ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির সম্মুখে বেলালের চায়ের দোকান। রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের এম.ফিল গবেষক সাংবাদিক সায়েম চা পান করছে। তার সাথে দুজন লাইব্রেরিয়ান। হঠাৎ হন্তদন্ত হয়ে লাইব্রেরির ভিতর থেকে এক শিক্ষার্থী এলো। অভিযোগের সুরে লাইব্রেরিয়ান বেলাল ভাইকে বললো: দু’তলায় প্রতিদিন একজন মহিলা আসেন। সে নিজেকে পুলিশের স্ত্রী পরিচয় দেয়। দূরে হাইওয়ে পুলিশের একটি গাড়ির দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে শিক্ষার্থী। গাড়িতে চড়ে ঐ মহিলা আসে। লাইব্রেরিয়ান বেলায়েত জিজ্ঞাসা করলো, আপনি মহিলার লাইব্রেরি কার্ড দেখতে চাননি? শিক্ষার্থী বললো, আমি কিভাবে কার্ড দেখি। সে পুলিশের স্ত্রী। আমার ক্ষতি করতে পারে।
এবার সায়েম একটু চড়া গলায় বললো,
এই ছেলে তুমি কি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী?
ছেলেটি ‘হ্যাঁ’ সুচক জবাব দিলো।
ছেলেটির নাম সিয়াম। নেত্রকোনার কেন্দুয়া তার বাড়ি। বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘সমাজ কল্যাণ’ বিষয়ে তৃতীয় বর্ষে পড়ছে।
সায়েম: সকালে নাস্তা করেছো?
সিয়াম: না, মানে!
সায়েম: যাও আগে নাস্তা করে নাও।
ছেলেটি দ্রুত বেলালের দোকান থেকে নাস্তা নিয়ে প্রাত:রাশ সারলো।
শাকিল: লাইব্রেরীতে কি পড়ো এমপি থ্রি’!
সিয়াম: হ্যাঁ ভাই সবাই পড়ে!
সায়েম: ‘সমাজ কল্যাণ’ কিছু পড়ো!
সিয়াম: না ভাই।
সায়েম: কেনো পড়বে ওটাতো আর বিসিএস পরীক্ষায় আসবে না। তাই না!
সিয়াম: হ্যাঁ ভাই, ক্লাসে গিয়ে গল্পগুজব করি। শিক্ষকরাই তো বিসিএস পড়ার পরামর্শ দেয়।
সায়েম: তো, ‘এমপি থ্রি’ পড়ছো ভালো কথা। কিন্তু চেহারার এই অবস্থা কেনো। ভীষণ হতাশ মনে হচ্ছে।
সিয়াম: জ্বি ভাই।
সায়েম: গতকাল কী করেছো?
সিয়াম: এলাকা থেকে দুই বন্ধু পরীক্ষা দিতে এসেছিলো। তাদের সঙ্গ দিয়েছি।
সায়েম: আরেকদিন অন্য দুজন আসবে। তাদের সঙ্গ দেবে নাকি!
সিয়াম: না মানে।
সায়েম: আচ্ছা তোমার যে বন্ধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পায়নি। যে এখন কেন্দুয়া সরকারি কলেজে পড়াশুনা করছে। সেও তো বিসিএস প্রস্তুতি নিচ্ছে। সে কি পড়ে জানো?
সিয়াম: সেও এমপি থ্রি পড়ে।
তাহলে তার আর তোমার মধ্যে কি পার্থক্য বলো তো। তুমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়লেও কেন্দুয়া সরকারি কলেজ মানেরই আছো। যে কারণে একজন নারী অবৈধভাবে লাইব্রেরীতে প্রবেশ করলেও তুমি সাহস করে তাকে লাইব্রেরী কাডের্র কথা জিজ্ঞাসা করতে পারো না।
সায়েম এবার নিজের পরিচয় দিলো। বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক পর্যায়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থী হিসেবে সিয়ামের সাথে তার সম্পর্কটা অনেক সহজ ও অভিভাবকসুলভ আলাপের সুযোগ তৈরী করলো।
সিয়াম জানতে চাইলো, হতাশা থেকে উত্তরণের উপায় কী?
