বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর একটি মামলা করতেই লেগে গিয়েছিলো ২১ বছর। আর ওই বাড়িতে সেদিন বঙ্গবন্ধুর কোনো স্বজনকে জীবিত না রাখায় তার আবাসিক ব্যক্তিগত সহকারিকে মামলাটি দায়ের করতে হয়।
মামলা করতে এতোদিন লেগে যাওয়ার কারণ, ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ। খন্দকার মুশতাক সেই অধ্যাদেশটি জারি করে, ৫ম সংশোধনীর মাধ্যমে জিয়াউর রহমান তা অনুমোদন করিয়ে নেয়, আর পরে এইচ এম এরশাদ এবং বেগম খালেদা জিয়ার সরকার তা বহাল রাখে।
১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফিরে এসে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল করলে রাষ্ট্রের জনক হত্যার বিচারের পথ খুলে।
ওই বছরের ২ অক্টোবর আ ফ ম মুহিতুল ইসলাম মামলাটি দায়ের করলেও ঘটনার পরই তিনি মামলা করার চেষ্টা করেছিলেন। মামলার বিচারক রায়ে উল্লেখ করেছেন: তখন তাকে বলা হয় তুই নিজেও মরবি, আমাদেরও মারবি, এখন চলে যা, অনুকূল পরিবেশ আসলে এজাহার করিস।
সেই অনুকূল পরিবেশ আসতে লেগে যায় ২১ বছর।
ঐতিহাসিক এই মামলার বাদী হওয়ার প্রেক্ষাপট বর্ণনা করে তিনি এজাহারে জানান: ১৯৭১ সালের ১৩ ডিসেম্বর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী সচিবালয়ে সহকারি হিসেবে চাকরিতে যোগ দেন তিনি। ১৯৭৪ সাল থেকে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রেসিডেন্ট পি এ কাম রিসিপশনিস্ট ছিলেন।
তিনি বলেন, ১৯৭৫ সালের ১৪ আগস্ট দিবাগত রাত ৮টা থেকে পরের দিন সকাল ৮টা পর্যন্ত তার ডিউটি ছিলো। যথাসময়ে ডিউটিতে এসে পুলিশের ডিএসপি নুরুল ইসলাম খান, ইন্সপেক্টর খোরশেদ আলম, স্পেশাল ব্রাঞ্চের একজন পুলিশ অফিসার, পুলিশের অন্যান্য পদের লোক ও সেনাবাহিনীর কয়েকজন গার্ডকে ডিউটিতে দেখেন।
রাত ১টার সময় টেলিফোন মিস্ত্রী আব্দুল মতিন তাকে ঘুম থেকে ধাক্কা দিয়ে তুলে বলে, ‘রাষ্ট্রপতি আপনাকে ডাকছেন।’ তখন ভোর সাড়ে ৪টা/৫টা হবে। চারদিকে ফর্সা হয়ে গেছে। বাড়ীর চারদিকে বিদ্যুতের আলোও জ্বলছিলো। তাড়াতাড়ি গিয়ে টেলিফোন ধরলে রাষ্ট্রপতি দোতলা থেকে বলেন, ‘সেরনিয়াবাতের বাসায় দুষ্কৃতকারীরা আক্রমণ করেছে। জলদি পুলিশ কন্ট্রোলরুমে ফোন লাগা।’
নির্দেশমতো ফোন করেও লাইন পাচ্ছিলেন না মুহিতুল ইসলাম। ঠিক তখন রাষ্ট্রপতি দোতলা থেকে এসে বললেন, ‘পুলিশ কন্ট্রোল রুমে লাগাতে বললাম, লাগালি না?’ জবাবে তিনি বললেন, ‘চেষ্টা করছি, লাইন পাচ্ছি না।’ এই সময় গণভবন এক্সেঞ্জের লাইন পেলেও কেউ উত্তর দেয় না।
রাষ্ট্রপতি তার হাত থেকে টেলিফোন নিয়ে বললেন, “‘মি প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিব বলছি।’ ঠিক ওই সময় একঝাক গুলি দক্ষিণ দিকের জানালার কাঁচ ভেঙ্গে অফিস কক্ষের দেওয়ালে লাগে। অন্য ফোনে চিফ সিকিউরিটি অফিসার মহিউদ্দিন তখন ফোন ধরের। সেসময় আবারো ওই জানালা দিয়ে অনর্গল গুলি আসে এবং ভাঙ্গা কাঁচে বঙ্গবন্ধুর ডান হাতের কনুই কেটে রক্ত ঝরতে থাকে।
