অফস্টাম্পের বাইরে একলাইনে টানা বোলিং করে গেলেন। থাকল কার্যকরী স্লোয়ারের আধিক্য। কাটারও ছিল কিছু, তাতে এসেছে সাফল্যও। কিছু বল লাফিয়ে তুলে ব্যাটসম্যানদের বিপাকে ফেলেছেন। কিছু বল নিচু হয়েছে তার চাতুরিমাখা কব্জির মোচড়েই। তার বুদ্ধিদীপ্ত কৌশলের কারণে বারবার খাবি খেয়েছেন প্রতিপক্ষ ব্যাটসম্যানরা। বিভ্রান্ত হয়ে উইকেট দিতে বাধ্য হয়েছেন! কী দারুণ লাইন-লেংথ আর গতিবৈচিত্র!
অভিজ্ঞতা আর পেস বোলারসুলভ নান্দনিকতার এমনসব পসরা মেলে ধরেই রোববার মিরপুরে ডানা মেলেছেন ৩৫ বছর বয়সী মাশরাফী বিন মোর্ত্তজা। মাঠ তো বটেই, মাঠের বাইরের কারণেও যিনি সাম্প্রতিক সময়ে টক অব দ্য কান্ট্রি। তুমুল আলোচনা-সমালোচনার মাঝেই ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে সিরিজের প্রথম ওয়ানডেতে ১০ ওভারে ৩০ রান খরচায় ৩ উইকেট নিয়ে দলের সেরা পারফরম্যান্স লাল-সবুজ অধিনায়কের।
শের-ই-বাংলা স্টেডিয়ামে রোববার দেশের প্রথম ক্রিকেটার হিসেবে ২০০তম ওয়ানডে খেললেন মাশরাফী। অধিনায়ক যার মধ্যে লাল-সবুজের জার্সিতে খেলেছেন ১৯৮টি ওয়ানডে, এশিয়া একাদশের হয়ে বাকি দুটি।
আলোচনায় আছে এই সিরিজই দেশের মাটিতে মাশরাফীর শেষ ওয়ানডে সিরিজ। তিনি নিজেও বলেছেন আপাতত বিশ্বকাপ পর্যন্ত বিস্তৃত তার স্বপ্ন। বিশ্বকাপ ২০১৯-এর জুনে, ইংল্যান্ডে। তার আগে দেশের মাটিতে আর কোনো ওয়ানডে নেই টাইগারদের।
শেষের আগে শেষ বলে কিছু নেই মাশরাফীর জীবনে! কিন্তু রাজনীতিতে নাম লিখিয়ে ক্যারিয়ার অধ্যায়ের সমাপ্তি আলোচনার একটা ঝড়ই যেন তুলে দিয়েছেন মাশরাফী। ৩০ ডিসেম্বরের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নড়াইল-২ আসন হতে আওয়ামী লীগের টিকেটে লড়বেন। রাজনীতি যেহেতু অন্য বাক, নেই সব পক্ষের সমর্থপুষ্ট হওয়ার সুযোগ, তাই শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত নিজের বহুলত্যাগে অর্জিত ক্রিকেটীয় মসনদে উজ্জ্বল-অক্ষত থাকার চ্যালেঞ্চও নতুন করে।
দিনকে দিন যে মসনদটা মাশরাফী নিয়ে গেছেন অনন্য উচ্চতায়। পথটা ছিল দীর্ঘ। ২০০১ সালের ২৩ নভেম্বর চট্টগ্রামে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে অভিষেক। দীর্ঘ যাত্রায় খেলে ফেললেন ২০০টি ওয়ানডে। যাতে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ উইকেট শিকারিও (২৫৫টি) তিনি।
ক্যারিয়ারের পুরোটা সময়জুড়ে নির্বিঘ্ন থাকতে পারেননি। সময়ঘাতী হাঁটুর চোটকে জয় করে বারবার ফিরেছেন ময়দানে। ফর্মটা হারাননি কোনো বিরতিতেই। ২০১৫ সাল থেকে বাংলাদেশ ক্রিকেটের যে নবজাগরণ ও সোনালি অধ্যায়ের ঊর্ধ্বগামী যাত্রা বহমান, তাতে অধিনায়ক মাশরাফীর সামনে থেকে নেতৃত্বের ভূমিকা নিয়ে দিস্তার পর দিস্তা খরচ করে দেয়া যায়।
আর ব্যক্তিগত পারফরম্যান্স? চলতি বছরে আরও দুটি ওয়ানডেতে বোলিংয়ের সুযোগ পাবেন মাশরাফী। ২০১৮তে খেলেছেন ১৮টি ওয়ানডে। তাতে ২৩ উইকেট নিয়ে এবছর বিশ্বের টপস্কোরার বিশ বোলারের মধ্যে আছেন। দেশের বোলারদের মধ্যে আছেন দুইয়ে। সামনে কেবল ১৬ ওয়ানডেতে ২৭ উইকেট নেয়া মোস্তাফিজুর রহমান। অথচ স্পিনারদের কাঁধে ভর করে হাঁটার রেকর্ড বাংলাদেশের কম নয়। গতি হারিয়ে বসা বুড়ো হাড়ের মাশরাফীর ভেল্কি এখনও কতটা কার্যকর, সেটা এই পরিসংখ্যানই বলে দেয়।
ব্যক্তিগত পারফরম্যান্সের সাথে ২০১৮ সালটা দলগত ভাবেও দারুণ কেটেছে মাশরাফীর। এবছর এপর্যন্ত খেলা ১৭ ম্যাচের ১১টিতেই জয়ী দলটির নাম বাংলাদেশ। বাকিগুলো হার। আক্ষেপ অবশ্য আছে, বছরের শুরুতে ঘরের মাঠে ত্রিদেশীয় সিরিজের ফাইনালে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ট্রফি হাতছাড়ার পর এশিয়া কাপের শিরোপামঞ্চে ভারতের বিপক্ষে পাওয়া ক্ষতের দাগ এখনও দগদগে!
