৮ এপ্রিল ১৯৭১। রাতে ভালো ঘুম হয়নি। না হওয়ারই কথা। মসজিদের মাইকে আজানের শব্দ কানে এলো। আব্বার নড়াচড়ার শব্দ পেলাম। তিনি আমাদেরকে ডেকে তুলে দিলেন। চোখে বেশী করে পানি দিয়ে হাত মুখ ধুয়ে নিলাম। কে কোন কাপড় পরে বের হব, তা রাতেই ঠিক করা ছিলো, পরে নিলাম সেগুলো।
মার্চ মাসের প্রথম দিকেই আম্মাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল পরিস্থিতির ভয়াবহতা আঁচ করে। মিরপুরে রয়ে গিয়েছিলাম বাবা আর আমরা তিন ভাই। একটু গুছিয়ে নিয়ে আমরা চলে যাবো-এমনই পরিকল্পনা ছিল বাবার। কিন্ত ১ এপ্রিল তারিখেই ঘটে গেল সেই হৃদয়-বিদারক ঘটনা!
বস্তুত বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের পরপরই বাঙালির মধ্যে প্রতিরোধের প্রস্তুতি শুরু হয়ে যায়। ২৫ মার্চ কালরাত্রির সেই ভয়াল হত্যাযজ্ঞের পর আর কোনো পথ খোলা থাকে না। সবাই যার যার মত করে ভাবতে শুরু করে। আমার মেজ ভাই সেখ হাফিজুর রহমান (খোকন) মিরপুর ১০ নং সেকশনের আদর্শ উচ্চবিদ্যালয়ে দশম শ্রেণিতে পড়তো। সে ছিল খুব সুঠামদেহী, স্বাস্থ্য ও দৃঢ় মনোবলের অধিকারী। সেও অন্যসব তরুণ যুবকদের মতো কিছু একটা করার জন্য উদগ্রীব হয়ে পড়ে। ১৩ নং সেকশনের একেবারে পেছন দিকে একজন অবসরপ্রাপ্ত বাঙালি সৈনিক থাকতেন। দেশের অবস্থাদৃষ্টে তিনি এলাকার বাঙালি তরুণদেরকে রাইফেল চালনার প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু করেন। খুব সংগোপনে প্রতিদিন সন্ধার পর তার সংগৃহীত একটি পুরোনো রাইফেল দিয়ে এই প্রশিক্ষণ চালানো হতো। আমার মেজ ভাই খোকনও প্রতিদিন সেখানে যেতেন অস্ত্র চালনা শিখতে।
ব্যাপারটা স্থানীয় বিহারীরা জেনে যায়। একদিন রাতে দল বেঁধে তারা অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ঐ বাড়িটা ঘেরাও করে ফেলে। বাড়ির ভেতরের সব তরুণ-যুবককে তারা ধরে নিয়ে যায়। ঐ দলে আমার মেজ ভাই খোকনও ছিলেন। তারপর সবাইকে ধরে নিয়ে তারা ১৩ নং সেকশন ও ১০ নং সেকশনের মধ্যবর্তী জায়গায় যে বিদ্যুৎ বিভাগের অফিসটা ছিলো, যেটাকে সবাই ‘পাওয়ার হাউজ’ নামে চিনতো, সেখানে নিয়ে জবাই করে হত্যা করে এবং মৃতদেহগুলো সেখানে থাকা কুপের মধ্যে ফেলে দেয় (এখন যেখানটাতে মিরপুর জল্লাদখানা বধ্যভূমি স্মৃতিপিঠ গড়ে উঠেছে)। আচমকা এই মহাবিপর্যয় নেমে আসে আমাদের পরিবারে। তখন থেকেই মনে হচ্ছে আমরা যেন প্রতি মুহুর্তেই মৃত্যুদুতের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছি, যে কোনো সময়ই প্রাণ সংহার করবে। তখন থেকেই এক চিন্তা-কীভাবে বিহারীদের পাহারা ভেঙে এখান থেকে পালাবো। বিহারীরা এখানে বাঙালিদেরকে জিম্মি করে রেখেছে। পালাবদল করে পাহারা দিচ্ছে, যাতে কোনো বাঙালি এখান থেকে বেরিয়ে পড়তে না পারে।
