মানুষের সবচেয়ে বড় পরিচয়, সে আল্লাহর বান্দা। স্রষ্টা আপন অনিঃশেষ প্রেম-ভালোবাসার রসে ভিজিয়ে অত্যন্ত সুনিপুণভাবে মানুষের সৃষ্টিকর্ম সম্পাদন করেছেন। তাঁরই সুন্দরতম সৃষ্টিস্বরূপ মানুষের গুরুদায়িত্ব হলো– মহান কারিগরের প্রতি আজীবন নির্ভেজাল কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে যাওয়া। কী উপায়ে সম্ভব হবে সেই কৃতজ্ঞতা-প্রকাশ, ইবাদতের কথা বলে আমাদের বাতলে দিয়েছেন সেই নিরাকার স্রষ্টাই। একজন কৃতজ্ঞ বান্দা মাত্রই আল্লাহর ইবাদতকারী হবে।
এসেছে তাঁরই পাক কালামে: ‘আমি মানুষ এবং জিনকে সৃষ্টি করেছি, যেন তারা শুধু আমারই ইবাদত করে।’ (সুরা : জারিয়াত, আয়াত : ৫৬)। ইবাদত কি কেবল নামাজ, রোজা, হজ্জ, যাকাত, দান-সদকায় সীমাবদ্ধ? না। ইবাদতের ময়দান অনেক বিস্তৃত। যা সীমিত করা যায় না। বলা হয়ে থাকে, স্রষ্টার নির্দেশ পালন ও নিষেধাজ্ঞা মান্যই ইবাদত।
মানুষ যখনই স্রষ্টার আদেশ নিষেধে পাবন্দ থাকে, তখনই সে তার প্রভুর ইবাদতকারী। এভাবে ইবাদত করতে করতে ব্যয় হতে পারে, তার প্রতিটি শ্বাস-প্রশ্বাস। যে কারণে ঐশীগ্রন্থ আল কুরআনে সুস্পষ্টভাবে বলা হচ্ছে– ‘এমন কতিপয় বান্দা আছেন, ব্যবসা ও ক্রয়-বিক্রয় যাদেরকে আল্লাহর স্মরণ থেকে বিরত রাখতে পারে না’ (সূরা: নূর, আয়াত: ৩৭)। অর্থাৎ ব্যবসা বা ক্রয়-বিক্রয়ের দুনিয়াবি কাজটিও তার জন্য ইবাদত হয়ে উঠবে।
কেননা তাতেও নিহিত রয়েছে স্রষ্টার এ নির্দেশটি পালনের আনুগত্য– ‘নামাজ শেষ হলে তোমরা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়বে এবং আল্লাহর অনুগ্রহ সন্ধান করবে। আর আল্লাহকে অধিকহারে স্মরণ করবে, যাতে তোমরা সফলকাম হও’ (সূরা: জুমআ, আয়াত: ১০)।
এ আয়াতের ব্যাখ্যায় ইমাম কুরতুবি (রহ.) খুবই সুন্দর লিখেছেন, ‘এতে অনুগ্রহ সন্ধান করার মানে– জীবিকা অর্জনের মাধ্যম গ্রহণ করা’ অর্থাৎ জীবিকা অর্জনের মাধ্যম গ্রহণকে আল্লাহ পাক নামাজের পরই উল্লেখ করে সৃষ্টিকর্তার নিকট এ নির্দেশটি পালনের গুরুত্ব কতটুকু হওয়া যুতসই, তাও বুঝিয়ে দিলেন। ফলস্বরূপ প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর আপন সুমিষ্ট জবান হতে এ সুসংবাদটিও অনুরণিত হলো– ‘ফরজ আদায়ের পর হালাল পন্থায় উপার্জনও একটি গুরুত্বপূর্ণ ফরজ’ (বায়হাকী)।
সেই হালাল উপার্জনটি যদি নিজ হাতের হয়, তাহলে তো কথাই নেই। একদিকে যেমন স্রষ্টার নির্দেশ পালন, অন্যদিকেও তেমনই পয়গম্বরগণের পথে চলন। তাদের অনুসরণে যে সওয়াব মিলে, এখানেও তাই। হাদিস শরীফে উল্লেখ রয়েছে– ‘নিজ হাতে উপার্জিত খাদ্যের চেয়ে উত্তম খাদ্য কেউ কখনো খায় না। আল্লাহর নবী দাউদ (আ.) নিজ হাতেই উপার্জন করে খেতেন’ (বুখারি)।
এ তো গেলো নিজহাতে উপার্জনের বিবরণ। আরো রয়েছে হালাল উপার্জনে উদ্ভুদ্ধকরণ। সেই নির্দেশ মহান কারিগরই দিয়েছেন; এসেছে তাঁরই পাক কালামে– ‘আল্লাহ তায়ালা তোমাদের জন্য যেসকল রিজিক হালাল করেছেন, তা থেকে খাদ্য গ্রহণ করো’ (সূরা: মায়েদা, আয়াত: ৮৮)।
