চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ

উন্নয়নের সুফল কি দেখছে না জনগণ!

মুক্তিযুদ্ধের চেতনা অর্থাৎ গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ এবং ধর্মনিরপেক্ষতার জন্য; একাত্তরের ঘাতকদের বিচার করার জন্য; আন্তর্জাতিক সাম্রাজ্যবাদের কড়াল গ্রাস থেকে দেশকে মুক্ত করার জন্য; নারী স্বাধীনতা বৃদ্ধির জন্য; অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জনের জন্য গত আট বছর আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যে অক্লান্ত সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন তার জন্য আওয়ামী লীগের প্রতি যে পরিমাণ জনসমর্থন সৃষ্টি হওয়ার কথা তা বাস্তবে দেখা যাচ্ছে না।

সাম্প্রতিক কয়েকটি নির্বাচনে- ঢাকা বার, সুপ্রিম কোর্ট বার এবং কুমিল্লা নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পরাজয় নির্দেশ করছে যে শেখ হাসিনা চলছেন একদিকে আর তাঁর দল চলছে উল্টো রথে। কি কি কারণে আওয়ামী লীগ ব্যাপক জনসমর্থন লাভ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে তা খতিয়ে দেখা শুধু দলটির জন্যই নয়, এদেশের প্রগতিশীলদের জন্যেও জরুরী।

যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায় দেয়া শুরু হলে ২০১৩ সালে হেফাজত,জামায়াত,বিএনপি এমন একটা পরিবেশ সৃষ্টি করেছিল যা থেকে ধর্মান্ধরা বুঝে নিয়েছে যে আওয়ামী লীগ হচ্ছে একটি ইসলাম বিরোধী রাজনৈতিক দল। তাদের মতে, আওয়ামী লীগ ধর্মীয় নেতাদের নামে মিথ্যা মামলা দিয়ে বিচারের নামে তাদের হত্যা করে দেশকে ইসলামী আলেম-ওলামা শূন্য করতে চায়। এরা নাস্তিকদের সমর্থন করে। এরা হিন্দুদের তথা পাকিস্তানের শত্রু ভারতের প্রতি সহানুভূতিশীল। এরা ইসলাম বিরোধী, ইসলামী রাষ্ট্র সৃষ্টির পথে অন্তরায়। জামায়াত ও বিএনপি’র প্রযোজনায় মতিঝিলে অনুষ্ঠিত হেফাজতের শো-ডাউনের পর রাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজত ওয়াশ আউট জঙ্গি এবং ধর্মান্ধদের মধ্যে আওয়ামী লীগের প্রতি বিরূপ ধারণা আরও বদ্ধমূল করেছে।

আওয়ামী লীগ জন্ম থেকে অসাম্প্রদায়িক এবং ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতি করে। এই দল কখনোই ধর্মান্ধ এবং ধর্ম ব্যবসায়ীদের ভোট পাবে না, এটা জানা কথা। ধর্ম ব্যবসায়ীরা আবার মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে ছিল অর্থাৎ পাকিস্তানের পক্ষে। পাকিস্তানের পক্ষে থাকা মানে সৌদি তথা আমেরিকার পক্ষে থাকা। একই কারণে অন্যান্য সাম্রাজ্যবাদী শক্তির সঙ্গে যুক্ত থাকা। অন্যান্য সাম্রাজ্যবাদী শক্তির মধ্যে রয়েছে তথাকথিত সুশীল সমাজ যারা প্রধানত মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করা পরিবারগুলো থেকে এসেছে; আরও আছে পথভ্রষ্ট সমাজতন্ত্রীরা। এদের ভোটও আওয়ামী লীগ পাবে না। এদের মোট সংখ্যা কোনভাবেই ত্রিশ শতাংশের বেশী নয়। আওয়ামী লীগকে এই ত্রিশ শতাংশ বাদ দিয়েই জনসমর্থন অর্জনের এবং নির্বাচনী কৌশল নির্ধারণ করতে হবে।

আওয়ামী লীগের রয়েছে নিজস্ব ভোট ব্যাংক যার সংখ্যা চল্লিশ শতাংশের কম নয়। এই ভোট ব্যাংকের মধ্যে একদিকে রয়েছে দরিদ্র এবং সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষ। অন্যদিকে রয়েছে সমাজের শিক্ষিত এবং প্রগতিশীল অংশ। আওয়ামী লীগ সরকার গ্রহিত অর্থনৈতিক কর্মসূচী সমূহের ফলে দরিদ্র এবং পিছিয়ে পড়া মানুষেরা উপকৃত হয়েছে, হচ্ছে। অসাম্প্রদায়িক অবস্থানের কারণে প্রগতিশীলেরাও আছে আওয়ামী লীগের সঙ্গে। আওয়ামী লীগের অসাম্প্রদায়িক এবং ধর্মনিরপেক্ষ অবস্থান নিয়ে প্রগতিশীলদের মধ্যে কিছু প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে বিশেষ করে ওলামা লীগের কর্মকাণ্ড এবং হেফাজতের দাবী অনুসারে পাঠ্যপুস্তকে পরিবর্তন আনায়।

