু তাতে কি ছেলে মেয়েদের কথা চিন্তা করে একাই সব করতেন যাতে করে খরচ কম হয়, কাজের মানুষ নিয়ে বাড়তি খরচ না বাড়ে। সেই মা তাদের রান্না করে খাওয়াতেন আদর যত্ন করে। সংসারকে আগলে রাখতেন নিজ হাতে।
আমাদের সমাজে মায়েরা সারাটিজীবন আত্মত্যাগের মধ্যেই জীবন কাটায়। যে মা দুই বা একাধিক সন্তানকে আগলে রাখে, সেই মা মৃত্যুশয্যায় সন্তানদের একতাবদ্ধ দেখে যেতে পারেন না। তবুও বাঙালি নারীর মনে মাতৃত্বের এক ধরনের গৌরবের শ্লাঘা বসবাস করে। এই করোনাক্রান্তিতে ঋত্বিক ঘটকের ‘মেঘে ঢাকা তারা’ সিনেমার কথা মনে পড়ে যায়। মেঘে ঢাকা তারা সিনেমাটিই ঋত্বিকের সম্ভবত পপুলার মেলোড্রামা ধাঁচের সবচেয়ে জনপ্রিয় সিনেমা। একরৈখিক গল্পে একটানে বলে গেছেন পুরো একটি সংসারে নারীর ত্যাগ-এর গল্প। আমাদের আজকের বাংলাদেশে গাজীপুর জঙ্গলে ফেলে আসা নারী জননী যেন সিনেমার চরিত্র নীতা! মরণঘাতি যক্ষ্মা আক্রান্তের কারণে পাহাড়ের ওপর হাসপাতালে ফেলে রেখে আসা হয়েছে যাকে। যে নারীর জীবন-মৃত্যুর দোলাচলে এরকমই অন্ধকার নেমে আসে। সিনেমার শেষে ভাই শংকরকে নীতা বলে উঠে, সে বাঁচতে চায়। অ্যাম্বুলেন্স থেকে এরকম কোন গোঙানি এসেছিলো কি? হ্যাঁ! এসেছিলো। প্রথম আলোর অনলাইন সংবাদে জানা যায়, উপজেলার গজারিয়া ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) ২ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘গতকাল সোমবার রাত আটটার দিকে বনের ভেতর থেকে এক নারীর কান্নার শব্দ শুনে স্থানীয়রা আমাকে খবর দেয়। পরে স্থানীয় চেয়ারম্যানসহ এলাকার লোকজন ওই নারীর কাছে যান। ওই নারী তার ছেলেমেয়েরা কীভাবে তাঁকে জঙ্গলে ফেলে গেছেন, সেই কাহিনি বলেন। আমাদের সমাজে নারীর এই অবস্থান নতুন কিছু নয়। করোনা এসে নারীত্ব, সংসার, মাতৃত্ব এসব ধারণাকে নতুনভাবে চেনালো আমাদের।
লকডাউন পরিস্থিতির পুরুষালি ভার্চুয়াল প্রেজেন্টেশন চলছে। আমাদের প্রচলিত সংসারবোধকে ‘পুরুষালি আর্তি’ হিসেবে তুলে ধরছে কেউ কেউ। ফেসবুকে পুরুষরা বিভিন্ন ভিডিওতে নিজেদের তুলে ধরছেন নারীর কাছে অসহায়, সংসারের নাগপাশে বন্দী, পরিবারের প্রতি বিরক্ত ইত্যাদি রূপে। বাঙালির প্রচলিত সংসার ব্যবস্থাপনায় এইরকম ভাবনা হয়তো স্বাভাবিক। তবে গণহারে সংসারের এইরকম উপস্থাপন লাগসই হলেও ঠিক যুতসই নয়। কারণ, এসব কৌতুকগুলির মধ্যে নারীদের প্রতি প্রচ্ছন্ন অপমান প্রকাশ পায়।
