একটি মেয়ে যখন বড় হতে শুরু করে, তখন তাকে সবচেয়ে অপরিচিত যে সমস্যাটির মুখোমুখি হতে হয়, তা হচ্ছে তার মাসিক স্রাব বা ঋতুস্রাব। আমার ছোটবেলার বন্ধু শীলা (ছদ্মনাম) যার মাত্র ১১ বছর বয়সেই ঋতুস্রাব শুরু হয়েছিল। মেয়েটি ওর কাপড়ে রক্ত দেখে আকাশ থেকে পড়েছিল এবং ভয়ে দৌঁড়ে গিয়ে ওর বাবাকে জানিয়েছিল। বাবা তাকে পরামর্শ দিয়েছিল এ ব্যাপারে তার মায়ের সাথে কথা বলতে। পরে ব্যাপারটি বুঝতে পেরে ও দারুণ লজ্জা পেয়েছিল।
শীলা ওর এই ‘অসুবিধার বা অসুখের’ বিষয়টি নিয়ে আমাদের সাথে কথা বলেছিল। এই গল্প শুনে তখন আমরাও খুব অবাক হয়েছিলাম। কারণ আমাদের কারো সাথে এই অতি জরুরি বিষয়টি নিয়ে কেউ কথা বলেনি, কোন ধারণা দেয়নি। শীলার কাছেই এই ‘আজব’ ব্যাপারটার কথা জানতে পেরে আমরা সবাই খুবই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিলাম। ছোট ছোট মানুষগুলোর মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়েছিল।
এখানেই শেষ নয়, পরের বছর যখন আমি নিজে এই পরিস্থিতির মুখে পড়লাম, তখনও আমি মাঠে-ঘাটে খেলে বেড়াই। একটি দুরন্ত কিশোরী মেয়ের জীবনে এরকম একটি সময় আসা মানে তার চলার গতি কিছু সময়ের জন্যে হলেও থমকে যাওয়া। আম্মা কঠিন স্বরে শুধু বলেছিল, খবরদার এই সময়ে মাঠে খেলতে যাবি না। হুট হাট এখানে সেখানে যাবি না। এইসময় মেয়েদের বাইরে বাইরে ঘুরে বেড়াতে হয় না। কেন যাবো না, গেলে ক্ষতি কী? এসব প্রশ্নের কোন উত্তরও পাইনি। আর তাই যখন আমার বন্ধু-বান্ধবীরা জানতে চাইতো, কেন আমি আজকে ওদের সাথে হাডুডু বা দাঁড়িয়াপাট্টি খেলছি না- আমি কোনো উত্তর দিতে পারতাম না। শুধু একা একা কাঁদতাম।
অথচ সেসময়েও আমাকে বা আমাদের কেউ বলেনি এটা মেয়েদের জীবনের খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। এটাকে আপাতত একটু ঝামেলা মনে হলেও এই মাসিক স্রাব যে মেয়েদের শরীরের জন্য খুব প্রয়োজনীয়, সেকথাও আমরা জানতাম না। মেয়েদের সুস্থ থাকার জন্যই শারীরিক এই প্রক্রিয়া জরুরি। সবচেয়ে বড় কথা নারীর মা হওয়ার জন্যও দরকার এই প্রক্রিয়া।
তখন গুগল ছিল না, ছিল সামাজিক ট্যাবু, মানুষ এত খোলামেলা ছিল না, ছিল অনেক গোপনীয়তা। আমরা জানতে পারিনি কেন আমাদের শরীরে এই পরিবর্তন এলো, কীভাবে এই সময়টা পার করতে হয়, এই সময়ের কতটা পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন থাকা উচিৎ, পরিচ্ছন্নতাটা কেমন হওয়া উচিৎ? বড়দের কাছ থেকে এমন একটা ধারণা দেয়া উচিৎ মেয়ে শিশুদের। ক্লাস সেভেনে ওঠার পর আমাদের গার্হস্থ্য বিজ্ঞান বইতে ঋতুস্রাব সম্পর্কিত একটি অধ্যায় থাকলেও আমাদের স্কুলে তা পড়ানো হয়নি। আমরা নিজেরাই নিজেদের মতো পড়ে নিয়েছিলাম। সেদিন ওই বই পড়ে কী বুঝেছিলাম, তা আজ মনে নেই।