ধর্ম ব্যবসায়ীদের ত্রিশ শতাংশ এবং আওয়ামী লীগের চল্লিশ শতাংশ ছাড়া আছে আরও এক বড় জনগোষ্ঠী যারা শিক্ষিত, সচ্ছ্বল এবং রাজনীতিকে ঘৃণা করেন। এরা মনে করেন রাজনীতি হচ্ছে সবচেয়ে খারাপ কাজ এর সঙ্গে নিজেকে না জড়ানোই ভাল। এরা ধর্ম ব্যবসায়ীদের দীর্ঘদিনের মিথ্যা প্রচারণায় বিভ্রান্ত। এরা আওয়ামী লীগ এবং বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে বেশ কিছু ভুল ধারণা পোষণ করেন। এরা ভাষা,সংস্কৃতি এবং মুক্তিযুদ্ধের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। এরা স্বাধীনতাকামী। এরা বাংলাদেশের যেকোন অর্জনে গৌরব বোধ করে। এরা নিজেদের আধুনিক এবং প্রগতিশীল হিসেবে ভাবতে পছন্দ করে। তবে প্রকৃত প্রগতিশীলতা কি জিনিস তা তারা বুঝতে পারে না। এদের উপর প্রকৃত প্রগতিশীল এবং স্বঘোষিত সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের কথাবার্তা  উভয়ই কাজ করে। ২০১৩ সালের গণজাগরণে এরা দলে দলে অংশ গ্রহণ করেছে। আবার বেগম জিয়া যখন শাহবাগের প্রতিবাদীদের “নাস্তিক” এবং “নষ্ট ছেলে” অভিদায় ভূষিত করেছিলেন তখন তারা শাহবাগ থেকে কেটে পড়েছে। এদেরকে মধ্যপন্থী বা সুইং ভোটার হিসেবে বিবেচনা করা যায়।

মধ্যপন্থীরা শিক্ষিত এবং স্বচ্ছল। সরকারী, বেসরকারী চাকুরী এবং ব্যবসা এদের জীবিকা। অর্থনৈতিক উন্নয়নের সবচেয়ে বড় সুবিধাভোগী হচ্ছে এই মধ্যপন্থীরা। এরা সমাজে শান্তি চায়, শৃঙ্খলা চায়; উন্নত দেশের নাগরিকদের মত জীবন যাপন করতে চায়। ঘুষ, দূর্নীতির বিরুদ্ধে এরা সব সময় কথা বলে এবং একই সঙ্গে নিজেরা দূর্নীতি চালিয়ে যায়। এদের নৈতিক ভীত দূর্বল। এরা প্রগতির পথে সমাজের পরিবর্তন চায় তবে সে পরিবর্তনের জন্য নিজে থেকে কোন উদ্যোগ গ্রহণ করে না। আরও বেশী জনসমর্থন অর্জন করার জন্য রাজনৈতিক কৌশল নির্ধারন করার ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগকে নিজের ভোট ব্যাংক অক্ষুন্ন রাখার পাশাপাশি এই মধ্যপন্থীদের কথাও  মাথায় রাখতে হবে। শুধু নিজস্ব ৪০% ভোটে জেতা যায় না; সুইং ভোটারদের ভোট পেতে হবে কমপক্ষে ১১%।

২০১৩ সালের গণজাগরণে অনেক সুশীলের মুখোশ খুলে পড়েছে; যুদ্ধাপরাধীদেরকে বিএনপি নেত্রী “রাজবন্ধী” অভিদায় ভূষিত করায় এবং মুজাহিদ, নিজামী, কাদের মোল্লা এবং সালাহ উদ্দিন কাদের চৌধুরী যুদ্ধাপরাধ করে নাই বলে সনদ দেয়ার পর থেকে অনেক মধ্যপন্থীর রাজনৈতিক বিভ্রান্তি কেটেছে। এদের বেশিরভাগের বিএনপি’র প্রতি মোহভঙ্গ হয়েছে। সরকার দলীয় নেতা কর্মীদের লুটপাটের রাজনীতি বিশেষ করে সরকারী ব্যাংকগুলো থেকে ঋণ গ্রহণ করে ফেরত না দেয়া, অতিরিক্ত ব্যয়ে সরকারী অবকাঠামো নির্মানের মাধ্যমে জনগণের টাকা আত্মসাৎ এবং ছাত্রলীগের কিছু অপকর্মের কারণে এরা এখনো আওয়ামী লীগ থেকে দূরে অবস্থান করছে। এদেরকে দলে টানতে হলে, আওয়ামী লীগের ভোট ব্যাংকে পরিণত করতে হলে আইনের শাসন এবং সামাজিক ও অর্থনৈতিক শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করতে হবে; শুধু উন্নয়ন দিয়ে হবে না।