সায়েম বললো, তোমার সাথে ছয়মাস পর আবার আলাপ হবে। এই ছয়মাস তুমি লাইব্রেরীতে বাংলাপিড়িয়া পড়বে।
সিয়ামের প্রশ্ন, বাংলাপিড়িয়া কী?
এবার সায়েম চুড়ান্তভাবে বিস্মিত হলো এবং দারুণভাবে হতাশ হলো।
কেউ যদি সকাল ৬টা থেকে সকাল ৮টা এই সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মুখে যায় তবে ভালোই লাগবে। শিক্ষার্থীরা লাইব্রেরীতে পড়ার জন্য সকাল ৬টা থেকে লাইনে দাড়িয়ে আছে। ৮টায় গ্রন্থাগারের গেইট খুলে দেয়া হয়। ভেতরে প্রবেশ করতে ৩০ মিনিট লাগে অপেক্ষমানদের। এক ঘণ্টা পর কৌতুহল নিয়ে যে কোন দর্শনার্থী ভিতরে প্রবেশ করলে দেখতে পাবে, থরে থরে সাজানো এনসাইক্লোপিড়িয়া ব্রিটেনিকাসহ বৈশ্বিক জ্ঞান ভান্ডারের প্রতি তাদের কোন আগ্রহ নেই। পড়ার টেবিলগুলোতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ষষ্ঠ, সপ্তম, অষ্টম, নবম শ্রেনীর পাঠ্যবই। আর সাথে মহামহিম এমপি থ্রি নামের অদ্ভুত এক জগাখিচুড়ি বই।
এমপি থ্রি কাহাকে বলে?
ডিজিটাল যুগে এমপি থ্রি নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেয়ার খুব বেশি প্রয়োজন নেই। গুগল বলছে ‘ MP3 stands for mpeg audio layer. MP3 is a compressed audio file format developed by the moving format developed by the moving picture expert group (MPEG)’
অধিক গানের সংকলনের জন্য জমাট করে গান সংরক্ষণ প্রযুক্তি। এই নাম দিয়ে বেশ কয়েবছর ধরে বিসিএস প্রিলিমিনারি পরীক্ষার জন্য বই প্রকাশ করছে ব্যবসায়িক বুদ্ধিতে পাকা প্রকাশনী। লাভের হিসাবে সংস্থাটি দারুণভাবে সফল। শিক্ষার্থীরা বিসিএস প্রস্তুতির জন্য অনাকর্ষণীয়, মুখস্ত নির্ভর প্রশ্নের বৈতরণী পার হতে এমপি থ্রি গিলে খায়। তার ফল হলো সিয়ামের মতো বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী বাংলাদেশ নিয়ে গভীর জ্ঞানের প্রাথমিক পাঠ বাংলাপিড়িয়া চেনে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন একটা বিষয়ে পড়লেও ঐ বিষয়ের একটা বইয়ের নামও তার জানা নেই। সে তার প্রয়োজনীয়তাও অনুভব করে না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যলয়ে কে পড়ে, কে পড়ায়!
পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় তৃতীয় বিশ্বের দেশ বাংলাদেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। যারা এখানে ভর্তি হয় তারা প্রত্যেকে নিজ নিজ এলাকার সবচেয়ে মেধাবী শিক্ষার্থী। তবে আর্থিকভাবে বেশিরভাগ নিন্ম মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থীর স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পড়াশুনা সমাপ্ত করতে যে পরিমান অর্থ ব্যয় হয় তার সামান্য অংশ ঐ শিক্ষার্থীর পরিবার দেয়। বাকী অর্থ কে দেয়? এই রাষ্ট্র ভর্তুকি দেয়। ভর্তুকির অর্থ কে দেয়? ভর্তুকির অর্থ যারা দেয় তাদের বড় একটি অংশ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে পারে না। কোন কোন ক্ষেত্রে তাদের সন্তানরাও পড়তে পারে না। একজন রিক্সাওয়ালা, একজন গার্মেন্টসকর্মী, একজন খেটে খাওয়া মানুষ তার প্রতিদিনের বাজার করতে গিয়ে যে ভ্যাট দেয়, ট্যাক্স দেয় সেখান থেকেই একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীর পড়াশুনার বেশিরভাগ অর্থ আসে। অথচ কি অদ্ভুত আমরা যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পাই তারা স্বার্থপরের মতো সমাজ, দেশ, রাষ্ট্র নিয়ে নূন্যতম চিন্তা বাদ দিয়ে একটি চাকুরির জন্য প্রথমবর্ষ থেকে হাইস্কুলের সিলেবাস পড়ি। চাকরি পাওয়ার পর বড় একটি অংশ সবচেয়ে বেশি অবহেলার সাথে নিরন্ন মানুষদের প্রতি দরদের পরিবর্তে দয়া দেখানোর ভাব দেখাই। বিশ্ববিদ্যালয়ে বৈশ্বিক জ্ঞান সমুদ্রে অবগাহনের কোন আগ্রহ তৈরী হয় না। প্রয়োজনীয়তাও সে বুঝতে পারে না। সে যেনো উচ্চ শিক্ষার স্তরে এসে বামনে পরিণত হয়। তার মধ্যে আন্তর্জাতিক বোধও থাকে অনুপস্থিত।
চাকরি পাওয়ার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার আদৌ কোন প্রয়োজন আছে কিনা খতিয়ে দেখার সময় হয়েছে। অসংখ্য শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে পারে না। পরবর্তী জীবনে আর্থিকভাবে তারা বেশ ভালোই সফল হন। তাহলে শুধু নিজের একটি চাকরির জন্য বিশাল জনগোষ্ঠী কেনো আমাকে আপনাকে ভর্তুকি দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াবে? কারণ তারা উদয়াস্ত পরিশ্রম করে নিজের জীবন মানকে আরেকটু সুন্দর, আরেকটু উন্নত, আরেকটু ভালো করার চিন্তা করতে পারে না। তাই তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের পড়ায় যেন উচ্চ বিদ্যায়তনের শিক্ষার্থীরা নিবিষ্টমনে পড়াশুনা করে এমন তত্ত্ব আবিষ্কার করতে পারে যাতে খেটে খাওয়া, নিরন্ন মানুষের জীবনের কল্যাণ হয়। গত দুই দশকে দেশের আর্থ সামাজিক উন্নয়নে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্ঞান সৃজনের আয়োজন বহুলাংশে যে অনুপস্থিত সেটি সহজে অনুমেয়।
চাকরিজীবী উৎপাদন করা একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান পরিচয় হতে পারে না। সেটি কারিগরি কোন প্রতিষ্ঠান হলে মেনে নেয়া যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের নয়। দেশ ও বিশ্বের জ্ঞান নির্ভর অর্থনীতি ও সৃজনে বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদান ঐ উচ্চ শিক্ষায়তনের পরিচয় বিনির্মাণ করে। অন্যথায় আমরা শতবর্ষের আবেগের ভাবলুতায় একদিন সামাজিক মাধ্যমে নিজেদের পোস্টারিং করে গর্বিত হবো আর বাকী ৩৬৪ দিন বলবো, ‘হায় বিশ্ববিদ্যালয় যেখানে বিশ্ব বিদ্যা প্রতিদিন লয় প্রাপ্ত হয়।’
হাইস্কুলে অবনমিত বিদ্যালয়কে বৈশ্বিক রূপে ফিরিয়ে আনার আওয়াজ দেয়ার এখনই উপযুক্ত সময়। এক্ষেত্রে জনগণের অর্থে ইতোমধ্যে পাঠ শেষ করে স্ব স্ব ক্ষেত্রে স্বনির্ভর প্রাক্তণ শিক্ষার্থীরা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারেন।
শতবর্ষের কামনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্ববিদ্যালয় রূপে স্ব-মহিমায় পূর্ণরূপে ফিরে আসুক।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)