সেসময় এবং আমার মনে হয় এখনও আমাদের দেশে অধিকাংশ পরিবারেই ঋতুস্রাব বিষয়টি নিয়ে শিশুদের বিশেষ করে কন্যা শিশুদের সাথে মা বা বাবা বা অন্য কোন অভিভাবক কোন আলোচনা করেন না। মেয়েরা এটা নিজেদের পরিচিত বা বন্ধু মহলে আলোচনা করে জানে। এই জানার মধ্যে ঠিক তথ্য থাকে, আবার ভুল তথ্যও থাকে। থাকে ভয়, লজ্জা এবং হাসাহাসি। কিন্তু যা সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন হলো পরিবার ও স্কুলের পক্ষ থেকে একটি মেয়েকে তার শরীরের এই অনিবার্য পরিবর্তন সম্পর্কে জানানো।
বয়:সন্ধিকালে মেয়েটিকে জানাতে হবে মাসিক বা ঋতুস্রাব কতো গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়, এটি কোন অসুখ বা ঝামেলা নয়। এই মাসিক হলে কী কী করণীয় এবং কী কী বর্জনীয় তা জানানো। মায়েদের অনেকেই মনে করেন না যে এই বিষয়টি নিয়ে বাচ্চাদের সাথে আলোচনার কোন প্রয়োজন আছে। বাচ্চা বড় হতে হতে ঠিকই জেনে যাবে একদিন। কিন্তু সেই ভাবা মতো কাজ হয় না। আমাদের কৈশোরে আমরা এই মাসিক হওয়ার সময়টাতে বেশ ভয়ের মধ্যেই থাকতাম। তটস্থ থাকতাম কেউ যেন আমাদের শারীরিক উপসর্গগুলো নিয়ে কোন প্রশ্ন না করে। কেমন যেন একটা অপরাধবোধ কাজ করতো। আমার যারা মেয়ে বন্ধু ও সহপাঠী ছিল তারা বিভিন্নজন বিভিন্ন মাধ্যমে এই ঋতুকালীন সময় সম্পর্কে তথ্য পেয়েছিলাম।
গ্রামে গিয়ে দেখেছি অবস্থা আরো গুরুতর। গ্রামে অধিকাংশ মেয়েকেই দেখেছি মাসিক নিয়ে কথাই বলতে চায় না। এটা নিয়ে কথা বলাটা শরমের বিষয় মনে করে। আর তাই মাসিককালীন সুবিধা-অসুবিধা নিয়ে কারো সাথে মত বিনিময়ও করেনা। অনেক কথাবার্তার পর হয়তো বলেছে মাসিককালীন সময়ে তাদের প্রচণ্ড মাথাব্যথা বা তলপেট ব্যথার কথা। কিন্তু এই সমস্যার কথা তারা কেউই তাদের অভিভাবকদের বলেনা। শত কষ্ট সত্ত্বেও হাসি মুখে স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করে। কারণ তারা মনে করে এটা তাদের মেয়েলি সমস্যা।
আমি শহরেও এমনটা হতে দেখেছি। আমাদের সমাজ একটি মেয়ের মনে এই ধারণা ছোটবেলা থেকেই ঢুকিয়ে দেয় যে মেয়েদের শারীরিক কোন সুবিধা-অসুবিধার কথা তাদের একান্ত। এইসব এমনই ‘মেয়েলি সমস্যা’ যা কারো সাথে আলোচনা করা উচিৎ নয়। অথচ মেয়েদের শরীরের অধিকাংশ ভালো থাকা, মন্দ থাকা তাদের এই ঋতুস্রাবের সঙ্গে জড়িত।
