অভিবাসী সংকট এবং এই ইস্যুতে ইউরোপের দেশ হাঙ্গেরির ভূমিকার সমালোচনা করে নিজ ফেসবুক ওয়ালে পোস্ট করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনভার্সিটির সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক আলী রিয়াজ।
১৯৯৫ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত লন্ডনে বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিসে ব্রডকাস্ট জার্নালিস্ট হিসেবে কাজ করা আলী রিয়াজ তার পোস্টে লিখেছেন:
‘কোনো জাতিরাষ্ট্র কি নিজস্ব ইতিহাস বিস্মৃত হয়, একটি জাতি কি ভুলতে পারে তার বেদনাবহ অতীত? এই সব ইতিহাস থেকে রাষ্ট্র ও জাতি কি শিক্ষা নেয়? এই সব প্রশ্ন মাঝেমাঝে আমাদের সামনে এসে দাঁড়ায়, কখনও তা আমাদের মনে করিয়ে দেয় গৌরবোজ্জ্বল ঘটনা প্রবাহ, কখনো আমাদের সামনে তা তুলে ধরে মর্মান্তিক উদাহরণ।
গত কয়েক দিন ধরে হাঙ্গেরির সীমান্তে দাঁড়িয়ে থাকা শরনার্থীদের দেশের ওপর দিয়ে অষ্ট্রিয়া এবং জার্মানী যাবার অনুমতি দিতে অস্বীকার করেছে হাঙ্গেরির নেতৃবৃন্দ; আজ তাঁরা ‘মহানুভবতা’ দেখিয়ে এই শরণার্থীদের যাবার অনুমতি দিয়েছে।
সেই অনুমতির জন্যে অপেক্ষা না করে হাজার হাজার মানুষ ১৮০ কিলোমিটার পথ হেটে পাড়ি দেবার জন্যে পথে নেমে পড়লে খানিকটা অনন্যোপায় হয়েই হাঙ্গেরি এই পদক্ষেপ নয়। গত কয়েক দিনের ঘটনা প্রবাহ, হাঙ্গেরির অস্বীকৃতি আর হাজার মানুষের এই অসহায় পদযাত্রা দেখে আমার মনে হয়েছে হাঙ্গেরি কি ষাট বছর আগের ইতিহাস এত সহজেই ভুলে গেছে?
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপের সবচেয়ে বড় শরণার্থীর ঢেউ তৈরি হয়েছিলো ১৯৫৬ সালে, আর সেই মিছিল ছিলো হাঙ্গেরির মানুষের। ১৯৫৬ সালের ৪ নভেম্বর সোভিয়েত সৈন্যরা যখন দ্বিতীয়বারের মত হাঙ্গেরি প্রবেশ করলো তখন হাঙ্গেরির কমপক্ষে ২ লাখ নাগরিক পায়ে হেটে প্রবল শীতের মধ্যে যাত্রা করেছিলো দেশের পশ্চিম এবং দক্ষিন সীমান্তের দিকে – অস্ট্রিয়া এবং ইউগোশ্লোভিয়া ছিল তাদের লক্ষ্য।
সম্বল ছিলো যা কিছু হাতে ধরে তাঁরা সঙ্গে নিতে পেরেছেন। তাঁরা যখন এই দুই দেশের সীমান্তে পৌঁছান তাঁদের জন্যে অপেক্ষা করেছে উষ্ণ আলিঙ্গন, শরণার্থী শিবির। পরের দুই বছরে এই হাঙ্গেরিয় নাগরিকদের অভিবাসন করা হয় পশ্চিমা দেশগুলোতে।
কিন্ত ঠিক উনষাট বছরের মাথায় হাঙ্গেরি তাঁর দরজা খুলতে অস্বীকার করেছে সিরিয়া আর ইরাক থেকে আসা শরণার্থীদের জন্যে। ইতিহাসের এই বিস্মৃতি কেবল কি হাঙ্গেরির? একি জাত্যাভিমানের পরিণতি? একি বর্ণবাদের প্রকাশ? একি ধর্মের ফারাকের সামনে মানবিকতার পরাজয়? একি জাতিরাষ্ট্রের সীমান্তের অন্ধত্ব?
যে ইহুদি জনগোষ্ঠীর ইতিহাস হচ্ছে নিপীড়িত হবার সেই যখন ফিলিস্তিনীদের নিপীড়ক হয়ে ওঠে তখন মনে প্রশ্ন জাগে ইতিহাস কি তাহলে কেবল এই সময়ের- বর্তমানের? তারপরে কেবল বিস্মৃতির অন্ধকারে তার জায়গা হয়?
কিন্ত আমরা তো জানি যে কোনো জাতি নিজেকে জাতি বলে দাবি করে যে সব উপাদানের জোরে তাঁর মধ্যে ইতিহাস, সকলের ‘সম্মিলিত স্মৃতি’ (কালেকটিভ মেমোরি) একটি অন্যতম উপাদান। জাতীয়তাবাদ সব সময় সেই স্মৃতিকেই বেছে নেয় যা তাকে বৈধতা দেবে, ততটুকুই সে গ্রহণ করে যা তাঁকে টিকিয়ে রাখে।
তার বাইরে ইতিহাসের যে সব অধ্যায় জাতি ও জাতিরাষ্ট্র তাঁকে অস্বীকার করতে চাইতে পারে, কিন্ত ইতিহাস হারিয়ে যায় না।’