শিরোনাম দেখে অনেকেই বলতে পারেন কিসের মুক্তি দরকার আবারো? আমরাতো অনেকবারই আন্দোলন সংগ্রাম করে বহু শৃঙ্খল ভেঙ্গে শত সহস্র ত্যাগের বিনিময়ে মানবতার মুক্তির দ্বার উন্মোচন করেছি। এখন আবার কিসের মুক্তি?
প্রকৃতার্থে, মুক্তির কোন বিকল্প নেই বর্তমানের প্রেক্ষিতে বিবেচনায় এবং মুক্তি বিষয়টি আপেক্ষিক এবং অনুভবের। খোলা চোখে এবং অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে মুক্তির বিষয়টিকে দুভাবে দেখা যায়। যেমন: আমরা পরাধীনতার শৃঙ্খল হতে মুক্ত হয়েছি এবং বর্তমানে আমরা উদ্ভূত বেশ কিছু সামাজিক সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য মুক্তির পথ খুঁজছি। এই যে আমরা প্রতিদিন ঘর থেকে বের হচ্ছি, কয়জন হলফ করে বলতে পারি নিরাপদে, নিশ্চিন্তে এবং নির্ভয়ে ঘরে ফিরতে পারবো। এমন কোন দিন কি যাচ্ছে যেখানে খবরের শিরোনামে কিংবা টিভির স্ক্রলে সড়ক দুর্ঘটনায় হতাহত কোন না কোন মানুষের খবর আমরা পাচ্ছি না। এ ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত, অনাহুত এবং অস্থিতিশীল অবস্থা থেকে আমরা মুক্তি চাই। যেখানে আমাদের সন্তানরা ঘর থেকে বের হওয়ার পর তাদেরকে নিয়ে আমাদের কোন দুশ্চিন্তা করতে হবে না। এ ধরনের মুক্তির জন্য আমরা প্রতিনিয়ত লড়াই করে যাচ্ছি।
সড়ক দুর্ঘটনার হাত থেকে কবে আমরা মুক্তি পাবো? বেশ কয়েকবার সড়ক দুর্ঘটনার বিরুদ্ধে দেশব্যাপী আন্দোলন হয়েছে অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু প্রতিরোধে এবং সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য। কার্যকরী সমাধান খুব বেশি একটা আসেনি বললেই চলে। যদি আসতো তাহলে প্রতিদিনকার দুর্ঘটনার খবর টিভি স্ক্রলে ভেসে আসতো না। এ ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত সংবাদ থেকে আমরা মুক্তি চাই। যে সব কারণে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে থাকে সেগুলো সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করা গেলেও বারবার কেন আমরা সমাধানে ব্যর্থ হচ্ছি? কিছু বিষয় রয়েছে যেগুলোর জন্য কোন রকম ছাড় দেওয়া জাতির জন্য অত্যন্ত লজ্জাজনক ও কলঙ্কের। এসব লজ্জাজনক ঘটনার মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনা অন্যতম। একবার ভাবা যায়, একটা মানুষ স্বাভাবিক জীবন যাপনের নিশ্চয়তা পাচ্ছে না, বিদ্যমান ব্যবস্থার ত্রুটি বিচ্যুতির কারণে অকালে মৃত্যুবরণ কোনভাবেই কাম্য নয়। অথচ যে পরিবারের মানুষটি সড়ক দুর্ঘটনার কবলে পড়ে অকালে প্রাণ হারায় সে পরিবারের মানুষই বুঝতে পারেন তাদের প্রিয়জন হারানোর মর্মবেদনা। কাজেই, সড়ক দুর্ঘটনার সাথে সম্পৃক্ত এবং তাদের হোতাদের বিরুদ্ধে তড়িৎগতিতে আইনের যাচাই বাছাই কল্পে ব্যবস্থা গ্রহণ সময়ের দাবিতে পরিণত হয়েছে।
সড়ক দুর্ঘটনার পাশাপাশি সাম্প্রতিক সময়ে নারী ও শিশু ধর্ষণ এবং পুড়িয়ে হত্যা চেষ্টার দুর্ভাগ্যজনক সংস্কৃতি বাংলাদেশের সার্বিক অর্জনকে ভূলুণ্ঠিত করার পায়তারা ও সমাজের বিনির্মাণকে নষ্ট করে দিচ্ছে। সভ্য সমাজের পরিচায়ক হিসেবে ধর্ষণকারী এবং এর সাথে সংশ্লিষ্টদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির নিশ্চয়তাই পারে সমাজে বসবাসরত মানুষদের মধ্যকার জাগরূক ভয়ের সংস্কৃতি দূরীভূত করতে। ফেনীর সোনাগাজি ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদরাসার ছাত্রী নুসরাতকে আগুন দিয়ে মারত্নকভাবে দগ্ধ করা হয়। মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ে বার্ন ইউনিটে মেয়েটির মৃত্যু হয়। সারাদেশে নুসরাত হত্যার প্রতিবাদে আমজনতা প্রতিবাদমুখর হয়ে নানামুখী কর্মসূচি যেমন: মানববন্ধন, আলোচনা ও প্রতিবাদ সভা এবং পথসভার আয়োজন করছে। নুসরাত হত্যার প্রতিবাদে মানুষের মধ্যে প্রতিবাদের স্বতঃ:স্ফূর্ততা ফুটে উঠেছে এবং দলমত নির্বিশেষে সকলেই ঘটনাটির সুষ্ঠু তদন্ত সাপেক্ষে প্রকৃত দোষীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবি করছে।
কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে, নুসরাতের হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ চলাকালীন সময়েই ফেনীর দাগনভূঞা উপজেলার খুশিপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আবদুল করিম (৫৫) একই বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রীকে ধর্ষণ করেন এবং এতে অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়ে শিশু ছাত্রীটি। পরবর্তীতে আদালতে জবানবন্দিতে বিষয়টি স্বীকার করে নেন প্রধান শিক্ষক। ঘটনাটি দুটি কেমন সামঞ্জস্যপূর্ণ, দুজন ধর্ষকই প্রতিষ্ঠান প্রধান। এরা কতটা বিবেকহীন ও মানসিক বিকারগ্রস্ত হলে কন্যাসম মেয়েকে ধর্ষণ করতে পারে। অবশ্য ধর্ষকের কোন ধর্ম নাই, ধর্ষকের কোন জাত নাই, ধর্ষক সমাজের নিকৃষ্ট কিট। সর্বোপরি, কথা হচ্ছে এদের কাছে প্রতিষ্ঠানের কোন শিশু/ছাত্রী নিরাপদ নয়, এরা দানব, মনুষ্য রূপ নিয়ে সমাজে কতিপয় দুষ্ট লোকের ছত্রছায়ায় এরা টিকে আছে। অথচ এরাই কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে সংশ্লিষ্ট বিদ্যালয়ে এবং মাদ্রাসায় পাঠদানের সাথে জড়িত। বিগত দিনে যে তারা এমন ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটায়নি সেটা কিন্তু বলা যাবে না স্পষ্টভাবে। কেননা, এ ঘটনাগুলো সবার সামনে এসেছে যার পরিপ্রেক্ষিতে সকলেই জানতে পেরেছে এবং সরকারও কোনভাবেই এ ঘটনায় জড়িতদের বিষয়ে আপোষ করবে না বলেই মনে করি এবং এর সাপেক্ষে কতিপয় দ্রুতগতির পদক্ষেপও আমরা দেখতে পেয়েছি। সুতরাং আমরা আশা করতে পারি এ দুটি ঘটনার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করে অন্যদের জন্য উদাহরণ সৃষ্টি করা যাতে সহজেই কেউ এমন ঘৃণ্য ও ন্যক্কারজনক কাজের সাথে সম্পৃক্ত হওয়ার সাহস না পায়।
সাম্প্রতিক হিসেবে ধর্ষণের এ দুটো ঘটনার উদাহরণ টেনে আনলাম, এছাড়া বাংলাদেশের নানা প্রান্তে ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে। ধর্ষণের মতো ন্যক্কারজনক ও জঘন্য কর্মকাণ্ডের প্রতিকার এবং প্রতিরোধের জন্য যে ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত তার স্বরূপ তুলে ধরার চেষ্টা করবো। প্রথম কথা হচ্ছে ধর্ষক কিন্তু আমাদের দেশেরই ছেলে, দেশের বাইরে থেকে কেউ এসে ধর্ষণ করছে না। ধর্ষকের সামাজিকীকরণ মূলত পারিবারিক শিক্ষা ও বেড়ে উঠার লগ্নে কি ধরনের সমস্যার মুখোমুখি হয়েছিল কিংবা পিয়ার গ্রুপের প্ররোচনায় ও সহযোগিতায় একটি ছেলে ধর্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হচ্ছে সে বিষয়গুলো সামনে নিয়ে আসা জরুরী। দীর্ঘমেয়াদী ভিত্তিতে গবেষণা করে