চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

এক দশকে আরো বিস্তৃত জঙ্গি নেটওয়ার্ক

১৭ আগস্ট, ২০০৫। সারাদেশের সবগুলো জেলার গুরুত্বপূর্ণ সাড়ে চারশ জায়গায় একসঙ্গে প্রায় ৫০০ বোমার  বিস্ফোরণ ঘটিয়ে নিজেদের জঙ্গি কার্যক্রমের জানান দেয় জামায়াতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি)।

সেই বোমা হামলার একদশক পর জঙ্গিবাদ দমনে কতোটা সফল বাংলাদেশ? দেশ থেকে ‘জঙ্গিবাদ নির্মূল হয়েছে’ বলে যে দাবি, সেই কথার সত্যতা আসলে কতোটা? আজও কতোটা বিস্তৃত জঙ্গিবাদের জড়?

এসব প্রশ্নের উত্তর উঠে আসলো বিশেষজ্ঞদের কথা থেকে।

চ্যানেল আই অনলাইনকে তারা বলেছেন, জেএমবির শীর্ষ নেতৃত্বের ফাঁসি হলেও জঙ্গিবাদের কবল থেকে বাংলাদেশ মুক্ত পায়নি। দেশকে যতোই জঙ্গিবাদমুক্ত ঘোষণা করা হোক না কেনো, পরিস্থিতি কারোরই অজানা নয় বলেও মন্তব্য তাদের।

জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদ দমনে দীর্ঘদিন ধরে গবেষণার পাশাপাশি মাঠে সক্রিয় থেকে জনমত গঠন করা লেখক-সাংবাদিক শাহরিয়ার কবির বলেন, বিশ্বব্যাপী প্রভাব বিস্তারকারী জঙ্গি সংগঠনও আজ বাংলাদেশে নিজেদের ঘাঁটি তৈরি করেছে। বাংলাদেশ থেকে শুধু একজন, দুজন নয়; পুরো পরিবারও কখনো কখনো যোগ দিচ্ছে এসব জঙ্গি সংগঠনে। এমনকি দেশের বাইরে থাকা বাংলাদেশীরাও যোগ দিচ্ছে।

‘জঙ্গিরা বাংলাদেশে শুধু নিজেদের অবস্থান বিস্তৃত করার ঘোষণাই দিচ্ছে না, ঘোষণা অনুযায়ী কাজও করছে, বলে মন্তব্য করেন একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শাহরিয়ার কবির।

চ্যানেল আই অনলাইনকে একইরকম বললেন গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র ইমরান এইচ সরকার।

‘একজনকে হত্যায় যে আসামী আইনের আওতায় আসছে, সেই আবার কোনো না কোনোভাবে ছাড়া পেয়ে বের হয়ে এসে আরেকজনকে হত্যা করছে। এমন ঘটনা কিন্তু আমরা দেখলাম কিছুদিন আগেও। ব্লগার আসিফ মহিউদ্দীনকে হত্যাচেষ্টাকারী আটক ছিলো পুলিশের হাতে। জামিনে বেরিয়ে সেই আবার হত্যা করলো ব্লগার নিলয়কে।

এসবই তো জঙ্গিবাদের প্রকাশ, উল্লেখ করে তিনি বলেন: তা হলে নিশ্চয়ই বলা যায় না যে দেশ থেকে জঙ্গিবাদ নির্মূল হয়েছে।

অবশ্য কিছুটা ভিন্ন কথা বললেন বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজ (বিআইপিএসএস) প্রেসিডেন্ট মেজর জেনারেল (অব.) এ এন এম মুনীরুজ্জামান।

তিনি বলেন, ২০০৫ সালের সেই সিরিজ বোমা হামলার পর তৎকালীন সরকার এবং তার পরবর্তী সরকারের বেশ কিছু পদক্ষেপের কারণে জঙ্গিবাদ নিয়ন্ত্রণে এসেছিলো, নিয়ন্ত্রণ ছিলো বেশ কিছু বছর।

‘কিন্তু বিগত দু্ই বছর ধরে আবারো জঙ্গিবাদের বিস্তার দেখা যাচ্ছে, নতুন করে মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে জঙ্গিরা। তারা এখন ব্লগার হত্যা করছে লিস্ট তৈরি করে। শুধু বাংলাদেশেই নয়, দেশের বাইরেও এখন জঙ্গিদের কার্যক্রম দেখা যাচ্ছে। তৈরি করছে স্লিপার সেল,’ বলে চ্যানেল আই অনলাইনের কাছে মন্তব্য করেন তিনি।

তবে জঙ্গিবাদ দমনে বিএনপির অবস্থানের বিষয়ে জেনারেল মুনীরুজ্জামানের সঙ্গে একমত নন শাহরিয়ার কবির।

তিনি বলেন, জঙ্গিবাদীদের গডফাদার হচ্ছে জামায়াত ও বিএনপি। তারা ক্ষমতায় থেকে যেমন নাশকতা চালিয়েছে, তেমন ক্ষমতার বাইরে থেকেও তারা জঙ্গিবাদ অব্যাহত রেখেছে।

২০০৫ সালের সিরিজ বোমা হামলার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ওই সময়ের সরকার বা প্রশাসনের মদদ ছাড়া দেশব্যাপী এতো বড় নাশকতা চালানো কি কখনোই সম্ভব?

