চট্টগ্রাম থেকে: ‘এই বয়সে এসে জাতীয় দলে সুযোগ পাওয়া, এটা খুব কম মানুষের ভাগ্যেই জোটে। কিন্তু আমি সে সুযোগ কাজে লাগাতে পারিনি। আসল জায়গাতেই আমি ব্যর্থ।’ -বৃহস্পতিবার টিম হোটেলের লবিতে বসে বলছিলেন জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজের দুই ম্যাচেই শূন্য রানে আউট হওয়া ফজলে মাহমুদ রাব্বি।
অভিষেক ম্যাচে শূন্য রানে আউট হয়েও চট্টগ্রামে এসেছিলেন হাসিখুশি থেকেই। জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামে অনুশীলনের ফাঁকে শোনান ঘরোয়া লিগেও শূন্য রানে ক্যারিয়ার শুরুর গল্প। সেই রাব্বি একদিন পরই বিষাদগ্রস্ত। যেন হতাশার সাগরে নিমজ্জিত এক নাবিক! শরীর চলছে না, হাত থেকে পড়ে যাচ্ছে মোবাইল ফোন।
ঘরোয়া ক্রিকেটে ১৪ বছর খেলার অভিজ্ঞতা আর সাম্প্রতিক সময়ে রানের ফল্গুধারা ছুটিয়ে পেয়ে যান আন্তর্জাতিক মঞ্চ। অথচ এখানে এসে দেখলেন নিজের চরম ব্যর্থতা। মিরপুরের মতো চাপ ছিল না চট্টগ্রামে। লিটন-ইমরুলের ১৪৮ রানের ওপেনিং জুটিতে বাংলাদেশ ছিল সহজ জয়ের কক্ষপথে। জিম্বাবুয়ে অফস্পিনার সিকান্দার রাজার বলে অদ্ভুতভাবে খেলতে গিয়ে স্টাম্পিং হয়ে ফেরেন সাজঘরে।
কেনো সিঙ্গেলস খেলতে উইকেট ছেড়ে বেরিয়ে গিয়েছিলেন? ‘প্রথম ম্যাচে যে বলটা এসেছে ওটাতে আমার কিছু করার ছিল না। ভালো বলে আউট হয়ে গেছি। প্রথম ম্যাচে আউটের ফলে শেষ ম্যাচে মনের ভেতর কাজ করেছে একটা রান নিয়ে নেই। হয়তো একটা রান নিতে পারলে আমার স্বাভাবিক খেলাটা খেলতে পারতাম। ওই একটা রানের তাড়াহুড়ায় হয়তো আমাকে আবারও শূন্য রানে ফিরতে হয়েছে।’
ম্যাচ খেলার জন্য আদর্শ প্রস্তুতিই নিয়েছিলেন রাব্বি। কম্পিউটার অ্যানালিস্টের সঙ্গে বসে বারবার দেখেছেন নিজের ব্যাটিং। ছিলেন আত্মবিশ্বাসীও। তারপরও কেনো হল না তার ব্যাখ্যা নেই এ ব্যাটসম্যানের কাছে। তবে পার্থক্য করতে পেরেছেন ঘরোয়া আর আন্তর্জাতিক ম্যাচের মধ্যে।
‘ঘরোয়ায় যখন খেলি অতবেশি চিন্তা থাকে না। চাপহীন থাকি। এখানেও তেমন থাকতে চেয়েছিলাম। কিন্তু মাঠে নামার পর কেমন যেন একটা, দেশের জার্সি নিয়ে যখন নামছিলাম তখন অন্যরকম একটা অনুভূতি হচ্ছিল। ওই চাপটাই হয়তো আমি কাটিয়ে উঠতে পারিনি। প্রত্যাশা যখন অনেকবেশি থাকে, তখন হয়তো একটু চাপ কাজ করতে পারে। অনেক আত্মবিশ্বাসী ছিলাম এটিও কারণ হতে পারে।’
পছন্দের জায়গা তিন নম্বরেই পেয়েছিলেন খেলার সুযোগ। সতীর্থদের সমর্থনও ছিল খুব। অধিনায়ক-কোচ বলছেন দুর্ভাগ্য। কিন্তু রাব্বি নিজে মনে করেন এটি আসলে ব্যর্থতা।