তবে তার কাছে ক্রিকেট তো জীবনের চেয়ে বড় কিছু নয়। সেই জীবনের নানা পরতের মতো ক্রিকেট মাঠের আক্ষেপও পেছনে ঠেলে দলকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন যথানিয়মেই। সঙ্গে নিজেকে প্রতিনিয়ত আরেকধাপ করে ওপরে তোলার ধ্যানে মগ্ন থেকেছেন। অল্পবিস্তর ছাড়া সেখানে ব্যর্থ হওয়ার পাল্লা ভারী নয় মোটেই।
ধারাবাহিকতার সেই রঙিন রেখাটাই আবারও টেনে আনলেন হোম অব ক্রিকেটে, রোববার উইন্ডিজের বিপক্ষে। মাশরাফী এদিন ১০ ওভারে যে ৬০টি ডেলিভারি ছুঁড়েছেন, তার ৪১টিই ছিল ডট বল। ৩০ রান দিয়ে ফিরিয়েছেন প্রতিপক্ষের টপ ও মিডলঅর্ডারের তিন ব্যাটসম্যানকে। তার দশ ওভারে বাউন্ডারি এসেছে মাত্র দুটি। প্রথম ওভারের প্রথম বলে একটি চার ও শেষ ওভারের শেষ বলে একটি ছক্কা। রান আটকে বোলিং করে হাঁসফাঁস করে তুলেছিলেন প্রতিপক্ষ ব্যাটসম্যানদের ২২ গজের জীবন।
আঁটসাঁট বোলিংয়ের শুরুটা করেছিলেন স্পিনাররা। পেসাররাও কম যাননি তার কল্যাণে। মোস্তাফিজও নিয়েছেন ৩ উইকেট, রুবেলের নামও আছে উইকেটের পাশে। মাশরাফী সেখানে যেনো এককাঠি সরেস! অধিনায়কের নিয়ন্ত্রিত বোলিংয়ে হাঁসফাঁস করতে থাকা ব্রাভোর মুক্তি মিলেছে! মাশরাফী পরে সাজঘরে পাঠিয়েছেন শাই হোপ ও রোভম্যান পাওয়েলকে।
মাশরাফীর অফস্টাম্পের বাইরে ফেলা বল উড়িয়ে মারতে গিয়েছিলেন ড্যারেন ব্রাভো। কিন্তু বলটা যে কাটার ছিল সেটি বুঝে ওঠার আগেই সর্বনাশ এ বাঁহাতির। আকাশে উঠে যাওয়ার সময় ক্যাচের জায়গা থেকে অনেকটা দূরেই ছিলেন তামিম। লং-অফ থেকে ছুট দিয়ে এক্সট্রা কাভারে এসে ডাইভ দিয়ে দর্শনীয় ক্যাচ নেন এ ওপেনার।
ব্রাভো ধুঁকে ধুকে ৫১ বলে ১৯ করে ফিরে যান। একবার মোস্তাফিজের বলে পয়েন্টে আরিফুলের হাতে, পরে রুবেলের বলে উইকেটের পেছনে মুশফিকের ঝাঁপিয়ে পড়া প্রচেষ্টা ব্যর্থ হলে জীবন পান ব্রাভো।
পরে ৫৯ বলে ৪৩ করে ভয়ঙ্কর হওয়ার আভাস দেয়া শাই হোপকে মিরাজের ক্যাচ বানান মাশরাফী। টাইগার অধিনায়ক ৭ ওভারে ১৪ রানে ২ উইকেট নিয়েছেন সেই স্পেলে। দ্বিতীয় স্পেল বোলিং করতে এসে নিজের শেষ ওভারটি করেছেন সবচেয়ে ব্যয়বহুল, দিয়েছেন ১১ রান, উইকেটও নিয়েছেন একটি।