কোয়ারেন্টাইনে পুরুষেরা যথেষ্ট অবকাশ পেলেও অধিকাংশ পরিবারেই নারীদের ঘরের কাজ সামলাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। কারণ গৃহের অধিকাংশ সদস্যই বাড়িতে বসে তিন/চার বেলা খাচ্ছেন, যার ব্যবস্থাপনা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নারীকে করতে হচ্ছে যা মূলতঃ অনেক কষ্টকর। এই কষ্টটা অনুধাবন করার বোধ খুব কম মানুষেরই হয়। ‘গৃহস্থালি কাজে’ যে নারী-পুরুষ ভেদ নেই, অনেক জ্ঞানী-গুনীরা এটি ভাবতে অস্বস্তি বোধ করেন। আবার আমাদের সমাজটা এমন যে, কোন পুরুষ তার ঘরণী বা নারীকে কাজে সহযোগিতা করতে গেলেও পুরুষদের নিজেদের পরিসরে ‘মেয়েলি’ বলে তাচ্ছিল্য পায়। তাই, এই সময়টা ভীষণ গোলমেলে! অরণ্যপ্রকৃতির নিবিড় সান্নিধ্য দূরে ঠেলে যে পুরুষ আজ হঠাৎ স্বেচ্ছ্বাবন্দী হয়েছে তার তো কিছুটা অস্থির লাগারই কথা। যে মানুষ পূর্বেই অরণ্যচারী এবং কৃষিকাজের জন্য বেরুতো, সে কি এভাবে ঘরবন্দী থাকার? কিন্তু করোনা গ্রাফের এই অতিদ্রুত ক্রম-ঊর্ধ্বমুখী রেখার বৃদ্ধিকে একটু চ্যাপ্টা করে দিয়ে পৃথিবীকে সুস্থ করে তোলার জন্য আর কটা দিন সহাবস্থান যে ভীষণ দরকার! এজন্যই দরকার ঘরে ঘরে নারী-পুরুষের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান।
সরবিন্দু কর্মকার কবিতায় বলেছেন, ‘মানুষ কেন বলে মেয়েদের…/ নারীর নিজস্ব নেই কিছু।/ আমি তো দেখি জগৎ চলে…/নারীর পিছু পিছু’। বিশ্বের অনেক দেশেই এখন খারাপ অবস্থা সকলেই প্রায় ঘরবন্দী। কোভিড-১৯ এর ভয়ে কেউ বাইরে বের হতে পারছে না। ঘরে যে ব্যক্তিটি সবসময়ই বন্দি তাদের অনুভূতিটা এখন প্রায় সবাই বুঝতে পারছে। যে ঘরে থেকে সকলের জন্য সারাদিন কাজ করে তার কষ্ট কতটা। নারীদের কোন ছুটি নেই কোন, অবসর নেই। অনেক সময় মনে হয় তাদের ক্লান্তিবোধও নেই। কিন্তু তাই কি? আছে অবশ্যই, তবে সে পারে না আর সকলের মতো ক্লান্ত হয়ে বসে থাকতে।
এই লকডাউন অবস্থায় সবাই এখন বাড়িতে বসে আরাম করে সময় পার করছে। কারো কাজ নেই, শুয়ে বসে, ফেসবুকিং করে, অনলাইনে পরে থেকে সময় কাটাচ্ছে। কিন্তু এই সময়ও নারীরা তাদের কাজ করেই যাচ্ছে। আগের চেয়ে বরং কাজটা একটু বেশিই। কারণ বাইরে থেকে কেউ ঘরে আসতে পারছে না অর্থাৎ গৃহকর্মীরা আসছে না আর ঘরে মানুষ সবসময় থাকলে কাজটা একটু বেশি হয়। ঘরদোর ময়লা বেশি হয়, রান্না বান্না বেশি করতে হয়। নারীরা হাত গুটিয়ে বসে থাকতে পারে না। এইদিকে ঘরে বন্দী থাকা অবস্থায় কারো কারো বেশি বেশি খেতে ইচ্ছে করে, রেস্তোরাগুলো বন্ধ থাকায় সেখানকার খাবারের স্বাদও নিতে চায় অনেকে। এতে করে তাদের তৃপ্তি মেটাতে কষ্ট করতে হয় সেই নারীদেরই। পরিবারের সকলের খেয়াল রাখাটা এখন তাদের বড় কাজ।