‘পারফেক্ট জায়গায় ব্যাটিং করেছি। তিন নম্বরেই সবচেয়ে বেশি পছন্দ করি ব্যাটিং করতে। এত ভালো জায়গা পেয়েও যখন হল না, জানিনা কপালে কী আছে! ভাগ্যের দোষ দিলে তো নিজের ব্যর্থতা আড়াল করে দেয়া হবে।’
‘শুনতাম যে জাতীয় দলে সবাই সবার কাজ নিয়ে খুব ব্যস্ত। কিন্তু আমি সবার যে সাপার্ট পেয়েছি সেটির প্রতিদানে আমার কিছু করা উচিত ছিল। এমন না যে আউট হওয়ার পর ড্রেসিংরুমে আমার সঙ্গে কেউ কথা বলেনি। টিম বয় থেকে শুরু করে কোচিংস্টাফের সবাই বলেছে যে ব্যাডলাক।’
চোখ বন্ধ করলেই রাব্বির চোখে ভাসে দুটি শূন্য। পরপর দুই ম্যাচে অর্জন! ঘরোয়া ক্রিকেটে ১৪ বছরের সব অর্জনও শূন্য মনে হয় তখন। দেশের জন্য লড়াই করার আসল মঞ্চে ব্যর্থতায় আগের জীবনে ফিরে যাওয়াও কঠিন হবে, এমনটাই উপলব্ধি রাব্বির।
‘এত খারাপ লাগা কখনই অনুভব করিনি। ঘরোয়া লিগের সবকিছু শূন্যই মনে হচ্ছে আমার কাছে। এত অর্জন নিয়ে কী লাভ হল যখন আসল জায়গাতেই আমি ব্যর্থ।’
পৃথিবীতে অনেক সফল মানুষের শুরুটা হয় ব্যর্থতা দিয়ে। ক্রিকেটেও সে নজির আছে। শচীন টেন্ডুলকার শুরুর তিন ম্যাচে আউট হয়েছিলেন শূন্য রানে। তবে সেটির সঙ্গে তুলনায় যাওয়ার সুযোগ নেই রাব্বির। কদিন পরই ৩১-এ পা রাখবেন বলেই কিনা বললেন, ‘অল্পবয়সে শুরু করলে নিজেকে শোধরানোর সুযোগ থাকে। কিন্তু আমার এখন ভুল শোধরানোর সুযোগ কম। হয়তো ক্যারিয়ারে আর একটা বা দুইটা সুযোগ সামনে আসতে পারে, আবার নাও পারে। তবে বুঝতে পারছি এখন আমার সামনে সুযোগ কমে গেল।’
প্রথম ম্যাচে রাব্বি শূন্য রানে আউট হওয়ার পর মাশরাফী বলেছিলেন, আরেকটি সুযোগ রাব্বির প্রাপ্য। দ্বিতীয় ম্যাচেও ফেরেন শূন্য রানে। ‘দুর্ভাগা’ ক্রিকেটারকে আরও একটি সুযোগ দিতে দ্বিধা করতে চান না অধিনায়ক।
‘আপনি যদি আমাকে দল নির্বাচন করতে বলেন, তাহলে ওকে আরেকটি সুযোগ দিতে আমি দ্বিধা করবো না। সত্যি কথা বলতে আমার কাছে মনে হয় সে অনেকবেশি দুর্ভাগা।’
‘একজন খেলোয়াড়ের সবদিক নিয়ে যদি চিন্তা করি, তাহলে আমার কাছে মনে হয় ভালোভাবে ব্যাকআপ করা সম্ভব। সে কিন্তু নিজেকে প্রমাণ করেই এই পর্যন্ত এসেছে। হুট করে দুটি ম্যাচে আউট হয়ে যেতেই পারে।’
শুক্রবার তৃতীয় ওয়ানডেতে রাব্বির সুযোগ পাওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। ২০১৯ বিশ্বকাপের কম্বিনেশন যাচাই করতে সাইডবেঞ্চে বসে থাকা ক্রিকেটারদেরও পরখ করার ব্যাপার আছে। তবে টিম ম্যানেজমেন্টের উদারতায় যদি শেষ ম্যাচেও টিকে যান, সেটি হবে রাব্বির জন্য আশ্চর্যরকমের এক উপহার!