বাইরে তখনো অন্ধকার, পুরোপুরি ফর্সা হয়নি। দরজায় টোকা পড়ল। আব্বা দরজা খুলে দিলেন। কালো বোরখা পরা এক মহিলা ত্বরিৎগতিতে ঘরে প্রবেশ করলো। হাতে ছোট একটা ব্যাগ। মুখের ঘোমটা তোলার পর দেখলাম, আমাদের ভাগ্নী জাকিয়া। আমাদের সাথে যোগ দিতে চলে এসেছে। আমাদেরই এক আত্মীয়। আব্বা গোপন পরিকল্পনার কথা তার বাবাকে জানাতেই তিনি বাবার হাত চেপে ধরে অনুনয় করেছেন, যেন তার মেয়েটাকে আমরা সাথে নিই। আব্বাও মানবিক কারণে সে অনুরোধ এড়াতে পারেননি।
একটু পরেই ঘরের বাইরে অটোরিক্সা জাতীয় কোন যানবাহন থামার শব্দ পেলাম। উঁকি দিয়ে দেখি একটা অটোরিক্সা ভ্যান দাঁড়ানো। আরে, এ তো সেই মেহমুদ এর চানাচুরের ভ্যানগাড়ী। ভ্যানের গায়ে চানাচুরের প্যাকেটের ছবি আর চানাচুর কোম্পানীর নাম বড় বড় অক্ষরে লেখা।
জাকিয়ার ছোট একটা ব্যাগ আর আমাদের তিনজনের জন্য একটা ব্যাগ সাথে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়লাম। আব্বা দরজায় ছোট একটা তালা লাগিয়ে দিলেন। বাইরে ভ্যানটার পাশে পায়চারি করছিলেন মেহমুদ। আমাদের দুই ভাইকে দেখে স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে মুচকি হেসে ভ্রু নাচালেন।
তিন চাকার অটো রিক্সাকে রি-মডেলিং করে কাভার্ড ভ্যান করা হয়েছে। ভ্যানের খোলের ভেতর জাকিয়াকে ঢুকানো হলো। সে জড়োসড়ো হয়ে এক কোণে উবু হয়ে বসলো। ব্যাগ দুটোও তার সাথে দেওয়া হলো। তারপর বাইরে থেকে দরজায় তালা লাগিয়ে দেওয়া হলো। অর্থাৎ বুঝানো হলো ভেতরে চানাচুরের প্যাকেট বহন করা হয়। দরজার ফাঁক ফোকর দিয়ে ভেতরে যতোটুকু বাতাস ঢুকবে তাতে হয়তো সে দম নিতে পারবে। তবে ভেতরে বন্ধ দরজায় আলো বাতাসহীন ঘুপচির মধ্যে বসে থাকাটা যে মারাত্মক কষ্টকর সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। ভ্যানের খোলের মধ্যে ঢুকানোর আগে তাকে ভালো করে শিখিয়ে পড়িয়ে দেওয়া হল যেন সে বেশি নড়াচড়া না করে। কোনো রকম শব্দ করা একেবারেই চলবে না, কাশি বা হাঁচি আসলে ভালো করে মুখের মধ্যে কাপড় দিয়ে নিতে হবে, যাতে টু শব্দও বাইরে না যায়।
আমাদের ভাগ্নি জাকিয়াকে এভাবে নেওয়া ছাড়া অন্য কোন উপায়ও ছিল না। পনেরো ষোলো বছরের এই তন্বী তরুণীকে পাক সেনাদের সামনে দিয়ে নিয়ে যাওয়ারে মতো ঝুঁকি নেওয়ার কোনো মানে হয় না। তাতে হয়ত মেয়েটিকে পাক সেনাদের হাতে তুলে দিতে হবে, আর আমাদের জীবনও বিপন্ন হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে। হয়তো বা এই নারীটিকে হস্তগত করতে গিয়ে আমাদের সবাইকেই নির্বিচারে গুলি করে মেরে ফেলবে।
