চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

ইনক্রেডিবল ইন্ডিয়া: ধর্ষকের জন্য মৃত্যুর মিছিল!

নাম তার গুরমিত রাম রহিম সিংহ! ভারী ভাবের নাম। নামের মধ্যে রাম-রহিম দুটোই। যদু-মধু-শ্যাম থাকলে হয়তো আরও পূর্ণতা পেত! অবশ্য জীবনে তিনি যে ক্যারিশমা দেখিয়েছেন, তাতে তার নাম ‘ভণ্ড বাবা’ হলেই সবেচেয়ে ভালো হতো! খুন-ধর্ষণ-মিথ্যাচার-বাটপারি-হেন কোনো আচরণ নেই যা তিনি করেননি।

নিজেকে দাবি করেন ‘ঈশ্বরের প্রতিনিধি’ হিসেবে! এ যুগের ঈশ্বরের প্রতিনিধিরা বুঝি এমনই হন! যুগ বলে কথা! আর ভক্তরাও আরেক ধাপ সরেস! একজন পাক্কা ভণ্ড বা শয়তানের দীক্ষা নিতে, তার অনুসারী হতে, এমনকি তার পাপের পক্ষে জীবন দিতেও দ্বিধাবোধ করেন না! মগজহীন মানুষের জাত বুঝি একেই বলে!

হ্যাঁ, গুরমিত রাম রহিম সিংহের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ ছিল, সে অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে, অপরাধী গ্রেফতার হয়েছে। আদালত কেবল দোষী সাব্যস্ত করেছে, রায় ঘোষণা হবে তিনদিন পরে। এর জন্য এত বড় সংঘর্ষ হবে, হিংসার আগুন এ ভাবে লকলকিয়ে উঠবে, এত মানুষের মৃত্যু হবে এক দিনে, এই বিপুল পরিমাণ সম্পত্তিহানি হবে! বিস্ময়ের ঘোর কাটতে চাইছে না কিছুতেই।

হ্যাঁ, এমনটাই ঘটেছে আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতে। ‘গণতান্ত্রিক ভারত’, ‘আইনের শাসনের ভারত’ বলে যার গোটা বিশ্বে নামডাক আছে! কিন্তু এই কি গণতন্ত্র আর আইনের শাসনের নমুনা? এক স্বঘোষিত ‘গডম্যান’কে ধর্ষণের অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করছে আদালত, আর সেই ধর্ষকের হয়ে তার ক্ষিপ্ত অনুগামীরা হিংসাত্মক হামলা চালাচ্ছে। তাদের মধ্যে আবার এক বড় অংশই নারী! এ কেমন সামাজিক সচেতনতা? এ কেমন সমাজ? ধর্ষকের পক্ষে যারা জীবন বাজি রেখে লড়ে, এটা কী কোনো সভ্য সমাজের নমুনা?

এই হামলার জেরে পুলিশের গুলিতে ও অন্যান্য কারণে অন্তত ৩২ জনের মৃত্যু হয়েছে এবং আহতের সংখ্যা আড়াইশো ছাড়িয়েছে। শুক্রবার এমনই ন্যক্কারজনক ঘটনার সাক্ষী থাকলো আমাদের প্রতিবেশী দেশ হরিয়ানা, পাঞ্জাব এবং দিল্লি।

এটাকে কী বলা যায়, অপদার্থতা, না নির্লিপ্তি, না অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস? কী বলা যাবে হরিয়ানা সরকারের এই চরম ব্যর্থতাকে? যে নামেই ডাকা হোক, হরিয়ানা সরকারের চরম অপারগতা, অদূরদর্শিতা এবং দায়িত্বজ্ঞানহীনতার ছবিটাতে অবশ্য কোনও তারতম্য হবে না। গুরমিত রাম রহিম সিংহকে বিশেষ সিবিআই আদালত ধর্ষণ মামলায় দোষী সাব্যস্ত করতেই প্রায় গোটা হরিয়ানা যে ভাবে নৈরাজ্যের কবলে চলে গেল, যে ভাবে দীর্ঘক্ষণের জন্য আইনের শাসন মুছে ফেলে বিচ্ছিন্ন দ্বীপে পরিণত হল রাজ্যটা, তার দায় ডেরা সচ্চা সৌদা অনুগামীদের যতটা, হরিয়ানা প্রশাসনেরও ততোটাই। আগুন পাঞ্জাবেও জ্বলেছে প্রবল ভাবে, দিল্লিতেও ছড়িয়েছে কিছুটা। কিন্তু হরিয়ানায় শুক্রবার যেন যাবতীয় নজির ভেঙ্গে গিয়েছে।

একটা গোটা স্টেডিয়ামকে নাকি অস্থায়ী কারাগারে রূপান্তরিত করা হয়েছিল, পুলিশ নাকি রাস্তায় রাস্তায় ফ্ল্যাগ মার্চ করছিল। এত করেও লাখ লাখ ডেরা অনুগামীর পঞ্চকুলা প্রবেশ আটকানো গেল না? এত করেও এই ভয়ঙ্কর হিংসা দেখতে হল? এত করেও এই বিপুল সংখ্যক এবং অকারণ প্রাণহানি দেখতে হল?

