আমাদের দেশে জুন-জুলাই সময়টা পরিণত হয়েছে ‘বেশি কথা বলা’র মৌসুমে। এ মৌসুমে কেন জানি সবাই বেশি বেশি বকবক করে। এর মূল কারণ সম্ভবত নতুন অর্থবছরের জাতীয় বাজেট ঘোষণা। রীতি অনুযায়ী আমাদের দেশে জুন মাসেই জাতীয় বাজেট ঘোষণা করা হয়। আর বাজেট মানেই হচ্ছে কথার ফুলঝুরি। আয়-ব্যয়ের হিসেব মেলাতে নানারকম গোঁজামিল, ভালো ভালো বাক্য দিয়ে বাজেটকে ইতিবাচকভাবে উপস্থাপনের চেষ্টা। সরকারি দলের নেতা-কর্মী-স্তাবকরা না বুঝেই বাজেটের পক্ষে দিস্তার পর দিস্তা বাক্য রচনা করে যান। এটা যে অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের শ্রেষ্ঠ বাজেট তা প্রমাণ করতে আদাজল খেয়ে লাগেন।
পক্ষান্তরে বিরোধী দল বাজেট উপস্থাপন করা মাত্রই ‘গণবিরোধী বাজেট’ প্রত্যাখ্যান করেন। এজন্য তাদের কোনো রকম অর্থনৈতিক জ্ঞান এবং জানা-বোঝার দরকার হয় না। বিরোধী দলের কাছে বাজেট মানেই হচ্ছে ‘দিক নির্দেশনাহীন, গরিব মারার লুটপাটের বাজেট’। কীভাবে? তা তারা জানেন না। জানার দরকারও হয় না। ইতিমধ্যে এবারের বাজেটকে ‘ভোট আকর্ষণের বাজেট’, ‘নীল রঙের বেলুন’, ‘ভোটের আগে জনতুষ্টির বাজেট’ বলে অভিহিত করা হয়েছে। বাজেট নিয়ে আমাদের দেশের অর্থনীতিবিদ ও রাজনীতিবিদরা যে বক্তৃতা দেন, তাতে নতুনত্ব কিছুই থাকে না। সরকারি দলের নেতা ও তাত্ত্বিকরা বাহবা দেন। বিরোধী দলের নেতা-তাত্ত্বিকরা সমালোচনা করেন। সংসদেও এ রকম আলোচনা হয়, যার থেকে উন্নত মানের কোনো কিছু পাওয়া যায় না। সবই একঘেয়ে, বিরক্তিকর। এমনকি প্রতিবছরের বাজেট আলোচনা একত্রে সংগ্রহ করলেও দেখা যাবে প্রতিবারই একই ধরনের আলোচনা ও বক্তৃতা হয়েছে সংসদের ভেতরে ও বাইরে। এ সময় পেশাগতভাবে ও ডিগ্রিধারী অর্থনীতিবিদদের কদর একটু বেড়ে যায়। সাধারণত তারা জটিল অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ ও সেই ধরনের শব্দ প্রয়োগ করে নিজেদের পাণ্ডিত্য প্রমাণে সচেষ্ট হন।
অন্যান্য বছরের মতো যথারীতি এ বছরও আগামী কিছু দিন বাজেট নিয়ে পণ্ডিতি আলোচনার ধুম পড়ে যাবে বলে আশা করা যায়। রেডিও-টেলিভিশন, অনলাইন-অফলাইন সবখানে চলবে কেবল বাজেটের কচকচানি। আমাদের দেশে রীতিই হয়েছে, প্রতিবছর জুনের প্রথম সপ্তাহে অর্থমন্ত্রী বাজেট ঘোষণা করবেন, আর পরক্ষণেই বিরোধী রাজনৈতিক দল, বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)-সহ বিভিন্ন দল ও সংগঠন সমালোচনা শুরু করে দেয়। তবে এই সমালোচনার ভাষা বরাবরই গতানুগতিক, যেমন-‘বাস্তবসম্মত নয়’, ‘গরিব মারার বাজেট’ ‘ঋণ করে ঘি খাওয়া’, ‘সরু রাস্তায় দ্রুত গতিতে গাড়ি চালানো’, ‘উচ্চাভিলাষী বাজেট’ ইত্যাদি। এগুলো তবু বোঝা যায়, কিন্তু কিছু কিছু পণ্ডিত ব্যক্তি এমনভাবে বাজেট ব্যাখ্যা করেন, তাতে বোঝা যায় না, তিনি আসলেই কী বলতে চাইছেন বা বোঝাতে চাইছেন! যেমন কেউ কেউ বলেন, এবারের বাজেট ‘রক্ষণশীল’! এর মানে কী? বাজেট আবার রক্ষণশীল হয় কীভাবে? বাজেট কি পর্দা করে?