গ্রামে-গঞ্জে এমনকি শহরেও অধিকাংশ মেয়ে বা নারী এখনো স্যানিটারি ন্যাপকিন ও তুলার বদলে বহু ব্যবহৃত কাপড়ের টুকরা ব্যবহার করেন। এই ব্যবহৃত কাপড়গুলো কি দিয়ে ধোয়া হয়, কোথায় মেলে দিয়ে শুকানো হয়, তা একমাত্র সেই মেয়েগুলোই বলতে পারবে। কি যে অবর্ণনীয় দুর্ভোগ তাদের পোহাতে হয়, তা অকল্পনীয়। সাবানের অভাবে ছাই বা ছাই পানি দিয়ে ধোয়ার কথাও জেনেছি কল পাড় বা কুয়ার পাড়ে বা পুকুর পাড়ে অনেক মানুষের সামনে ধোয়া যায় না বলে তারা গোপনে খুব ভোরে বা সন্ধ্যায় গিয়ে নিজেদের পরিস্কার করে আসে। এরপর সংগ্রাম শুরু হয় সেই কাপড়ের টুকরোগুলো কোথায় শুকোতে দেবে।
এ প্রসঙ্গে বগুড়ার গ্রামাঞ্চলের একটি মেয়ে তার যে অভিজ্ঞতার কথা বলেছে, রাঙামাটি পার্বত্য এলাকার মেয়েও সেই একই কথা বলেছে। ঘরের পেছনে ময়লা স্যাঁতস্যাঁতে জায়গায়, লোকচক্ষুর অন্তরালে তারা এই কাপড়গুলো মেলে দেয় বা দিতে বাধ্য হয়। মেঘলা দিনে বা বৃষ্টি হলে তাদের খুবই অসুবিধা হয়। অনেকসময় তারা বাধ্য হয় ভেজা কাপড়ই ব্যবহার করতে। এই অতি সেনসেটিভ বিষয়টির হাইজিন বা পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা বিষয়ে অনেকেরই কোন ধারণা নেই। এই ভেজা বা স্যাঁতস্যাঁতে কাপড় ব্যবহার যে কতটা খারাপ ও অস্বাস্থ্যকর এ বিষয়ে এই বিষয়ে তাদের কোন ধারণা দেয়া হয় না।
দেখা গেছে এই সংক্রান্ত ধারণা মায়েদেরও নেই, মেয়েদেরও নেই। তারা মনে করে জীবনতো চলে যায়। পরিবারের পুরুষ সদস্যরা এই সংক্রান্ত জটিলতা বা গাইনি বিষয়ক সমস্যা নিয়ে বিন্দুমাত্র জানে না, জানলেও পাত্তা দেয় না। কারণ এটি একটি ‘মেয়েলি সমস্যা’। তাছাড়া ন্যাপকিন সবখানে পাওয়াও যায় না এবং দাম দিয়ে কেনাও হয় না। পরিবারের অন্য প্রয়োজন না মিটিয়ে স্যানিটারি ন্যাপকিন কেনাটা বাড়াবাড়িই মনে করে অনেক পরিবার।
শহরের অবস্থাও তথৈবচ। বিশেষ করে বস্তিবাসীদের বা ছোট ছোট বাসায় থাকা এবং কমন টয়লেট ব্যবহার করা বাড়িগুলোতে মেয়েদের যে কিসের মধ্য দিয়ে যেতে হয়, তা একমাত্র তারাই জানে। গ্রামেতো নূন্যতম কিছু খোলা জায়গা আছে, কিন্তু তাদেরতো সেটাও নেই। ব্যবহৃত কাপড়গুলো মেলে দেয়ার কোন জায়গাও থাকে না। এত ব্যক্তিগত একটি বিষয়ে তারা কারো সাথে শেয়ার করতে পারে না। কয়েকজনের সাথে কথা বলে জেনেছি দু:সহ একটি পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে তারা সপ্তাহের ওই কয়টা দিন পার করে। এই বিষয়ে কোন ধরণের শারীরিক সমস্যা হলে কোন ট্রিটমেন্ট নিতে যায় না। বড়জোড় কবিরাজী বা হেকিমী চিকিৎসা। অনেকে বুঝতেই পারে না তাদের এই গাইনি সমস্যার মূলে কী? শহরের কিছু কিছু বস্তিতে ইউনিসেফ-সরকারের সহয়তায় দোকানগুলোতে স্যানিটারি ন্যাপকিন রাখার ও এই বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টির পদক্ষেপ নিয়েছে। কিন্তু প্রয়োজনের তুলনায় তা অপ্রতুল।