অনেকেই বলাবলি করছে, এই স্বঘোষিত ধর্মগুরুর অনুগামীদের যথেচ্ছাচারে মেতে ওঠার সুযোগ উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে করে দেওয়া হয়েছে। কারণ রাম রহিমের অনুগামীর সংখ্যা পাঁচ কোটির আশপাশে। এই বিপুল সংখ্যক অনুগামীর রাজনৈতিক পছন্দ-অপছন্দের উপরেও ডেরা প্রধানের নিয়ন্ত্রণ অনেকটাই। তাই প্রত্যেক নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক দলগুলো ডেরা প্রধানের সমর্থনের কাঙাল হয়ে ওঠে এবং প্রত্যেক নির্বাচনেই ডেরা প্রধান কোনও না কোনও দলের প্রতি নিজের সমর্থন ব্যক্ত করেন। গত কয়েক বছরে একের পর এক নির্বাচনে কিন্তু বাবা রাম রহিমের সমর্থন বিজেপি তথা এনডিএ-র দিকেই যাচ্ছিল। সেই কৃতজ্ঞতার মূল্য চোকাতেই কি রাম রহিমের অনুগামীদের প্রতি প্রচ্ছন্ন প্রশ্রয় ছিল মনোহরলাল খট্টরের?

এই ধর্মগুরুর বিরুদ্ধে এন্তার অভিযোগ রয়েছে। সাংবাদিক হত্যা, নিজের রুমে নিয়ে মেয়েদের ধর্ষণ, ডেরার অন্তত ৪০০ সাধুকে নপুংসক করে দেওয়া, সাংবাদিক হত্যাসহ বহু গুরুতর অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। অনেক অভিযোগের বিচারও চলছে। তারপরও সে বিপুল প্রতাপ বজায় রেখে তার অপতৎপরতা চালিয়েই যাচ্ছিলো! তাহলে কোথায়, পুলিশ, কোথায় আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, কোথায়ই বা আইন?

ভারত ও বাংলাদেশের রাজনীতিতে ধর্মগুরুদের প্রভাব অপরিসীম। ক্ষমতাসীনরা কোনো না কোনো ধর্মগুরুর মুরিদ বা ভক্ত। বাংলাদেশে এটা একটু উহ্য হলেও ভারতে একেবারে প্রকাশ্য। বিশেষ করে বিজেপি সরকার ক্ষমতায় আসার পর তো বিভিন্ন উগ্রবাদী মঠ-ধর্মশালার প্রধানদের বাড়বাড়ন্ত রাজনীতিতে এই ধর্মগুরুদের ভূমিকা যেন অনেক সময়েই ‘রক্তকরবী’র রাজার মতো। অর্থাৎ, তাকে চট করে চোখে পড়ে না, কিন্তু রাজনীতির কুশীলবদের নিয়ন্ত্রণ করে সে-ই (ধর্মগুরুগণ)!

বর্তমান সময়ে ভারতের সবচেয়ে প্রভাবশালী ধর্মগুরু রামদেব যিনি ক্ষমতায়, অর্থে-প্রতিপত্তিতে সম্ভবত ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর পরেই অবস্থান করেন। এর আগে ভগবান রজনীশ নামে এক ধর্মগুরু কিংবদন্তী হয়ে উঠেছিলেন। এই ধর্মগুরুরা কেবল ‘ধর্ম’ই করেননা, নানা রকম অপকর্মও অবাধে করে যান। এই ধর্মগুরুদের বেশিরভাগই ভূস্বামী এবং অর্থবান। ফলে সমাজে এদের প্রতিপত্তি ক্ষমতাসীনদেরও সমীহ আদায় করে।