সম্ভবত সৈয়দ মুজতবা আলী লিখেছিলেন, ‘তোমার লেখাকে যদি সর্বত্রগামী করতে চাও, হালকা হয়ে লেখ, পণ্ডিতি ফলিও না।’ কিন্তু মহামহিম মুজতবা আলীর কথা তেমন কেউ শুনেছে বলে মনে হয় না। আমরা অবশ্য জ্ঞানী-গুণীর কথা খুব একটা শুনিও না মানিও না। তাই তো জাতীয় বাজেট ঘোষণার পর বাজেট নিয়ে পণ্ডিতি আলোচনার ব্যাপক ‘প্রবৃদ্ধি’ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। তবে আমরা এ বিষয়ে কোনো পণ্ডিতি আলোচনায় যাব না! আমরা বরং বাজেট-আলোচনার নামে দেশজুড়ে যে একঘেয়ে কচকচানি চলছে তার থেকে রেহাই পেতে পণ্ডিতদের কিছুটা হালকা আলোচনা সেরে নিতে পারি।
‘পণ্ডিত’শব্দটি সংস্কৃত হলেও ইংরেজি ভাষার সূত্রে এখন সারা পৃথিবীর শিক্ষিত সমাজে সুপরিচিত। ইংরেজি অভিধানে বহুকাল হলো শব্দটি ঢুকে গেছে। আধুনিক বাংলাভাষায় ‘পণ্ডিত’ শব্দটি অবশ্য বহুক্ষেত্রেই বিদ্রূপার্থে ব্যবহূত হয়। আগেও যে হতো না তা নয় ; টুলো পণ্ডিত বা বুনো পণ্ডিত এ জাতীয় বিশেষণযুক্ত কথা স্পষ্টই বুঝিয়ে দেয় যে পণ্ডিত শব্দটি কিছুটা হেয়ভাবে ব্যবহারের রীতি অতীতেও ছিল।
যে যুগে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর পণ্ডিত উপাধিতে ভাস্বর ছিলেন কিংবা তারপরে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী অথবা অমূল্য চরণ বিদ্যাভূষণ পণ্ডিত বলে সম্মানিত হতেন, সেই যুগেই ‘কানা-কানা খানা-খানা কেমন লাগে কুমির ছানা’ গল্পের শেয়াল পণ্ডিত ঘরে ঘরে জনপ্রিয় ছিল।
এই সময়েই এক স্বনামধন্য পণ্ডিত, খুব সম্ভব অমূল্য চরণ বিদ্যাভূষণ মহোদয় পণ্ডিতের এক নতুন সংজ্ঞা দিয়েছিলেন। কয়েক ব্যক্তি তার কাছে এসেছিলেন তাকে এক অনুষ্ঠানে নিয়ে যাওয়ার জন্য। যাতে তিনি সেই অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করতে রাজি হন, সেজন্য তারা বিদ্যাভূষণ মহাশয়কে পণ্ডিত-মহাপণ্ডিত ইত্যাদি নানারকম বিশেষণে তোয়াজ ও তোষামোদ করতে লাগলেন।
বিদ্যাভূষণ মহোদয় পণ্ডিত হলেও বুদ্ধিমান ব্যক্তি ছিলেন। তিনি এসব শুনে বললেন: হ্যাঁ, আপনারা ঠিকই বলেছেন, আমি অবশ্যই পণ্ডিত, তবে আমি হলাম সেই ধরনের পণ্ডিত- সর্ব কর্মং প্লয়তি য সঃ, অর্থাৎ সব কাজ পণ্ড করে দেয় যে। এভাবে তিনি এই অনুষ্ঠানের উদ্যোক্তাদের বিদায় করে দিয়েছিলেন।পণ্ডিতদের সম্পর্কে অধিকাংশ চলতি গল্পই তাদের বোকামি নিয়ে। বেশি লেখাপড়া জানা লোকের বৈষয়িক বা জাগতিক বুদ্ধির অভাব থাকে-এ রকম একটা ধারণা বহুদিন ধরেই চালু আছে।