গত জিম্বাবুয়ে সিরিজে সময়টা ভালো কাটেনি। দল ৩-০তে জেতার সিরিজে ম্যাশ ৩ ম্যাচে পেয়েছিলেন মাত্র ১ উইকেট, ইকোনমি ৬-এর কাছাকাছি। সমালোচনার ফিসফাস খানিক উচ্চকিত হচ্ছিল তাতে! এরমাঝেই রাজনীতিতে নাম লেখানোর খবরে তার দিকে ছুটে আসতে থাকে অপ্রিয় সব প্রশ্নও। যদিও সাধুবাদও কম পাননি। সেসব নিয়ে চাপে ছিলেন কিনা মুখে বলেননি, তবে চাপে যদি থেকেও থাকেন পারফরম্যান্স দিয়েই সেটা উতরে নিলেন।
এই উতরে যাওয়া মাশরাফী বিশ্বকাপ পর্যন্ত খেলবেন বলে আপাতত ঠিক করেছেন! ইংল্যান্ডের পিচে তাকে খুব করেই দরকার হবে বাংলাদেশের। ইংলিশ কন্ডিশন পেসারদের স্বর্গ বরাবরই। পেসারদের জিভে যদি জল আসার ব্যাপার থাকে, তাতে টাইগারদের মধ্যে এগিয়ে থাকার কথা মাশরাফীরই। নির্ভরতার অন্য নামই তো মাশরাফী। এই মাশরাফী, যিনি ২৬ রানে ৬ উইকেট নিয়ে কেনিয়াকে বেঁধে ফেলেছিলেন ১১৮ রানে, সেই কবে। আজ পর্যন্ত তো সেটিই বাংলাদেশিদের ওয়ানডে সেরা বোলিং ফিগার। দেশের সর্বোচ্চ ওয়ানডে শিকারির দখলে যা।
জাতীয় নির্বাচনে ৩০ ডিসেম্বর কী অপেক্ষা করছে মাশরাফীর জন্য সেটি এই মুহূর্তে বলে দেয়া সম্ভব নয়। মাশরাফীর নৌকা ভাসুক বা না-ভাসুক, সেটা মাঠের বাইরের ব্যাপার! রাজনীতিতে নাম লেখানোর পর থেকেই আতশ কাঁচের নিচে আছে মাশরাফীর প্রতিটি পদক্ষেপ। মাশরাফী নিজেও সেটা ভালো করেই জানেন। সেই চুলচেরা বিশ্লেষণের নিচে থেকেও যখন বোলিংয়ে লেটার মার্কস তুলে নিচ্ছেন অধিনায়ক, তখন আজ বাহবার তুড়ি ছুটুক তার এই কীর্তি নিয়েই।
আপাতত পারফরম্যান্স দিয়েই নিজের, প্রথম বাংলাদেশির ২০০তম ওয়ানডেকে স্মরণীয় করে রাখলেন। সামনে সিরিজ জয়ের মিশন। উইন্ডিজ সিরিজ ৩-০ করলে পারলে তো আরও ভালো। তারপর বিপিএল, তারপর নিউজিল্যান্ডে সিরিজ, তারপর আয়ারল্যান্ডে উইন্ডিজ ও স্বাগতিকদের নিয়ে ত্রিদেশীয় সিরিজ। যে পর্যন্ত আরও সব রসদ সঞ্চয় করে ক্যারিয়ারের শেষ বিশ্বকাপ। বাংলাদেশ ক্রিকেটের সোনালি এই প্রজন্মের অনেকেরই হয়ত শেষ বিশ্বকাপ! যেখানে মাশরাফী, মাশরাফীর দলের কাছে থাকবে দারুণকিছুর প্রত্যাশা।
সেই মাশরাফী, মাশরাফীর দল যখন দারুণ সব পারফরম্যান্স দিয়েই কীর্তির ভাণ্ডার সমৃদ্ধ করে চলেছেন, তখন আজকের দিনে গল্প হোক এই মাশরাফীকে নিয়েই। রাজনীতি জ্বলন্ত পরীক্ষার উনুন। নেই অবসরের সীমা, বাধ্যবাধকতাও! সেখানকার মাশরাফীকে বিচারের জন্য সময় তো তাই কম পড়ে থাকছে না!
কে না জানে, চিত্রা নদীর পাড় থেকে তুলে এনে সময়ই তো গড়েছে এই মাশরাফীকে!