অথচ ভারতীয় উপমহাদেশে সম্রাট আকবরের আমলেও এই ‘ধর্মভিত্তিক গুরুবাদী’ চর্চা খুব একটা প্রাধান্য পায়নি। আকবরের সুলহ-ই-কুল (পূর্ণাঙ্গ শান্তি) এবং ইনসানুল কামিল (পূর্ণাঙ্গ মানুষ) নীতি এক বিরাট পরিবর্তন নিয়ে এসেছিল। আকবরের সুলহ-ই-কুল বলে, সব ধর্মই মহান। প্রত্যেকেরই উদ্দেশ্য পৃথিবীতে সর্বব্যাপী শান্তি প্রতিষ্ঠা করা। মানুষের জীবনে সুখ-সমৃদ্ধি নিয়ে আসা। সুতরাং ধর্মীয় মতভেদ ভুলে যেতে হবে। মূলত আকবরই উপমহাদেশে প্রথম সব ধর্মের মানুষকে এক ছাতার নিচে আনতে চেষ্টা করেছিল। সব ধর্মের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিল সম্রাট আকবর। চেয়েছিল সব ধর্মের অনুসারীদের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান। আর তার সুলহ-ই-কুল মতবাদ ছিল বিশ্বব্যাপী শান্তি প্রতিষ্ঠার একটা মাধ্যম।

কিন্তু বর্তমান ভারত হয়েছে ধর্মব্যবসায়ীদের এক অপার লীলাভূমি। অতি আবেগী অতি বিশ্বাসীদের ভারত এখন গোটা দুনিয়াতেই বিস্ময় উদ্রেককারী এক রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। কে একজন রসিকতা করে বলেছিলেন, ‘বর্তমানে ভারতে যত ধর্মগুরু বা বাবা-জাতীয় ধর্মের ব্যবসায়ী আছে সারা বাংলায় এতগুলো রামছাগলও নেই! কথা মিথ্যে নয়। ধর্মগুরু বা বাবা উৎপাদনের এক উৎকৃষ্ট স্বর্গভূমি এই অতি আবেগি অতি বিশ্বাসীদের দেশ ভারত। ন্যাংটা বাবা, ট্যাগরা বাবা, হাম্বা বাবা, ওল বাবা, নিত্যনতুন বাবার দেখো মিলে এই ভূখন্ডে। এ ধরনের ‘বাবা’ উৎপাদনে এরা যদি বাংলাদেশের জন্ম হারকে পেছনে ফেলে দেয় তাহলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না!

এশিয়ার মধ্যে পারমাণবিক শক্তিধর একটি দেশ অথচ এদের অনেক মানুষের মন-মানসিকতা-আচরণে মনে হয় যেন আমাজনের গহীন জঙ্গলের অধিবাসী। যেখানে এখনো ধর্ম নামের একটি সাধারণ বিষয় বিক্রি করে ক্ষমতা নেয়া যায়। মানুষকে বশীকরণ করা যায়। এই দেশের একাধিক বিজ্ঞানী বিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন, ভাবলে অবাক লাগে!

আমাদের দেশের সাধারণ কিছু অসচেতন মানুষের সঙ্গে সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ ভারতীয়র একটা মিল আছে। তারা কখনই আসল সমস্যাগুলোকে স্বীকার করবে না। এক শ্রেণির ভারতীয় দেশকে নিয়ে এমনই গর্ব করে পারলে পশ্চাদ্দেশ আকাশে তুলে দেয়। কিন্তু তারা কি জানে তাদের কত মানুষ না খেয়ে থাকে? তারা কি জানে মানব উন্নয়নে কত পিছিয়ে? ওদের বেকার সমস্যা কত প্রকট? একটি বেকারের জীবনের গল্প কি কেউ বলে? ওখানকার বঞ্চনার কথা, নারী নির্যাতন, ধর্ষণের কথা কি ওরা বলে? ওরা বলে সানি লিওনির কথা। ওরা বলে তেন্ডুলকরের কথা, বিরাট কোহলির কথা। যেখানে একজন ধর্ষকের পক্ষে লাখ লাখ মানুষ দাঙ্গা বাধায়, খুনের উৎসবে মেতে উঠে, সেটা আর যাই হোক, কোনো সভ্য দেশ হতে পারে না।

ভারতের এই ঘটনা থেকে আমাদেরও অনেক কিছু শিক্ষা নেওয়ার আছে। ভন্ড, অসৎ, ধর্মব্যবসায়ীদের কিছুতেই প্রশ্রয় দেয়া যাবে না। তাদের হাতে জীবনের ভার সমর্পণ করা যাবে না। আমাদের ভাগ্যের চেয়ে কর্মে বিশ্বাসী হতে হবে। আর ভণ্ড, নারী নির্যাতনকারী, ধর্মব্যবসায়ী, ক্ষমতার দাপটধারীরা যদি কখনও তাদের সমর্থনের জন্য আসে, তাহলে স্রেফ কষে থাপ্পর মারতে হবে। আমরা কপাল নয়, কর্মে (হাতে) বিশ্বাসী হতে চাই।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)