শুধুই কি হালাল রুজিতে অভ্যস্ত থাকার নির্দেশ? না, বিরত থাকতে হবে হারাম থেকেও। যে রিজিক হারাম উপায় হতে আহরিত হয়, হারাম ব্যবসা-পরিশ্রম যাতে জড়িত থাকে– সেই ইনকামের কোনো মূল্য নেই। অন্যায় মিশ্রিত উপার্জন ইসলামে সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ। তাই বলা হয়েছে: ‘হে ইমানদারগণ, তোমরা পরস্পরের সম্পদ অন্যায়ভাবে আহরণ করবে না’ (সূরা: নিসা, আয়াত: ২৯)। কেননা ইবাদত কবুলের পূর্বশর্তই হলো– রুজি-রিজিকের পরিশুদ্ধতা। যার নির্দেশ কেবল সাধারণ মানবশ্রেণিকেই দেয়া হয়নি; অতুল নবীগণকেও এ নির্দেশনাই প্রদান করা হয়েছিল– ‘হে রাসুল সম্প্রদায়, পবিত্র রিজিক হতে খাও এবং নেক কাজ করো’ (সূরা: মুমিনুন, আয়াত: ৫১)।
পবিত্র রিজিক গ্রহণের পরপরই নেক আমল অবলম্বনের বিষয়টি খুবই গুরুত্ব সহকারে লক্ষণীয়। এ আয়াতের ভঙ্গিমাই আমাদের বাতলে দিচ্ছে– আগে বিশুদ্ধ রিজিক, তারপরে নেক আমল। এজন্যই মহানবী আকায়ে দোজাহাঁন (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ইরশাদ করেছেন– ‘ওই গোশত (দেহ) জান্নাতে যাবে না, যা হারাম (রুজি) হতে উৎপন্ন। জাহান্নামই এর সর্বাধিক উপযোগী’ (সহিহ ইবনে হিব্বান ও তিরমিজি)।
অন্য এক হাদিসে বিষয়টিকে আরো সুস্পষ্টভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে; বলা হয়েছে– ‘যে ব্যক্তি দশ দিরহাম দিয়ে কোনো কাপড় ক্রয় করল, অথচ তাতে এক দিরহাম অসৎ উপায়ে অর্জিত হলো। সে যতদিন ঐ কাপড় পরিধান করবে, ততদিন তার নামাজ কবুল হবে না’ (মুসনাদে আহমদ)।
এসকল হাদিস হতে একটি বিষয় সহজেই অনুমেয় হলো যে– হারাম উপার্জন ইবাদত কবুলের ক্ষেত্রে প্রধান বাধা। হারাম থেকে বেঁচে না থাকলে কবুল হবে না ইবাদত। হবে না সেই কৃতজ্ঞতার প্রকাশ। মানব কর্তৃক পূরণও হবে না স্রষ্টার দেয়া সেই সৃষ্টিলক্ষ্যটি। তাই বর্জন করতে হবে হারাম উপার্জনকে। আজ আমাদের সমাজ কলুষিত হয়ে রয়েছে হারাম উপার্জনের কালিমায় মিশ্রিত হয়ে। চারিদিকে রমরমা হয়ে উঠেছে হারাম ব্যবসাগুলো। ধোঁকাবাজি রাজ করছে প্রায় সকল ব্যবসার কেন্দ্রে। অথচ যে ব্যবসায় ধোঁকাবাজি মেশানো হয়, ঐ ব্যবসা ইসলামে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন– ‘সে আমাদের দলভুক্ত নয়, যে প্রতারণার আশ্রয় নেয়’ (মুসলিম)।
ইসলাম একটি সুশৃঙ্খল জীবন-বিধান। এ ধর্মটি যে কেবল লাভজনক উপার্জনকেই নিষিদ্ধ রেখেছে– তা নয়। বরং অবারিতও করেছে আরো অনেক উপার্জনকে। হারামের পথকে চিরতরে রুদ্ধ করে দিয়ে, বিকল্পস্বরূপ প্রদান করেছে হালাল রুজির উৎকৃষ্ট পথ। কেবল সে-সকল রুজিকেই ইসলাম হারাম সাব্যস্ত করেছে, যার পশ্চাতে অন্যের ক্ষতি জর্জরিত; সমাজের ক্ষতিই নিহিত। যথা: সুদ, ঘুষ, মাদক ব্যবসা ইত্যাদি। আর যে উপার্জনের কেন্দ্রে মানবকল্যাণ সাধিত হয়, তার জন্য ইসলাম বিনা বাক্যে আপন দ্বার উন্মুক্ত করে দিয়েছে এবং তাকেই বৈধ সাব্যস্ত করেছে। এতে ইসলামের মানবকল্যাণমুখী ধর্ম হবার কথাই দিবালোকের ন্যায় প্রতিভাত হয়।
অতএব ইসলামের দিকনির্দেশনা মেনেই রুজি রোজগার সন্ধান করতে হবে। নয়ত জীবন পরিচালনার মূল উদ্দেশ্য ‘ইবাদত’ই বৃথা যাবে।