কিছুক্ষণ পর গুলি বন্ধ হলে কাজের ছেলে আব্দুল ওরফে সেলিম উপর থেকে পাঞ্জাবী/চশমা এনে দিলে বঙ্গবন্ধু ওই পাঞ্জাবী/চশমা পরে বারান্দায় এসে ‘আর্মি সেন্ট্রি, পুলিশ সেন্ট্রি, এতো গুলি হচ্ছে, তোমরা কি করো?’ এই বলে উপরে চলে যান।
তারপর শেখ কামাল উপর থেকে এসে বলেন, ‘আর্মি ও পুলিশ ভাই, আপনারা আমার সাথে আসেন।’ তখন ৩/৪ জন কালো ও খাকি পোশাকধারী সশস্ত্র আর্মি আসে। খাকি পোশাকধারী মেজর হুদা শেখ কামালের পায়ে গুলি করে। শেখ মুজিবের ছেলে শেখ কামাল বলে পরিচয় দিলে সাথে সাথে শেখ কামালকে ব্রাশ ফায়ার করে হত্যা করে।
সেসময় মুহিতুল ইসলামের হাঁটুতে এবং ডি এস পি নূরুল ইসলামের পায়েও গুলি লাগে। তারা দুইজন ও আরেকজন অফিসার পেছনের দরজা দিয়ে বাইরে যাবার চেষ্টা করলে মেজর হুদা তাদের চুল ধরে টেনে তুলে এবং গেটের সামনে লাইনে দাঁড় করায়। ওই লাইনে পুলিশের লোক ও টেলিফোন মিস্ত্রী আব্দুল মতিনও ছিলো।
মুহিতুল ইসলাম বলেন: হঠাৎ একজন অস্ত্রধারী আর্মি এসে স্পেশাল ব্রাঞ্চের পুলিশ অফিসারকে গুলি করে। গুলি খেয়ে তিনি মারা যান। তারপর কয়েকজন আর্মিকে তাদের পাহারায় রেখে বাকিরা ফায়ার করতে করতে দোতলার দিকে উঠে যায়। কিছুক্ষণ পর বঙ্গবন্ধুর উচ্চ কণ্ঠস্বর, তারপর গুলির শব্দ এবং দোতলার মহিলাদের আহাজারি ও আর্ত চিৎকার শুনতে থাকেন। পেছনের রান্নাঘর থেকে কাজের মহিলা, গোয়ালঘর থেকে রাখাল আজিজ, উপর থেকে শেখ নাসেরকে এনে লাইনে দাঁড় করায়। শেখ নাসেরের হাত তখন গুলিতে রক্তাক্ত জখম ছিলো।
এজাহার অনুযায়ীশেখ নাসের বললেন, ‘স্যার আমিতো রাজনীতি করি না। কোন রকম ব্যবসা করে খাই।’ তখন পাহারারত একজন আর্মি বলে, ‘শেখ মুজিব ইজ বেটার দ্যান শেখ নাসের।’ যে অস্ত্রধারী আর্মি শেখ নাসেরকে নামিয়ে এনেছিলো সে বলে, “ঠিক আছে আপনাকে কিছু বলবো না, আপনি ওই রুমে যেয়ে বসেন।” এই বলে অফিস রুমের বাথরুমে নিয়ে শেখ নাসেরকে গুলি করে। শেখ নাসের পানি পানি বলে চিৎকার করতে থাকলে পাহারারত আর্মিদের একজন অন্য আরেকজনকে বলে, “যা পানি দিয়ে আয়।” সে গিয়ে পানির বদলে আবারো শেখ নাসেরকে গুলি করে।
সেসময় উপর থেকে কাজের ছেলে আব্দুল রহমান ওরফে রমা ও শেখ রাসেলকে আর্মিরা নিয়ে আসে। শেখ রাসেল মুহিতুল ইসলামকে জড়িয়ে ধরে বলে, ‘ভাইয়া আমাকে মারবে না তো?’ শিশু রাসেলকে মারবে না সে ধারণা থেকেই তিনি বলেন, ‘না ভাইয়া তোমাকে মারবে না।’ তারপর একজন আর্মি তার কাছ থেকে শিশু রাসেলকে ছিনিয়ে নেয়। তখন রাসেল তার মায়ের কাছে যেতে চাইলে তাকে মায়ের কাছে নেবে বলে দোতলার দিকে নিয়ে যায়। এর পর গুলির শব্দ শোনা যায়।
তারপর গেটে অবস্থানরত মেজর হুদাকে মেজর ফারুক কি যেন জিজ্ঞাসা করলে মেজর হুদা বলেন, “All are finished” । তখন তিনি বুঝলেন রাষ্ট্রপতিসহ তার পরিবারবর্গ ও আত্মীয় স্বজনকে হত্যা করা হয়েছে।
