পবিত্র মক্কা থেকে মদিনা – পথের দু’পাশ
পবিত্র মক্কা থেকে মদিনা ৪৫০ কিলোমিটার পথ আমরা পাড়ি দিলাম মাত্র ৪.৩০ ঘণ্টায়। এর মাঝে পথে থেমে খেয়েছি। ৬ লেনের এই রাস্তা এতটাই ভাল যে ১২০ মাইল বেগে গাড়ি চলল কিন্তু আমরা টেরও পেলাম না। স্বভাব অনুযায়ী শুধু ভাবছিলাম এই রাস্তা আমার দেশে থাকলে আমি দেশের বাড়ি নীলফামারী যেতাম প্রতি সপ্তাহে।
সড়কের দুই পাশে ধূ ধূ মরুভূমি, পাথুরে পাহাড়, মাঝেমাঝে খেজুর গাছ, কিছু উট আর ভেড়া চড়ে বেড়াচ্ছে। অনেক কাজ চলছে সারাটা পথ জুড়েই। গরমও সেইরকম ৩৯ ডিগ্রি। আশেপাশে কোন গাছ না থাকাতে চোখ ঝলসানো রোদ। বারবার মনে হচ্ছিল এই ঝলসানো তাপের নীচে দাঁড়িয়ে যে মানুষগুলো কাজ করছেন, এনাদের অনেকেই আমাদেরই ভাই, স্বজন, অভিবাসী শ্রমিক। আমাদের দেশের অর্থনীতির চাকা এনাদের উপার্জিত টাকায় চলছে।
পথের দু’পাশ দেখতে দেখতে আরো মনে হলো ১৪০০ বছর আগে এই মরু এলাকা দিয়ে উটে চড়ে নবীজি কত কষ্ট করে, এতটা পথ পাড়ি দিয়ে মক্কা থেকে মদিনায় হিযরত বা অভিবাসন করেছেন, এই সময়ে এসে, আমরা তা ভাবতেও পারছি না। এই আরাম গাড়িতে বসেও ঘেমে যাচ্ছি, বারবার পানি খাচ্ছি।
বেদুইনদের সেই আরব এখন অন্য আরব। সবকিছু ঝকঝক করছে। পাথরের পাহাড় কেটে উন্নয়ন কাজ চলছে। বাস গাড়ি সব একেবারে লেটেস্ট মডেলের। তবে গাছ গাছালির অভাব প্রকট। গাড়ি-বাড়ি ঝকঝকে হলেও দেখলাম এখনও অনেক বাড়ি ঘরে সেই পুরোনো আমলের উইন্ডো এসি। আমাদের বর্মি চালক জানাল, এদেশে কোরিয়ান গাড়ির বাজার রমরমা। টাকার জোরে এরা যদি কিছু গাছ লাগিয়ে ফেলতে পারে, তাহলে হয়তো মরু এলাকার ছবিই পালটে যাবে। সাগরের পানি পরিশোধন করে পানির অভাব ঘুচিয়েছে, এখন বাকি রইল শুধু গাছ।
ইসলামের প্রথম পথচলা শুরু হয়, এই পবিত্র মদিনা থেকেই
পবিত্র মক্কার তুলনায় মদীনা অনেকটাই সবুজ। মনুষ্য তৈরি ঝর্ণা ও আরবিতে লেখা দেয়াল লিখন চোখে পড়ল। প্রচুর কবুতর এবং খুব ছোট কতগুলো পাখি। জানি না ইতিহাসের সেই আবাবিল পাখি কিনা।
দেখলাম মক্কা-মদিনা-জেদ্দা কোথাও ইংলিশ বা আরবি বলতে হচ্ছে না। শুধু বাংলা জানলেই চলছে। কিছু ভাঙা ভাঙা উর্দু বা হিন্দি। ব্যাপক আনন্দ লাগল। হোটেলে নেমেও পেলাম বহু বাংলাদেশি মানুষ। এখানে বাংলাদেশিদের একটা বাজারও আছে। আমরা হেঁটে রওজার পাশে একটা রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় দেখলাম, একটা বড় লরি এসে মার্কেটের সামনের জায়গায় পার্কিং করছে। হঠাৎ শুনলাম একজন চেঁচিয়ে লরির চালককে বলছেন, ‘ওই ফিরোজ, কিরে এইখানে গাড়িটারে দাঁড় করাইলি ক্যান? তরে না কইলাম আরো পিছাইয়া রাখ। এত বছর ধইরা কাজ করস, তাও কইতে হয় ক্যান?’ হঠাৎ মনে হলো আমরা কোথায় দাঁড়িয়ে আছি, সায়েদাবাদে নয়তো? তবে মজাই পেলাম ব্যাপারটাতে।