শহরে যে মেয়েরা তুলা বা স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহার করে, তারাও অনেকে জানেনা কীভাবে এগুলোকে ফেলে দিতে হয় বা গার্বেজ করতে হয়। আর যে কারণে শহরের বহু জায়গার বিল্ডিং এর পাশে, বাসার সানসেটে, ওপেন ডাস্টবিনে আমরা দেখি ব্যবহৃত তুলা বা স্যানিটারি ন্যাপকিন পড়ে আছে। এমনকি মেয়েদের জন্য স্কুল, কলেজ এবং ইউনিভার্সিটিতেও এগুলো গার্বেজ করার কোনো উপায় নেই। এই বিষয়টি নিয়ে কেউ কিছু ভাবে না ।
অনেক জায়গায় মেয়েদের এইসময় ঘরের বাইরে যেতে দেয়া হয় না, কারো কারো স্কুল বন্ধ করে দেয়া হয়, ধর্মীয় কোন আয়োজনে অংশ নিতে দেয়া হয় না, আলাদা বিছানা দেয়া হয়। যারা বিবাহিত কারো কারো স্বামী এইসময় স্ত্রীর পাশে থাকে না। আবার মাসিক চলাকালীন সময়ে জোর করে সহবাসের ঘটনাও আছে। এমনকী শহরের শিক্ষিত পরিবারেও আছে।
‘মেন্সট্রুয়াল ট্যাবুস’ এবং ‘কালচার অ্যান্ড মেন্সট্রেশন’ শীর্ষক দুটি নিবন্ধে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে মেয়েদের মাসিক নিয়ে যা বলা হয়েছে, তা একেবারেই আমাদের পরিচিত ছবি। লেখা দুটিতে বলা হয়েছে অনেক দেশের অনেক এলাকাতেই এই মাসিক হওয়াটাকে অসুখ বলে মনে করে, স্বাভাবিক বায়োলজিক্যাল ব্যাপার নয়। এইসময়ে মেয়েদের উপর সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় বিধিনিষেধ চাপিয়ে দেয়া হয়। মেয়েদের টয়লেট ব্যবহার, গোসল করা এবং পুকুরে যাওয়াও বন্ধ করে দেয়া হয় অনেক জায়গায়।
এমনকি আমেরিকা ও যুক্তরাজ্যেও হোমলেস এবং শেলটারহোমে থাকা মেয়ে ও নারীরা এই সমস্যার মুখোমুখি হয়। তবে সেইসব দেশের সরকার ও কমিউনিটি বিষয়টির দিকে দৃষ্টি দেয়ার চেষ্টা করে।
২০১৮ সালে এসেও সারাবিশ্বের তিনজন নারীর মধ্যে একজন নারীর জন্য কোন ওয়ার্কিং টয়লেট নেই। মেন্সট্রুয়াল হাইজিন ম্যানেজমেন্ট ইস্যুটি বরাবরই ওয়াটার, স্যানিটেশন এবং হাইজিন এবং স্বাস্থ্য ও শিক্ষা কর্তৃপক্ষ কর্তৃক উপেক্ষিত থেকে গেছে। এই সময়টাতে মেয়েরা হাইজিন বা পরিচ্ছন্নতা পালন না করলে, প্রজনন স্বাস্থ্য সংক্রান্ত তাদের নানাধরণের সমস্যা হতে পারে এবং হয়। হতে পারে রিপ্রোডাকটিভ ট্র্যাক্ট ইনফেকশন, এটা এমনই ভয়াবহ যা নারীদের নিওনেটাল ইনফেকশনের জন্য দায়ী।
২০১২ সাল থেকে ২৮ মে তারিখটি বিশ্বব্যাপী পালিত হয়ে আসছে মেন্সট্রুয়াল হাইজিন ডে। মূলত মেয়েরা তাদের ঋতুকালীন সময়ে যেসব চ্যালেঞ্জ ও দু:সহ পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়, সেগুলোর প্রতি সচেতনতা বাড়ানো এবং সমাধান করার জন্যই এই দিনটি। আমরা আশা করবো বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার পাশাপাশি আমাদের সরকারও এই সমস্যা সমাধানে এগিয়ে আসবে। নারীর স্বাস্থ্য রক্ষা নারীর একার বিষয় নয়।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)