অতঃপর মেহমুদ ড্রাইভারের আসনে বসলেন। তার ডান পাশে বসলাম আমি। বাম পাশে আব্বা বসলেন বাসার ভাইকে কোলে নিয়ে। ড্রাইভারের সীটের দুপাশে যেটুকু জায়গা থাকে তাতেই আমরা জড়োসড়ো হয়ে বসে পড়লাম।
মেহমুদ আমাদেরকে শিখিয়ে দিলেন, পথে পাকিস্তানী সেনা বা যে কেউ গাড়ি আটকালে আমরা তিনজন যেন কোন কথা না বলি, যা বলার সেই বলবে। তারপরেও যদি কিছু বলতে হয়, তাহলে উর্দুতে কি বলতে হবে তাও শিখিয়ে দিলেন, মিরপুরে থাকার কারণে আমরা কিছুটা উর্দু বলতে পারতাম।
আমাদের পরের গলিতে থাকতো বিহারী মেহমুদ। একটা চানাচুর কোম্পানীতে সাপ্লাই ভ্যান চালানোর কাজ করতো। বয়স ত্রিশ বত্রিশ হবে। কথাবার্তা খুব কম বলতো, অনেকটাই নিরীহ স্বভাবের। কখনো তাকে বিহারীদের সাথে দলাদলি করতে দেখিনি। তার বাসার পাশেই ছিল মুদির দোকানটা। আমরা দুই ভাই প্রতিদিনই সেখানে এক দুবার যেতাম চকলেট অথবা কাঁচের মার্বেল কিনতে। কোনো কোনো দিন শেষ বিকেলে দোকানটাতে গেলে মেহমুদকে দোকানটার পাশে সবুজ ঘাসের উপর একাকী বসে থাকতে দেখতাম। তখনও আমাদেরকে দেখলে মুচকি হাঁসি দিয়ে ভ্রু নাড়াত।
বেশি ভোরে বের হলে মানুষের সন্দেহ বাড়তো। অন্যান্য দিন মেহমুদ যে সময় গাড়ি নিয়ে বের হয় সেই সময় ধরেই গাড়ি ষ্টার্ট দিলো। দিনের আলো ফুটেছে, সূর্য সবে উঠতে শুরু করেছে। মনের মধ্যে একদিকে যেমন আতঙ্ক, উদ্বেগ, অন্যদিকে সম্ভাব্য মুক্তির আনন্দ।
কয়েক মিনিটের মধ্যে আমরা ১০ নং গোল চক্করে এসে পৌঁছলাম। এই জায়গাটাতে আমাদের বেশি ভয় ছিল। কারণ ১০ নং গোল চক্কর ও তার আশেপাশে বিহারীরা অলিখিত গোপন চেকপোষ্ট বসিয়েছিল, যাতে ১০ নং সেকশন বা ১১, ১২ নং সেকশনের বাঙালিরা বাক্স-পেটরা নিয়ে এই পথ দিয়ে পালিয়ে যেতে না পারে। পথের মধ্যে খুব বেশি লোকের দেখা মিলল না, বা যারা দেখেছেও খালি হাতে মেহমুদের পাশে বসে ভ্রমণ করার মধ্যে তারা হয়তো কোনো সন্দেহের গন্ধ খুঁজে পায়নি।
তাছাড়া মেহমুদের ব্যাপারে হয়তো তাদের কোনোরূপ সন্দেহ ছিল না। তখন রোকেয়া সরণি ছিলো না। গাড়ি ১০নং গোল চক্কর পার হয়ে ১ নং সেকশনের দিকে এগিয়ে চলল। আমাদের ভ্যানটা ১নং বাসষ্ট্যান্ডের কাছাকাছি আসতেই দৃশ্যপট পাল্টে গেল। রাস্তার ধারে ভারী অস্ত্রে সজ্জিত একদল পাকিস্তানী সেনা সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আছে। ইশারায় থামতে বললো। ভয়ে আমাদের বুক টিপ টিপ করতে শুরু করল। মেহমুদ চাচা গতি কমিয়ে ভ্যানটাকে এক পাশে নিয়ে দাঁড় করালো। একজন সেনা এগিয়ে এলো ভ্যানের কাছে। সে কোনো প্রশ্ন করার আগেই মেহমুদ উর্দুতে বলতে শুরু করলো- সে চানাচুর ফ্যাক্টরীর ভ্যান চালায়, শহরে কোম্পানীর চানাচুর সাপ্লাই দেয়। এখন সে ফ্যাক্টরীতে যাচ্ছে। আমরা তার আত্মীয়, তার বাসায় বেড়াতে এসেছিলাম। আমাদেরকে মোহাম্মদপুরে আমাদের বাসায় পৌঁছে দিয়ে সে ফ্যাক্টরীতে যাবে।