নবীজির রওজা
নবীজির রওজা শরীফ, মসজিদুল নববীর ভেতর এর অবস্থান। মসজিদের দক্ষিণ-পূর্ব কোণে গাঢ় সবুজ গম্বুজের নীচে নবীজির রওজাটি ঠিক যেখানে অবস্থিত, সেখানেই বাসা ছিল বিবি আয়েশার, নবীজির স্ত্রী। বিবি আয়েশাকে বলা হতো ‘বিশ্বাসীদের মা’। রাসুলের সমাহিত হওয়ার স্থানে যেতে হলে বহুদূর হেঁটে ২৬ নাম্বার গেট দিয়ে ঢুকতে হবে।
এই মসজিদের কাছেই ছিল নবী করিম (সা.) এর বাসা। তিনি ৬২২ খৃষ্টাব্দে এই মসজিদের গোড়াপত্তন করেন। এটি ইসলামের তৃতীয় মসজিদ। তিনি নিজে এর নির্মাণে হাত লাগিয়েছিলেন। এটি প্রথম দিকে ছিল ওপেন এয়ার বা খোলা ভবন। ব্যবহৃত হতো কমিউনিটি সেন্টার, কোর্ট ও ধর্মীয় স্কুল হিসেবে।
পরে বিভিন্ন রাজা-বাদশাহ এর উন্নয়নে কাজ করলেও অটোম্যান শাসকরা ১৮১৮-তে এসে কাজ শেষ করেন। গম্বুজটি সবুজ করা হয় ১৮৩৭ সালে। আরবীয় পেনিনসুলার মধ্যে এখানেই প্রথম বিদ্যুৎ আসে ১৯০৯ সালে, খুব বেশিদিন কিন্তু নয়, মাত্র ১০৯ বছর আগে।
স্রোতের মতো মানুষ আসছে
বিশাল এলাকা নিয়ে মসজিদুল নববীর অবস্থান। এখানেও আজানের সাথে সাথে জামাত শুরু হয়ে যায়। আজানের আগে থেকেই মানুষ এসে ভীড় জমাতে থাকে। কাজেই জায়গা পেতে হলে বেশ আগেই মসজিদে যেতে হবে।
মসজিদুল নববীর আশেপাশে অনেক পুরনো ও বড় বড় মার্কেট এবং অনেক হোটেল আছে। আশেপাশের সব দোকানগুলো দেখলাম আজানের সাথে সাথে বিক্রিবাট্টা বন্ধ করে নামাজের জন্য তৈরি হয়ে গেল এবং দোকান ফাঁকা রেখেই নামাজে চলে গেল।
এই মসজিদে শায়িত আছেন নবী করিম হযরত মুহাম্মদ (স:), হযরত আবু বকর (রা:) ও হযরত ওমর (রা:)।
মেয়েদের প্রবেশের সুবিধার্থে নবীজির রওজা জিয়ারত করার ৩টা সময় বেঁধে দিলেও ভিড়ের কোন কমতি দেখলাম না। ভোর ৫টায় যত মানুষ, রাত ১১টায় গিয়ে দেখি ততোধিক মানুষ। অবাক কাণ্ড। আমার মতো লোকের জন্য খুব কঠিন এই ভীড় ঠেলে হাঁটা। অবশ্য যারা খুব হাঁটতে পারেন, তাদের জন্য প্রবেশ করা সহজতর। মাঝেমাঝে এত মানুষের ভীড় থাকে যে নিজের হাতে আর চলার গতি থাকে না। ভাসতে ভাসতে চলতে হয়। আগে থেকে ধারণা নিয়ে না গেলে ওনার রওজার কাছে গিয়ে প্রচণ্ড চাপে ঠাওর করা মুশকিল ঠিক কোনখানে উনি শায়িত আছেন।
চারিদিকে প্রচুর পানি আর বাতাসের ব্যবস্থা আছে। আছে হুইল চেয়ার এবং বসার চেয়ার। মূল রওজায় স্যান্ডেল নিয়ে প্রবেশ করা যায় না বলে সেটা রাখার জায়গাও আছে। তবে সাবধান, ভীড়ে স্যান্ডেল হারিয়ে যাওয়া বা ওলট-পালট হওয়ার ঘটনা ঘটে।
যথারীতি বহু মানুষ বসে আছে। দোয়া পড়ছে, নামাজ পড়ছে এমনকি খাওয়া দাওয়াও করছে। একবার প্রবেশ করলে কেউ আর বের হতে চায় না। কারণ থাকার জায়গা দূরে হলে আসা যাওয়া করা বেশ কঠিন। প্রখর রোদে হাঁটা ছাড়া উপায় নাই।