সমাজভিত্তিক ও অঞ্চলভেদে গবেষণা প্রকল্পের উদ্ভূত পদ্ধতি অবলম্বন করে ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং বের করে তৎসাপেক্ষে ব্যবস্থা গ্রহণ করলে হয়তো সমাজে ধর্ষণের সংখ্যা ও ধর্ষকের সংখ্যাও কমে আসবে। যদি এটা সময়সাপেক্ষ বিষয় এবং এর জন্য যথার্থ বাজেটেরও প্রয়োজন রয়েছে। অপরাধবিজ্ঞানী আরভিন ওয়ালার বলেছেন: অপরাধের কারণ উদঘাটনে জোর দিতে হবে এবং এর জন্য বাজেটে বেশি বরাদ্দ রাখা অপচয় নয়। তাছাড়া আমরা জানি অপরাধ প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধ উত্তম। অর্থাৎ সমাজ এমন ব্যবস্থা গ্রহণ করবে যার পরিপ্রেক্ষিতে শিশুরা যে পরিবেশে বড় হবে সেখানে তারা অপরাধ করার কোন সুযোগ এবং সাহস কোনটাই পাবে না। সেই পরিবেশটা বজায় রাখার জন্য রাষ্ট্রের যে বাজেট বরাদ্দ রাখতে সেটি কোনভাবেই অপচয় হবে না। বরঞ্চ সেটি সমাজ এবং রাষ্ট্রের যুতসই এবং ইতিবাচক চলনের জন্য সহায়ক হবে।
অন্যদিকে, নুসরাতের জন্য দেশব্যাপী আয়োজনে মানববন্ধনে বক্তারা বিচারহীনতার সংস্কৃতিকে এরূপ ধর্ষণের জন্য দায়ী করেছেন। কেননা, পূর্বে যে সকল ধর্ষণ হয়েছে সাম্প্রতিক সময়ে সেগুলোর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি রাষ্ট্র নিশ্চিত করতে পারে নাই যার ধরুণ ধর্ষকরা এবং তাদের দোসররা অপরাধ করার সাহস পেয়েছে। এর দায় রাষ্ট্র কোনভাবেই এড়াতে পারে না, রাষ্ট্রকে এর জন্য কঠোর হস্তে সমাজের সুষ্ঠু বিনির্মাণের স্বার্থে এবং দেশের মঙ্গলের জন্য পদক্ষেপ নিতে হবে। ধর্ষক যতই প্রভাবশালী হোক না কেন এবং তার সহযোগীরা যতই ক্ষমতাবান হোক না কেন তাদেরকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে হবে। অন্যথায়, রাষ্ট্রের সামগ্রিক অর্জন এবং গৃহীত পদক্ষেপ কখনোই আলোর মুখ দেখবে না।
আর যারা ইতিমধ্যে ধর্ষক হিসেবে সমাজে চিহ্নিত তাদের শাস্তি কেমন হওয়া উচিত? আইনের বিধান অনুযায়ী ধর্ষকদের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ শাস্তির নিশ্চয়তা দিতে হবে সেখানে আত্মীয়করণ, দলীয়করণ কিংবা অন্যান্য কোন বিষয় বিচারের ক্ষেত্রে ধর্ষকের পক্ষপাতিত্ব করার কোন সুযোগ নেই। তার পাশাপাশি ধর্ষকের পরিবারকে সামাজিকভাবে বয়কট করে দিতে হবে যাতে সমাজে বসবাসরত অন্যান্যদের জন্য উদাহরণ হতে পারে এবং এর ফলেই অনেকেই ধর্ষণের মতো ঘৃণ্য ও ন্যক্কারজনক কাজের সাথে সংযুক্ত হবার সাহস না পায়। শুধু কি ধর্ষক, তার সাথে যারা সাঙ্গপাঙ্গ আছে তাদেরকে সামাজিকভাবে বয়কট করার নজির স্থাপন করতে হবে। কেননা, সমাজে কোন অস্থিতিশীল সৃষ্টিকারী, চক্রান্তকারী ও অপরাধীদের জায়গা হতে পারে না।
অনেক ত্যাগ, তিতিক্ষা আর বিনিময়ের মাধ্যমে অর্জিত আমাদের এ প্রিয় স্বদেশ। বিশ্বব্যাপী সুনামের সাথে এ দেশের অগ্রযাত্রার ইতিহাস প্রোথিত ও গৃহীত। কাজেই, কিছু দুষ্ট ও কুচক্রী লোকের কর্মকাণ্ডের জন্য এ দেশের সামগ্রিক অর্জনকে ব্যহত হতে দেওয়া যাবে না। দুষ্ট লোকদের ঘৃণিত কর্মকাণ্ডকে শক্ত হস্তে দমন করতে হবে দেশ ও জাতির উন্নয়ন এবং মানবিক বাংলাদেশ গঠনের স্বার্থে। সরকার সহ দেশের সাধারণ নাগরিকদের একযোগে কাজ করতে হবে সমাজ থেকে মানুষরূপী জানোয়ারদের বিতাড়িত করার জন্য এবং তাদেরকে সামাজিক ভাবেও বয়কট করতে হবে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)