সিপাহী মেহমুদের উর্দূ কথা শুনেই ধরে নিলো যে, আরোহীরা সবাই বিহারী। অতএব এরা বাঙালী শত্রু নয়, এরা মিত্র। আমাদের দিকে একবার তির্যক দৃষ্টি নিক্ষেপ করে চলে যাওয়ার অনুমতি দিল।
ভ্যান এগিয়ে চলল। কিন্তু টেকনিক্যালে আসতেই পরিস্থিতি তার ভয়াবহ রূপ জানান দিল। রাস্তার দুই পাশে ৮/১০ হাত পর পর ভারী অস্ত্রশস্ত্র হাতে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আছে পাকিস্তানী সেনারা। কাঁধ থেকে বুকের উপর দিয়ে কোনাকুনি নেমে গেছে গুলির পাতা, সারা শরীরে অসংখ্য এটা সেটা ঝুলছে। মাথায় ভারী হেলমেট। একেবারে রণপ্রস্তুতি তাদের। রাস্তায় কোনো জনমানুষের চিহ্নমাত্র নেই। কোনো গাড়ি ঘোড়াও নেই। টেকনিক্যালে আসতেই এক সিপাহী রাস্তার সামনে এসে অস্ত্র উঁচিয়ে ভ্যান থামার নির্দেশ দিল। মেহমুদ গতি নিয়ন্ত্রণ করে সাইড করলো গাড়িটা। ভয়ে শরীর হিম হয়ে গেলো। সিপাহী এগিয়ে এসে পরিচয়, গন্তব্য ইত্যাকার প্রশ্ন শুরু করলো। মেহমুদের পরামর্শ মতো আব্বা মুখ খুললেন না। মনে হলো যেন মেহমুদও কিছুটা ঘাবড়ে গেছে। তবুও সে কাঁপা কাঁপা কিন্তু জোর গলায় উর্দুতে সেই একই কথা বলতে শুরু করলো। উর্দু ভাষা শুনেই যেন সিপাহীর মন একটু নরম হল। মেহমুদ চাচা গড়গড়িয়ে বলে গেল-সে চানাচুর ফ্যাক্টরীর গাড়ী চালায়, এখন সে ফ্যাক্টরীতে যাচ্ছে, পুরান ঢাকায়। আমরা তার আত্মীয়, তার বাসায় বেড়াতে গিয়েছিলাম, এখন ফিরে যাচ্ছি। সে আমাদেরকে মোহাম্মদপুরে পৌঁছে দিয়ে তার কাজে যাবে। সিপাহী তীর্যক দৃষ্টি ছড়িয়ে আমাদেরকে পরখ করল। শুশ্রুমণ্ডিত, মাথায় টুপি পরা আমাদের আব্বাকে দেখে হয়তো সে আশ্বস্ত হলো, এরা বিহারী এবং মুসলমান। অতএব শত্রুপক্ষ নয়। বুকের ভেতর বরফ জমছিল, যদি একবার কোনো সিপাহী ভ্যানের ভেতর সত্যি সত্যিই কি আছে তা পরীক্ষা করতে চায়, তবে আমাদের ভাগ্নির অবস্থা যে কি হতে পারে তা কল্পনাই করা বাহুল্য।
সিপাহী খানিকক্ষণ আপন মনে বিড় বিড় করে কি যেন বলল, তারপর বলল, ‘হুঁ, আগে বাড়ো’। হাতের ইশারা করলো চলে যেতে।
