একটি প্রশ্ন ইদানিং হরহামেশাই শোনা যায় যে, সরকার কারা চালাচ্ছে? রাজনীতিবিদরা নাকি আমলারা? করোনার অতিমারিজনিত কারণে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সরকারযন্ত্রে আমলাদের ভূমিকা আগের যেকোন সময়ের চেয়ে দৃশ্যমান হয়েছে। অফিস ব্যবস্থাপনার পাশাপাশি জনগণের কাছাকাছি যাওয়ার নতুন এক অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছেন আমলারা। এ ব্যাপারে মাঠ পর্যায়ের প্রশাসক বিশেষকরে ইউএনওদের আমলনামা খেয়াল করলে মোটামুটি একই রকম চিত্র পাওয়া যাবে। দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে জনগণের খুব কাছাকাছি যাওয়ায় জনগণের মধ্যে ইউএনওদের প্রভাব, গুরুত্ব ও জনপ্রিয়তার এক নতুন মাত্রা দেখেছে দেশবাসী।
একসময় উপজেলা পর্যায়ে ইউএনও অফিস সাধারণ মানুষের প্রবেশে কড়াকড়ি থাকায় প্রশাসনের ব্যক্তিবর্গের সাথে যোগাযোগ সহজসাধ্য ছিল না। যেকোন প্রয়োজনে সরকারী সাহায্য পেতে হলে স্থানীয় নির্বাচিত প্রতিনিধিই ছিলেন একমাত্র ভরসা। প্রশাসনের কর্মকর্তাদের প্রতি সাধারণ মানুষের এই দূরত্বের অন্যতম কারণ ছিল অজানা আতংক ও ভয়। কর্মকর্তারাও তাদের অফিস ছাড়া অন্য যেকোন সম্পর্ক ও যোগাযোগের প্রতি অনীহা থাকায় সাধারণ জনগণের সাথে দূরত্ব সৃষ্টি হয়।
মাঠপর্যায়ের প্রশাসনের সেই চিত্র এখন আর নেই। প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা এখন আতংকের মূর্ত প্রতিক নন, বরং তার বিপরীত। দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে বিভিন্ন পেশার মানুষের সাথে প্রশাসনের যোগাযোগ বৃদ্ধি পায়। জনগণের সাথে প্রশাসনের গড়ে উঠা এ সম্পর্কই এখন বাস্তবতা। তাছাড়া, সামাজিক যোগাযোগের বিভিন্ন মাধ্যমে ইউএনওসহ অন্যান্য সরকারি কর্মকর্তা যুক্ত থাকায় শিক্ষিত ও তরুণদের একটা বিরাট অংশের সাথে চমৎকার মিথষ্ক্রিয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়। কখনও কখনও এই সুযোগ ব্যক্তিগত সম্পর্ক স্থাপনেও ভূমিকা রাখে।
সবচেয়ে বড় কথা, উন্নত প্রশিক্ষণ এবং ভালো করার আকাঙ্ক্ষা যদি থাকে তাহলে যেকোন লেভেলে সফল হওয়া কঠিন নয়।
লম্বা ভূমিকা টানার কারণ আজ এমন একজন আমলার আমলনামা নিয়ে আলোচনা করব যিনি ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) হিসেবে একবছর আটমাস দায়িত্বপালন করে এখন বিদায়ী মূহুর্ত উপভোগ করছেন। তিনি যুক্তরাজ্যের একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চশিক্ষার নিমিত্তে প্রেষণে বদলি হয়েছেন। বদলির বিষয়টি প্রকাশ্য আলোচনায় আসে ফেসবুকে তার একটি স্ট্যাটাস দেওয়ার পর।
একজন ইউএনও কতটা জনপ্রিয় হতে পারেন তার ঝলমলে নজির ঈশ্বরগঞ্জের ইউএনও জাকির হোসেন। ২০১৯ সনের ১৯ ডিসেম্বর তিনি ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলা প্রশাসনের দায়িত্বে আসেন। তারপরের গল্প এখন ঈশ্বরগঞ্জের মানুষের মুখে মুখে।
সরকারি রুটিন দায়িত্বের পাশাপাশি উপজেলার বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের যেকোন অনুষ্ঠানে জাকির হোসেনের উৎসাহী উপস্থিতিই প্রমাণ দেয় তিনি কতটা উদার ও মিশুক প্রকৃতির মানুষ। কথাবার্তায় মার্জিত ও আচরণে অত্যন্ত ভদ্র এই মানুষটি মাত্র দু’বছরের কম সময়ে ঈশ্বরগঞ্জবাসীর মন জয় করে নেন। ঈশ্বরগঞ্জে সর্বস্তরের মানুষের ভালোবাসার অন্যতম কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হন ইউএনও জাকির হোসেন।
একজন সরকারি কর্মকর্তার প্রতি সাধারণ মানুষের এতটা আবেগ, এতটা ভালোবাসা নিঃসন্দেহে অভাবনীয়। ইউএনও জাকির হোসেনের বিদায় উপলক্ষে তাকে গত তিন/চারদিনে প্রায় পঁচিশটির মত বিদায়ী সংবর্ধনা নিতে হয়েছে। বাংলাদেশের আমলাতন্ত্রের ইতিহাসে এই দৃষ্টান্ত অভিনবও।
একটি কল্যাণকামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের পাশাপাশি আমলাদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সরকারের পলিসি বা সিদ্ধান্তসমূহের সফল বাস্তবায়নে আমলারাই মুখ্য ভূমিকা পালন করে। মাঠ পর্যায়ে যারা দায়িত্বপ্রাপ্ত হন অর্থাৎ ইউএনও হন, তাদের কর্ম-দক্ষতা, সততা ও আমজনতার সাথে মিলেমিশে কাজ করার মানসিকতাই একটি চৌকস ও স্মার্ট প্রশাসন গড়ে তুলতে পারে, যা রাষ্ট্রের আকাঙ্ক্ষারই প্রতিফলন।
ঈশ্বরগঞ্জের ইউএনও জাকির হোসেন এক্ষেত্রে মোটামুটি সফলই ছিলেন। তার মত চৌকস অফিসারের সংখ্যা যত বেশি হবে উন্নত বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা ততটাই বাস্তবিক হয়ে উঠবে। জাকির হোসেনের বদলিজনিত কারণে ঈশ্বরগঞ্জের মানুষের মনে আক্ষেপের যে চিত্র ফুটে উঠেছে, তা মূলতঃ একজন অফিসারের সফল আমলনামারই প্রতিফল।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)