তবে সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং হলো পবিত্রতম জায়গা বা বেহেশতের অংশ বলে পরিচিত রিয়াজুল জান্নাহ পৌঁছানো। ওখানে উপস্থিত হওয়ার জন্যই এতকিছু, এত হুড়োহুড়ি।
আর আছে জান্নাতুল বাকি, যেখানে শায়িত আছেন নবীজির সাহাবা ও পরিবারের সদস্যরা।
জেরুজালেম থেকে পবিত্র মক্কা
মসজিদ-ই-কেবলাতাইনকে অনেকে বলেন দুই কেবলা মসজিদ। নবী করিম (স:) এখানে প্রার্থনারত অবস্থায় ওহী বা বার্তা পান যে এখন থেকে জেরুজালেমের আকসা মসজিদের দিকে না ফিরে, মক্কার কেবলামুখী হয়ে সেজদা দিতে হবে মুসলমানদের। এর আগে মুসলমানরা মসজিদুল আকসা অভিমুখে সেজদা দিতেন। এখান থেকেই ইসলামের নতুন যাত্রা শুরু হয়।
নবীজি যে মসজিদের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন
ইসলামের ইতিহাসে পুরনোতম মসজিদগুলোর মধ্যে কুবা অন্যতম। এটিই সবচেয়ে পুরোনো কিনা এ নিয়ে আলোচনা থাকলেও, এ কথা বলা যায়, নবীজির ইসলাম প্রচারের জীবনীকালে কুবা মসজিদই পুরোনো। কারণ নবীজি মদীনায় হিজরত করার পর এখানেই ১৪ দিন অপেক্ষা করেছিলেন হযরত আলী (রা:) ও অন্যান্য সাহাবীদের জন্য। এই মসজিদের প্রথম ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন নবীজি স্বয়ং।
নবীজি এখানে নামাজ আদায় করতেন প্রতি শনিবার। উনি বাহনে চড়ে এবং পায়ে হেঁটেও এখানে আসতেন। নবীজি বলেছেন, যারা বাসা থেকে ওজু করে এখানে দুই রাকাত নফল নামাজ আদায় করবে, তাদের জন্য রয়েছে একটি ওমরাহ করার পুরস্কার।
সপ্তম শতকে এর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হলেও, বিংশ শতাব্দীতে এসে এর আধুনিকায়নের কাজ শেষ হয়েছে। পুরনো মসজিদের মূল নকশা রাখার চেষ্টা করা হলেও পরে তা হয়নি। অনেক বড় এই মসজিদে আছে ৬টি গম্বুজ এবং ৪টি সুউচ্চ মিনার। মসজিদ সংলগ্ন লাইব্রেরি, দোকানপাট, আবাসিক এলাকা সবই আছে। এই মসজিদে নারী-পুরুষ আলাদা নামাজের জায়গা।
ঈদ মসজিদ বলে যা পরিচিত
মসজিদ-ই-গামামাহ নামটাই একটু অন্যরকম। গামামাহ মানে মেঘ। একে ঈদ মসজিদও বলা হয়, কারণ মসজিদুল নববীর কাছে অবস্থিত বলে নবীজি তাঁর জীবনের শেষ কয়েকটি ঈদের জামাত এখানেই পড়েছেন। আবার অনেকে বলেন, নবীজি ৬৩১ খৃষ্টাব্দে একবারই এখানে ঈদের জামাত পড়েছিলেন।
কেউ কেউ একে মেঘ মসজিদ বলেও চেনে। বলা হয়, নবীজি এখানে নামাজ পড়ার সময় এক টুকরো মেঘ এসে তাঁকে ছায়া দান করত। আরো বলা হয়, নবীজি এখানে বৃষ্টির জন্য নামাজ আদায় করার পর কালো মেঘ ভেসে আসে এবং মদীনায় বৃষ্টি হয়। যা হোক, তবে মসজিদুল নববী কাছে বলে এই মসজিদে এখন আর ওয়াক্তের নামাজ হয় না।
ওহুদের যুদ্ধক্ষেত্র