আমাদের ভ্যান কোনোরকম প্রতিবন্ধকতা ছাড়াই কল্যাণপুর অতঃপর শ্যামলী পার হয়ে এলো। দুই পাশে সশস্ত্র পাক সেনাদের সারি তেমনি এগিয়ে চলেছে। আসাদগেট (সে সময় ঐ জায়গার নাম ছিলো আইয়ুব গেট, সামরিক শাসক আইয়ুব খানের নামানুসারে) আসতেই আবার এক জোয়ান অস্ত্র উঁচিয়ে থামার নির্দেশ দিলো। মেহমুদ যথারীতি গাড়ী রাস্তার একপাশে থামালেন। সিপাহী পরিচয়, কোথায় যাওয়া হচ্ছে, ইত্যাদি জানতে চাইলেন। ভ্যানের ভিতর কি আছে জিজ্ঞেস করলে মেহমুদ চাচা বলল, ভ্যান খালী, সে পুরান ঢাকায় ফ্যাক্টরীতে যাচ্ছে চানাচুর আনতে। আমাদের সম্পর্কে একই ধরনের কথা বললো। পুরান ঢাকায় আমাদের বাসা, আমাদেরকে সেখানে পৌঁছে দেবে সে। এবারের সৈনিকটি বেশ রূক্ষ প্রকৃতির। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে আমাদেরকে দেখতে থাকলো। মেহমুদ এই সুযোগে আরো একটু আগ বাড়িয়ে বললো যে, টেকনিক্যালে যে সামরিক অফিসার ডিউটি করছে তার সাথেও তার কথা হয়েছে। এতে যেন সৈনিকটি একটু নরম হলো। খানিকক্ষণ চুপচাপ থেকে তারপর আমাদেরকে চলে যাওয়ার অনুমতি দিলো সৈনিকটি। সে যেভাবে অগ্রসর হচ্ছিল তাতে আমরা ভয় পেয়েই গিয়েছিলাম, না জানি সৈনিকটি ভ্যানের ভেতরটা দেখতে চায় কিনা! কিন্তু মেহমুদ খুব সুন্দর করে গুছিয়ে কথা বলে তাকে সন্তুষ্ট করতে পেরেছিল। আর মাথায় টুপি দেওয়া শ্মশ্রুমন্ডিত আব্বাকে দেখে হয়ত তাদের মধ্যে সন্দেহের উদ্রেক হয়নি।
এরপর আমাদের গাড়িটা গুলিস্তান এলাকা অতিক্রম করলো, আর কোনো বিপদ হলো না। ভীত, সম্ভ্রস্ত্র লোকজনের হালকা পাতলা চলাফেরা নজরে আসলো। পাকিস্তানী সেনারা জীপে করে টহল দিয়ে বেড়াচ্ছে।
যাত্রাবাড়ির কাছে এসে গাড়ির ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে গেলো। আমরা সবাই নেমে দাঁড়ালাম। মেহমুদ কিসব নাড়াচড়া করে আবার ইঞ্জিন স্টার্ট দিলো।
মাতুয়াইলের ভেতর দিয়ে এগুতে থাকলাম ডেমরার দিকে। মাতুয়াইল তখন পুরোপুরি গ্রাম। দুই পাশে গাছপালা, পুকুর, টিনের বাড়ি ঘর। আমাদের ভীতি এখন অনেকটা কমে গেছে, দুই পাশেই গ্রামীণ বাড়িঘর। ডেমরা চৌরাস্তায় এসে আমাদের ভ্যানটা ডানদিকে মোড় নিয়ে এগিয়ে চললো সারুলিয়ার দিকে। রাণীমহল সিনেমা হলটা পার হয়ে হাতের বাম দিকে একটা পেট্রোল পাম্প পড়লো। ভ্যানটা ঢুকে পড়লো সেখানে। এক পাশে গাড়িটা থামিয়ে মেহমুদ, বাবার কাছে গিয়ে বললো যে, সে আর সামনে যাবে না। যদিও তার আমাদেরকে আর অল্প দূরে শীতলক্ষ্যা নদীর ঘাট পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়ার কথা ছিলো। গাড়িতে তেল ভরে সে মিরপুরে ফিরে যাবে। চাবি নিয়ে ভ্যানের পেছনের দরজাটা খুলল মেহমুদ। আমরা সবাই ছুটে গেলাম। দেখলাম, আমাদের ভাগ্নি জাকিয়া বোরখা মুড়ি দিয়ে জুবুথুবু হয়ে বসে আছে। শুধু মুখটা খোলা। ঘর্মাক্ত সারা মুখ, চোখ দুটোয় আগুনের রঙ, বিপর্যস্ত চেহারা। বাবা আদর করে ডাকলেন, জাকিয়া, চলে এসো, আর ভয় নেই।