তিনি জানান: ওইসময় বঙ্গবন্ধুর বাড়ির সামনে দিয়ে কালো পোষাকধারী আর্মির লোক ট্যাংকে যাতায়াত করে। সকাল আনুমানিক ৮টার দিকে কর্নেল জামিলের মৃতদেহ তারাই গাড়িতে করে বঙ্গবন্ধুর বাড়ির ভেতরে নিয়ে আসে। তখন মেজর ডালিমকে খাকি পোষাকে গেটে অবস্থানরত আর্মিদের সাথে কথাবার্তা বলতে দেখেন।
তিনি এজাহারে জানান: ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ধানমন্ডি ৩২ নং রোডের ৬৭৭ নং বাসভবনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, বেগম মুজিব, বঙ্গবন্ধুর ছেলে শেখ কামাল, শেখ জামাল, শেখ রাসেল, শেখ কামালের স্ত্রী সুলতানা কামাল, শেখ জামালের স্ত্রী রোজী জামাল, বঙ্গবন্ধুর ছোট ভাই শেখ নাসের ও স্পেশাল ব্রাঞ্চের একজন অফিসারকে গুলি করে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।
মেজর ফারুক, মেজর ডালিম, মেজর নূর, মেজর হুদাকে ঘটনার সময় ও ঘটনার পরে ধানমন্ডি ৩২ নং রোডে বঙ্গবন্ধুর ৬৭৭ নং বাসভবনে দেখেছেন বলে তিনি জানান। তাছাড়া তিনি ১৯৭৩ সালে একদিন যশোর থেকে আসছিলেন। ওইদিন মেজর হুদাও কুষ্টিয়া থেকে আসছিলো। আরিচা ঘাটে তার সাথে পরিচয় হয়। ফেরিতে একই টেবিলে বসে খাবার খায়। পরে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে নিরাপত্তার ডিউটি ফোর্সকে দেখাশুনার জন্য আসতো হুদা। তখনও কথাবার্তা হতো। এইভাবে তাকে চিনতেন।
মেজর নূর, জেনারেল ওসমানী সাহেবের এ ডি সি ছিলো বলে তিনি জানান। নূর মুক্তিযোদ্ধা ছিলো। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তিনি কলকাতায় ১২ নম্বর থিয়েটার রোডে ওসামানী সাহেবের অফিসে যেতেন। সেখানে মেজর নূরের সাথে মুহিতুল ইসলামের পরিচয় হয়। শেখ কামালের বন্ধু হিসেবেও মেজর নূর বঙ্গবন্ধুর বাড়ি আসতো।
তিনি এও জানান: ঘটনার আগে মেজর ডালিম অনেকবার ঘটনার বাড়িতে এসেছিলেন। সেই সুবাদে মুহিতুল ইসলাম তাকে দেখেছেন ও চিনেছেন। মেজর ফারুকের ঘটনার সাথে জড়িত থাকার কথা বহু লোকের কাছে শুনেছেন।
মুহিতুল ইসলাম তার ঐতিহাসিক সেই এজাহারে বলেন: বিভিন্ন আলোচনা, দেশী বিদেশী পত্র-পত্রিকা, ম্যাগাজিন, বই-পুস্তক পড়ে তিনি জানতে পারেন যে, খন্দকার মুশতাক, তাহের উদ্দিন ঠাকুর, মেজর রশিদ, মেজর পাশা, মেজর শরিফুল হোসেন, মেজর শাহরিয়ার, মেজর রাশেদ চৌধুরী, মেজর মহিউদ্দিন, ক্যাপ্টেন কিসমত, রিসালদার মোসলেহ উদ্দিনসহ সাঁজোয়া ও গোলন্দাজ অন্যান্য বাহিনীর কতিপয় বিপথগামী সৈনিক উচ্চাভিলাষী রাজনৈতিক নেতাদের সাথে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়ে রাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ও তাঁর পরিবারবর্গকে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট নির্মমভাবে হত্যা করে।