শাহরিয়ার কবির বলেন, জঙ্গিদের নাম হয়তো বদল হচ্ছে; কিন্তু শক্তি বা নেতৃত্বের কোনো বদল নেই। একই দল একই ভাবে তৈরি করছে আরেকটি জঙ্গিবাদী সংগঠন। প্রশাসনের রন্ধ্রে রন্ধ্রেও রয়েছে জঙ্গিবাদের পৃষ্ঠপোষকতা। ফলে আসামী ধরা পড়লেও ফাঁক গলে ঠিকই বেরিয়ে যাচ্ছে।

তা হলে কি বিচারহীনতাই মূল কারণ? তিনি বলেন, বিচার ব্যবস্থার কথা তো থাকবেই, সঙ্গে অসুস্থ রাজনৈতিক পরিস্থিতিও একটি কারণ।

তবে সাম্প্রতিক সময়ে জঙ্গিবাদ বিস্তারের অন্য একটি কারণও সামনে আনলেন জেনারেল মুনীরুজ্জামান। বললেন, সাম্প্রতিক সময়ে আইএস রেড লিস্টেড সংগঠন। তারা নিজেদের একটি আলাদা দেশ গঠনের কথাও বলছে। জঙ্গি একটি সংগঠনের এমন সব তৎপরতাই আবার নতুন করে প্রেরণা যোগাচ্ছে এসব জঙ্গি সংগঠনকেও।

আর বিচারহীনতা এবং অসুস্থ রাজনীতির যে কথা শাহরিয়ার কবির বলেছেন, তার প্রতিফলন দেখা গেলো ইমরান এইচ সরকারের বক্তব্যে।

‘শুধু ২০০৫ সালের সেই ভয়াবহ ঘটনাই নয়, রমনার বটমূলে হামলা বা ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা সবগুলোই কিন্তু জঙ্গিবাদকে প্রকাশ করে। সেসবের বিরুদ্ধে রাষ্ট্র যদি শক্ত অবস্থান নিতো তাহলে নিশ্চয়ই এখনো এমন জঙ্গিবাদের পুনরাবৃত্তি ঘটতো না,’ বলে মন্তব্য করেন তিনি।

ইমরান বলেন: জঙ্গিবাদ একটি রোগ। তার শেকড় অনেক গভীর পর্যন্ত ছড়ানো। এই সমস্যা সমাধানে তাই জিরো টলারেন্সের বিকল্প নেই।

‘জঙ্গিবাদের ব্যাপারে সরকারকে জিরো টলারেন্ট হতে হবে। জঙ্গি সমস্যার সমাধানে সরকার ও রাষ্ট্রের কোনো গাফিলতি থাকা চলবে না। কেউই যেন আইনের ফাঁক গলে বেরিয়ে যেতে না পারে সেদিকে নজর রাখাই হবে মূল লক্ষ্য। তা না হলে এই ইঁদুর-বিড়াল খেলা আজীবন চলতে থাকবে।’

পাশাপাশি আদর্শিক অবস্থানের কথা বললেন শাহরিয়ার কবির।

‘এসব জঙ্গিবাদের বিপরীত মানবিক আদর্শ সবার মনে বপন করতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের দর্শনের প্রতিফলন ঘটাতে হবে সবার মনে। আজও দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় সেভাবে মুক্তিযুদ্ধকে জানার সুযোগ নেই। বিশেষ করে ইংরেজি বা মাদ্রাসা শিক্ষায় সে সুযোগ একেবারেই শূন্য। এ অবস্থায় দেশের সকল মাদ্রাসাকে জাতীয়করণ করে নেওয়া, বিশেষ করে কওমী মাদ্রাসা যেগুলো জঙ্গিবাদের শিক্ষা প্রদান করে সেগুলোকে সরকারের আওতায় আনতে হবে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত পাঠ্যক্রম চালু করতে হবে। প্রণয়ন করতে হবে জঙ্গিবাদ বিনাশক এবং যুগোপযোগী শিক্ষানীতি, নারীনীতি।

পাশাপাশি সংবিধানে পরিবর্তন আনারও পরামর্শ দেন তিনি। চ্যানেল আই অনলাইনের সঙ্গে সাক্ষাতকারে সব‍ার আগে জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধ করার কথাও শাহরিয়ার কবির। বলেন তাদের অর্থায়নকারী প্রতিষ্ঠানকে নিয়ন্ত্রণ করার কথাও। ‘তাহলেই দেশ জঙ্গিবাদের তীব্র ছোবল থেকে রেহাই পাবে,’ বলে মন্তব্য তার।

আর এ এন এম মুনীরুজ্জামানের বক্তব্য: দেশে কৌশলগত নীতিমালা নেই। পুলিশি কর্মকাণ্ড দিয়ে জঙ্গিবাদ নির্মূল করা সম্ভব না, সেজন্য কৌশল দরকার।

তিনি বলেন: এসব বিষয়ে প্রশিক্ষিত বাহিনী বা ইউনিট রয়েছে তারা নিজেদের কাজ না করে অনেক সময় রাজনৈতিক সাফল্য অর্জনে বেশি মনোযোগ দিচ্ছে। এ সমস্যা সমাধানের পাশাপাশি জঙ্গিবাদ নিরসনে আঞ্চলিক সহযোগিতার হাতও আরও প্রসারিত করতে হবে।