পুরনো দিনের লোককথায় পণ্ডিত কাহিনীর অন্ত নেই। তখনকার সমাজ জীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ পণ্ডিত মশায়। তিনি শিক্ষক, তিনিই পুরোহিত, কখনো গুরুদেব, তিনিই বিধায়ক, এমনকি কখনো কখনো তিনি জীবনদাতা কবিরাজ বা চিকিত্সক। এক সময় মূর্খের বিপরীত শব্দ হিসেবেই পণ্ডিত শব্দটি ব্যবহৃত হতো। তবে এখন যুগ পাল্টেছে। পণ্ডিত শব্দটিও এখন আর আগের ঔজ্জ্বল্য ধারণ করে না। এখন পণ্ডিত শব্দটির নেতিবাচক ব্যবহারই বেশি। এর অবশ্য কারণও আছে।
এখন আর পণ্ডিতদের সঙ্গে সমাজের আর দশটা সুবিধাবাদীর খুব একটা পার্থক্য নেই। সমাজে জ্ঞানী-গুণী-পণ্ডিত হিসেবে যারা স্বীকৃত, তারা এখন চাতুর্যে, বিষয়-বুদ্ধিতে আর সুবিধাবাদিতায় অন্য সবাইকে ছাড়িয়ে গেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কথাই ধরা যাক। জ্ঞানে-গুণে-পাণ্ডিত্যে তাদেরই সমাজে শ্রেষ্ঠ হিসেবে স্বীকৃতি আছে। অথচ গোষ্ঠীগতভাবে তারা এখনো চরম সুবিধাবাদী ও বিষয়বুদ্ধিসম্পন্ন বলেই প্রতীয়মান হয়।
পণ্ডিতেরা স্বার্থপর হোক, চতুর কিংবা ধূর্ত হোক, সামান্য একটু পদ, পদবি ও সুযোগ-সুবিধার জন্য তারা নিজের সম্মান-মর্যাদা-সম্ভ্রম বিসর্জন দিক, তা নিয়ে দেশবাসী খুব একটা মাথা ঘামায় না; এই ঘোর অবক্ষয়ের কালে দেশে সবকিছুই সম্ভব।
পণ্ডিতরা মূর্খ হতেই পারেন, ধান্দাবাজ, চতুর, স্বার্থপর হতে পারেন। কিন্তু সমস্যা হলো, ইদানীং ক্ষমতাশালী ব্যক্তিমাত্রই পণ্ডিত হয়ে উঠছেন এবং তারা ইচ্ছেমতো সবখানে ‘পণ্ডিতি’ ফলাচ্ছেন। অনেক ক্ষমতাশালী ‘পণ্ডিত’ তো প্রধানমন্ত্রীর চাইতে নিজেকে অধিক গুরুত্বপূর্ণ ভাবছেন!
তবে পণ্ডিতরা যেমনই হোন কেন, পণ্ডিতবুদ্ধির কিন্তু দরকার আছে। পণ্ডিতবুদ্ধি ছাড়া জগত অচল।
সবশেষে বাজেটে করারোপ প্রসঙ্গে একটি পণ্ডিতি পরামর্শ। এবারের প্রস্তাবিত বাজেটে অনেক কিছুর উপরই করারোপ করা হয়েছে। উবার-পাঠাও, অনলাইন শপিং ইত্যাদির উপর ৫% ভ্যাট বসানো হয়েছে। কিন্তু সিম বা রিম কার্ডের মাধ্যমে সেবার উপর নতুন করে সম্পূরক শুল্ক আরোপ করা হয়নি। আমরা জাতীয় স্বার্থে বাজেটে মোবাইল ফোনের প্রদত্ত সেবার উপর অন্তত ৫ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক আরোপের প্রস্তাব করছি। এতে সরকারের আয় যেমন বাড়বে, পাশাপাশি ‘কথানির্ভর’ জাতির কথার উপর ট্যাক্স বসিয়ে দেশে বকবকানি ও ‘শব্দ দূষণ’ও কিছুটা কমে আসতে পারে। আর মানুষ কথা কম বললে সরকারেরও তাতে সুবিধা। গণতন্ত্রও তাতে ‘নিষ্কণ্টক’ হতে পারে!
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)