২০০৯ সালে সরকার গঠনের পর থেকে সরকার চলেছে এক পথে আর সরকারের দল চলেছে ভিন্ন পথে। দলীয় নেতা-কর্মীদের মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব দিন দিন দলকে জনগণের কাছ থেকে দূরে নিয়ে গেছে। ক্ষমতার এই দ্বন্দ্ব প্রধানত দুই রকমেরঃ রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক। রাজনৈতিক ক্ষমতা প্রয়োগের মাধ্যমে অর্থনৈতিক কেন্দ্রগুলোর উপর নিয়ন্ত্রণ আরোপের দ্বন্দ্বই এখন প্রবল। সুস্থ রাজনৈতিক চর্চার মাধ্যমে নেতা হয়ে উঠার চেষ্টা প্রায় অনুপস্থিত।

কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিয়ে সাধারণভাবে বলা যায় আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা বিগত আট বছরে অর্থনৈতিক ধান্ধা ছাড়া আর কিছুই  করে নি। এ কাজ করতে গিয়ে তারা নিজেদের মধ্যে হানাহানি করেছে। এতে তারা স্থানীয় ভাবে ক্ষমতার রাজনীতিতে দূর্বল হয়ে পড়েছে। এই দূর্বলতা কাটাতে তারা জামায়াত-বিএনপি’র লোকদের সঙ্গে সরকারি সুবিধাদী ভাগ করে নিয়েছে। এ রকম শুনেছি যে ছাত্রলীগের ছেলেদের কাছ থেকে ঘুষ নেয়া যায় না বা কম নিতে হয় বলে অনেক আওয়ামী লীগ নেতা শিবিরের লোকদের কাছ থেকে বেশী ঘুষ নিয়ে সরকারি চাকুরি দিয়েছে, টেন্ডার পেতে সাহায্য করেছে কিংবা নিজের পাওয়া টেন্ডার জামায়াত-বিএনপি’র লোকদের কাছে বিক্রি করে  দিয়েছে। এসবের ফল হয়েছে এই যে জাতীয় পর্যায়ে আওয়ামী লীগের রাজনীতি যে অবস্থানেই  থাকুক না কেন স্থানীয় ভাবে তারা গণবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। আওয়ামী লীগের এইসব নেতা-কর্মীদের সাধারণ মানুষ ভাল চোখে দেখে না। এদের ভোট দেয়ার কথা ভাবে না।

দেশ থেকে মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী ধর্ম ব্যবসায়ী এবং সাম্রাজ্যবাদী শক্তিকে যথেষ্ট পরিমাণে দূর্বল করতে সক্ষম হয়েছে শেখ হাসিনার সরকার। তাঁর সরকারের অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রশংসা হচ্ছে দেশে-বিদেশে। বাংলাদেশকে এখন বলা হচ্ছে উন্নয়নের রোল মডেল। শেখ হাসিনা এবং তাঁর দল সরকারে থাকলে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে বাংলাদেশ পৌঁছাবে মধ্যম আয়ের দেশের কাতারে। অন্যথায় আবার দেশে ফিরে আসবে মধ্যযুগীয় বর্বরতা; দেশ চলবে পাকিস্তানপন্থীদের এবং সাম্রাজ্যবাদীদের স্বার্থের অনুকূলে; সামাজিক এবং অর্থনৈতিক প্রগতি থেমে যাবে।

এরকম পরিস্থিতিতে আগামী জাতীয় নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করা শুধু আওয়ামী লীগের জন্যই নয়, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশ নির্মানের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতির জন্য হাতে আছে আর মাত্র দেড় বছর সময়। এ সময়ের মধ্যে অনুষ্ঠিত হবে আরও কয়েকটি সিটি নির্বাচন। একেকটা সিটি নির্বাচন শেখ হাসিনা সরকারের এসিড টেস্ট হিসেবে বিবেচিত হবে। দল এবং দেশ থেকে রাজনৈতিক দূর্বৃত্তায়ণ  দূর করতে না পারলে, আইনের শাসন এবং সামাজিক ও অর্থনৈতিক শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করতে ব্যর্থ হলে, দলের ভেতর থেকে নেতা-কর্মীদের কোন্দল দূর করতে না পারলে, সর্বপরি দলের ভেতর থেকে আগামী দিনের জন্য উপযুক্ত নেতা তৈরী করতে না পারলে শেখ হাসিনার সকল অর্জন ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)