বদরের যুদ্ধে পরাজিত হওয়ার পর মক্কার কোরায়েশরা বহু সৈন্য সামন্ত নিয়ে যুদ্ধ করার জন্য ওহুদ পর্বতের উপত্যকায় সমবেত হয়। ওহুদের যুদ্ধে মুসলমানদের কিছু ক্ষয়ক্ষতি হলেও, এ যুদ্ধে মুসলমানরাই জয়ী হয়েছিল। এখানে প্রায় ৫০০ সাহাবীর কবর আছে। ওহুদ নামের ওই লাল পাহাড়ের ওপর যুদ্ধটা হয়েছিল। এই যুদ্ধে নবীজির দাঁত ভেঙে গিয়েছিল বলে জানা যায়। মদিনায় কবর মানে আমাদের দেশের মতো বাঁধানো কোন ক্ষেত্র নয়, শুধু মাটির উপর এক টুকরো পাথর দেয়া। যুদ্ধক্ষেত্রের পাশেই রয়েছে মসজিদ। বহু মানুষ এই যুদ্ধক্ষেত্র দেখতে আসছে। ছোটবেলায় পড়া এই যুদ্ধক্ষেত্র দেখে বেশ অন্যরকম একটা অনুভূতি হলো।
নবীজির প্রথম জুম্মার নামাজ
কোন এক শুক্রবারে কুবা মসজিদ ত্যাগ করে নবীজি প্রায় আড়াই কিলোমিটার দূরে মসজিদুল নববীতে যাওয়ার পথে বানু সালিম বিন আউফ গ্রাম অতিক্রম করার সময় সেখানকার অধিবাসীরা হযরত মুহাম্মদ (স:)-কে এখানে থেকে যেতে অনুরোধ করেন। উনি তাঁদের অনুরোধের প্রতি সম্মান জানিয়ে এখানে প্রথম জুম্মার নামাজ আদায় করেন। সেই থেকে এই মসজিদ হয়ে যায় মসজিদ জুম্মা।
তুর্কী নির্মাণশৈলী
পবিত্র মক্কা ও মদীনাকে সাজানোর পেছনে মুসলিম অটোম্যান শাসকদের অনেক বড় ভূমিকা আছে। তারা নিজেদের ‘মক্কা ও মদীনা দুই পবিত্র নগরীর ভৃত্য’ বলে মনে করতেন। হজে আসার সময় অটোম্যান শাসক এবং তুরস্কের সাধারণ মানুষের দেয়া অনেক উপঢৌকন হাজিরা সাথে নিয়ে আসতেন মক্কা ও মদীনাবাসীর জন্য। কারণ মক্কা ও মদীনা সে সময় এরকম প্রাচুর্য্যে ভরা ছিল না। তাই এখনো তুর্কিদের আমলে তৈরি অনেক দালান কাঠামো চোখে পড়ে।
খাবার দাবার
মক্কা মদীনা দুই জায়গাতেই সবচেয়ে মজা লেগেছে লাবাং খেতে। আমাদের দেশে যে লাবাং পাওয়া যায়, তার সাথে এর স্বাদে ও মানে ফারাক বিস্তর। এছাড়া মদীনার দোকানগুলোতে বেশ ভাল ফল পাওয়া যায়। পাওয়া যায় বিভিন্ন ধরণের মজাদার রুটি। এখানেও পাকিস্তানি ও ভারতীয় হোটেলের খাবার বেশ তেল ও মশলাযুক্ত। তাই আমরা এগুলোকে এড়িয়ে চলেছি। টার্কিশ সোয়ারমা, পিজা, বার্গার, দুধ, রুটি ও কলা খাওয়াই ভাল মনে হয়েছে। খেজুর কেনার জন্য মদীনাই উত্তম।
আরো যা কিছু
মদীনাতে অনেক মসজিদ আছে। অনেক মসজিদের সাথেই নবী করিম (স:) এর ইতিহাস বা জীবন জড়িয়ে আছে। তবে সময় পেলে মদীনা যাদুঘরটা একবার দেখে নেয়া যেতে পারে। মদীনাতে আছে বেশ বড় বড় কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। যেমন, ইসলামিক ইউনির্ভাসিটি অব মদীনা, তাইয়েবা ইউনিভার্সিটি, মদীনা কলেজ অব টেকনোলজি। আমাদের মরক্কান চালক লাল টি-শার্ট ও তালি দেয়া জিনস পরে কফির মগে চুমুক দিতে দিতে আমাদের এই এলাকাগুলো ঘুরিয়ে নিয়ে এলো।
আগের পর্ব পড়ুন: ইসলামের ইতিহাসের পথ ধরে মক্কা
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)