সে আতঙ্কিত চেহারা নিয়ে আমাদের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর সেখানেই সে ঢলে পড়ল। সবাই ধরাধরি করে তাকে বাইরে বের করে আনলাম। পেট্রোল পাম্পের একপাশে ছায়ার মধ্যে সবুজ ঘাসের উপর শুইয়ে দেওয়া হলো তাকে। পাম্পের কর্মচারীরা ছুটে এলো। চোখে মুখে পানি ছিটিয়ে দেয়া হলো। কেউ একজন তার মাথায়ও কিছুটা পানি দিলো। খানিক পর সে চোখ পিটপিট করে তাকালো। বুঝলাম তার জ্ঞান ফিরেছে। মনে হল এই দীর্ঘ পথ শক্ত হাতে সে নিজের প্রাণটা ধরে রেখেছিল। দাঁতে দাঁত চেপে হয়ত সে নিজেকে ঠিক রেখেছিল। কিন্তু যখন দেখল যে, ভয়ঙ্কর সে বিপদ শেষ, তখন বোধ হয় আর নিজের উপর নিয়ন্ত্রন রাখতে পারেনি।
তেল ভরা হয়ে গেলে গাড়িটা একপাশে রাখল মেহমুদ। বাবাকে জানাল, সে চলে যাবে। বাবা চুক্তিকৃত গাড়িভাড়া দুইশত টাকা তার হাতে দিলেন, সাথে আরও কুড়ি টাকা বখশিস।
মিরপুর থেকে এ পর্যন্ত আসার অটোরিক্সা ভাড়া ছিলো তখন সর্বোচ্চ ২০ টাকা। কিন্তু সে ২০০ টাকার চুক্তিতে আমাদেরকে এনেছিলো। বিপদজনক পথ, অনেক ঝুঁকিও ছিলো তার। নিরাপদে পালিয়ে আসাটাই আমাদের কাছে ছিলো সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ। সেই সাহায্যটাই করেছে মেহমুদ নামের এই বিহারী লোকটি। কঠিন বিপদের সময় সে আমাদের সবচাইতে বড় উপকারটি করেছে। আব্বা মেহমুদের হাত চেপে ধরে বললেন, মেহমুদ তুমি আমাদের অনেক উপকার করলে। আল্লাহ যেন তোমাকে ভালো রাখেন।
এক কিলোমিটারেরও বেশি পথ হেঁটে শীতলক্ষ্যা নদীর পাড়ে গিয়ে একটা নৌকায় উঠে নদী পার হয়ে কাঁচপুরে পৌঁছলাম। চৈত্রের রোদে পিঠ পুড়ে যাচ্ছে। ঢাকা চট্টগ্রাম মহাসড়কের এক পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি। প্রায় তিন কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে আমরা মদনপুর এসে পৌঁছলাম।
মদনপুর থেকে দিগন্ত বিস্তৃত মাঠের উপর দিয়ে কোনাকুনি হেটে চলে যাওয়া যায় আমাদের গ্রামে। মাঠে নেমে পড়লাম আমরা। আরো ৪/৫ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে হবে।
পথ যেন আর ফুরায় না। একসময় গ্রামের সীমানায় এসে পৌঁছলাম। গ্রামের কাছাকাছি আসার পর আব্বা দাঁড়িয়ে পড়লেন, ধরা গলায় বললেন, তোমাদের তিন ভাইকে দেখে রাখার দায়িত্ব দিয়ে এসেছিলো আমাকে, কিন্তু একজনকে চিরদিনের জন্য পেছনে ফেলে এলাম, তোমাদের মাকে আমি কী জবাব দেবো? তার কন্ঠ ভিজে এলো। বোধ করি কান্না আড়াল করার জন্য তিনি মুখ ঘুরালেন!
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।