বাংলা আমাদের মায়ের ভাষা, আমাদের প্রাণের ভাষা, আমাদের স্বাধীনতার ভাষা, আমাদের প্রতিবাদের ভাষা। এই ভাষার আত্মত্যাগের ইতিহাস যাদের জানা আছে, তারা জানেন একুশে ফেব্রুয়ারি মানে কী! অথচ আসন্ন ২১ ফেব্রুয়ারির ঠিক আগ মুহূর্তে বাংলা ভাষা নিয়ে একটি দুঃখজনক ‘বিতর্কের’ মুখোমুখি কিংবদন্তী শিল্পী, গীতিকার ও অভিনেতা কবীর সুমন।
যে তিক্ত অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়ে রীতিমত হতভম্ব বনে গেছেন জাতিস্মর খ্যাত এই গানওয়ালা।
ভাষার জন্য বাঙালির আত্মত্যাগের স্মারক ২১ ফেব্রুয়ারি। এদিনটি স্মরণীয় করে রাখতে বিশ্বব্যাপী পালন করা হয় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। এদিনটিকে ঘিরে রেডিও, টেলিভিশনসহ সংবাদমাধ্যমে থাকে বিশেষ আয়োজন। অথচ এমন তাৎপর্যপূর্ণ দিনের ঠিক আগের দিন বাংলা ভাষা নিয়ে কলকাতার একটি এফএম রেডিও থেকে ‘ঔদ্ধত্যপূর্ণ’ প্রশ্নের মুখোমুখি হন সুমন।
কী ছিলো সেই প্রশ্ন, যা শুনে তীব্র ভাষায় প্রতিক্রিয়া জানালেন কবীর সুমন? বৃহস্পতিবার (২০ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে কবীর সুমন ফেসবুকে একটি ভিডিও পোস্ট করেন। যেখানে তিনি বাংলা ভাষা নিয়ে সেই বিতর্কিত প্রশ্নটির কথা তুলে ধরেন এভাবে: কলকাতার একটি এফএম রেডিও থেকে ফোন দিয়ে একটি বিষয়ে আমার মতামত নিতে চাইলেন একজন। ফোন দিয়ে আমাকে বললেন, এটি একটি বিতর্ক। এই বিষয়ে আপনার মতামত চাই। আমি বললাম, ‘কী বিষয়ে?’ উনি আমাকে বললেন, ‘বাংলা ভালোবাসাও নয়, বাংলা ভাল ভাষাও নয়’!
২১ ফেব্রুয়ারির কথা স্মরণ করে কবীর সুমন এরপর বলেন: বন্ধুরা, আজ ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২০ সাল। আগামিকাল ২১ ফেব্রুয়ারি। আমরা রয়েছি শহর কলকাতায়। এটা নাকি বাংলা সংস্কৃতির প্রাণ কেন্দ্র। বিরাট বিরাট বাঙালি এখানে জন্মেছেন, এখনো জন্মাচ্ছেন! সেখানে ২০ ফেব্রুয়ারি একটি এফএম চ্যানেল থেকে একজন প্রবীণ নাগরিকের কাছে একটি প্রশ্ন আসছে, যা একটি বিতর্ক। আমাকে অনুরোধ জানানো হলো ‘প্লিজ আপনি বলুন, কারণ তারকারা এই বিতর্কে মত দিচ্ছেন!’ অথচ আমি সকাল থেকে বাংলা খেয়ালের রেওয়াজ করছিলাম, কারণ ২১ ফেব্রুয়ারি উপলক্ষ্যে আমাকে একটি অনুষ্ঠানে সংগীত পরিবেশন করতে হবে!
কবীর সুমন বলেন: তামিল, তেলেগু কিংবা মুম্বাইয়ের তারকারা নয়, ‘বাংলা ভালোবাসাও নয়, বাংলা ভাল ভাষাও নয়’-এই বিতর্কে মত দিচ্ছেন পশ্চিম বাংলার তারকারা! এমন প্রশ্ন শুনে আমি হাসবো না কাঁদবো! আমি এফএম থেকে ফোন দেয়া লোকটিকে পাল্টা প্রশ্ন করলাম, ‘আপনার খারাপ লাগছে না এমন প্রশ্ন করে মতামত চাইতে? ৭২ বছর বয়স আমার। একজন বাপের বয়সী মানুষ। বাঙালির ছেলে এমন প্রশ্ন করতে একবারও খারাপ লাগছে না?’ ছেলেটি কিন্তু হার মানছে না, বরং বারবার বলতে চেষ্টা করছে যে, ‘স্যার স্যার, সব তারকারা মত দিচ্ছেতো!’
হতাশ কণ্ঠে কবীর সুমন আরো বললেন, আমরা কি তাহলে হেরে গেলাম? ১৯৭৬ সালে আমার বন্ধু শহীদ কাদরীর সঙ্গে যখন জার্মানিতে প্রথম আলাপ হয়েছিলো, তখন তিনি বলেছিলেন ‘সুমন, সাংস্কৃতিক লড়াইয়ে আপনারা জিতে গেছেন’, আমি তাকে বলেছিলাম ‘বোধহয় নয় শহীদ’! শহীদ, আপনি চলে গেছেন এই পৃথিবী ছেড়ে, বেঁচে গেছেন শহীদ। আপনাকে এরকম প্রশ্ন শুনতে হলো না।
বাংলা ভাষা নিয়ে এমন বিতর্ক তুলে মতামত জানতে চাওয়াকে স্পর্ধা হিসেবেই দেখছেন অনেকে। বিশেষ করে কবীর সুমনের ভিডিও পোস্টের নীচে অনেকেই মন্তব্য করেছেন। তারা বলছেন, ‘মায়ের ভাষা, প্রাণের ভাষা, রাগের ভাষা,অনুরাগের ভাষা- আমাদের প্রিয় বাংলা ভাষা। বুকের ভেতর একটা জোরেশোরে ধাক্কা লাগলো বাঙালির সবচেয়ে বড় অর্জন ২১ ফেব্রুয়ারির ঠিক প্রাক্কালে এসে। ‘বাংলা ভাল ভাষাও নয়, বাংলা ভালোবাসাও নয়’-এমন বিতর্কের আয়োজন হচ্ছে, আবার সেই আয়োজনে তারকারা সম্মতিও জানাচ্ছেন। এমন দিনও দেখতে হলো!’
কেউ বলছেন, ‘লজ্জিত কবীর সুমন। কিন্তু আমরা অনেক বাংলাভাষাভাষি বাঙালি এখনো বেঁচে আছি। আর আমরা হারবো না, আমরা হারতে আসিনি।’
সঞ্চিতা সেন নামের একজন লিখেছেন, ‘এটা বিতর্কের বিষয় হলো? যিনি প্রশ্ন করলেন, তিনি নিজে তো বাঙালি। কার মস্তিষ্ক প্রসূত এই বিষয়? আমার ভাষা বেঁচে থাকুক। আমার ভাষা আরো সমৃদ্ধ হোক। আমার ভাষায় আরো অবাঙালি মানুষ কথা বলুক।’
বিশ্বজিৎ রায় নামের আরেকজন লিখেছেন, ‘সুমনদা আমার সীমিত জ্ঞান থেকে জানাই, তাহলে কি মহান ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ভুল করেছিলেন বা মহান বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়? বির্তকের বিষয় যদি ‘ভাষা’ নিয়ে হয় আর তা কলকাতার মতো এক প্রাচীন শহরের কেন্দ্রবিন্দুতে, তার পরিণতি কী হতে চলছে? সেটাই ভাবনার!’