বলতে গেলে এ সময় সকলের উপর চাপ কম গেলেও নারীদের উপর চাপ বেশি পড়ছে। অনেক পুরুষেরা তাদের ঘরের নারীদের সাহায্য করছে। কিন্তু নারীরা আপনজনের কষ্ট দেখতে পারে না তাই তারা যথাসম্ভব চেষ্টা করে নিজে নিজেই সব করার। তাদের কষ্ট হয়, অনেক হয় কিন্তু তারা তা প্রকাশ করে না। হাসির আড়ালে সব কষ্ট লুকিয়ে রাখে। ঘরে থেকে থেকে অনেক পুরুষের মন মানসিকতা খারাপ হচ্ছে। তারা তাদের ক্ষোভ নারীদের উপরই ঝাড়ছে। নারীদের এই চাপও আজ কাল নিতে হচ্ছে। মোটকথা শারীরিক ও মানসিক দুই চাপ সামলাতে হচ্ছে। এ সবকিছুই ঘটছে মধ্যবিত্ত ঘরে। এদিকে যারা নিম্নবর্গের, দিন আনে দিন খায় তাদের ঘরের নারীদের চাপ তো বলার মতো নয়। তাদের চিন্তা করতে হচ্ছে সবাইকে খাওয়াবে কি, খাবে কি, দিন পার করবে কীভাবে এসব। এর মধ্যে পুরুষেরা বেকার দিন পার করে শারীরিক নির্যাতন চালাচ্ছে নারীদের উপর। তারা দেখছে না নারীদের অবস্থাটা। নারীরা তাদের সুখ খুঁজে পায় পরিবারের মধ্য দিয়েই। এত চাপের মাঝেও তাদের মন বদলায় না। এজন্য সমরেশ মজুমদার বলেছেন, ‘মেয়েরা গনেশের মতো, মা দুর্গার চারপাশে পাক দিয়ে যে জগত দেখে তাতেই তৃপ্তি।’
মেঘে ঢাকা তারা সিনেমার শেষে নীতা যখন শঙ্করকে জড়িয়ে ধরে বলে, ‘দাদা, আমি বাঁচতে চাই দাদা।’ সেভাবে হয়তো সিনেমাটিক কায়দায় গাজীপুরের আকাশ, জঙ্গলের গায়ে প্রতিধ্বনি হয়নি আকুতি। তবে প্রবল বেঁচে থাকার তাড়না সেই ঘনরাতের জঙ্গলে কিছুটা হলেও আবেদন তৈরি করেছিলো। এই সিনেমায় ‘আমি বাঁচতে চাই’-টিই বিশ্ব চলচ্চিত্রের ইতিহাসে অমর সংলাপ। সংসারের কালো মেঘে ঢাকা তারা ‘নীতা’ আমাদেরকে বলেছিলো আমরা ‘কেমন ছিলাম’? গাজীপুরের এই মা বহুবছর পর ঋত্বিকের সিনেমা বা শক্তিপদ রাজগুরুর উপন্যাসকে প্রতিধ্বনিত করলো- এই করোনাক্রান্তিতে ‘আমরা কেমন আছি’? যারা সংসারকে এই করোনাক্রান্তির মধ্যেও আগলে রেখেছেন, যাদের শ্রমের কোন বেতন হয় না, উনারা ‘মেঘে ঢাকা তারা’ নয় শুধু, তারা বরং এই করোনাক্রান্তির ঘনকালো আকাশের ‘মেঘে ঢাকা তাঁরা’!
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)