চারিদিকে ঘন বনে ঘেরা এক টুকরো জনপদ। বনের ভেতর দিয়ে বয়ে গেছে আঁকাবাঁকা নদীপথ। কোনটি মিলেছে বঙ্গোপসাগরে, আবার কোনটি পাশের বড় নদীগুলোর সঙ্গে। সবুজ বনায়ন গোটা দ্বীপকে প্রকৃতির ঝাপটা থেকে আগলে রেখেছে।
যেন নববধূর সাজে এ দ্বীপ ঘুমিয়ে থাকে প্রকৃতির কোলে; নদী পাড়ি দিয়ে তার কাছে না পৌঁছালে সৌন্দর্য্য উপভোগের কোন সুযোগ নেই। বাংলাদেশের সর্ব দক্ষিণে সমুদ্র মোহনায় প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য্য নিয়ে জেগে থাকা জনপদ ‘কুহইররা’র প্রাথমিক বর্ণনাটা এমনই।
কুহইররা! শব্দটা শুনে প্রথমে কেউ কেউ চমকে গেলেও এখানকার মানুষ চমকাবেন না। কারণ, স্থানীয় বাসিন্দারা আঞ্চলিক ভাষায় ‘কুহইররা’ বলেই অভ্যস্থ। আর কাগজে কলমে এর নাম কুকরি মুকরি। দ্বীপ জেলা ভোলার চরফ্যাশনের এই দ্বীপ ইউনিয়নে পৌঁছানোর আগেই যেন সৌন্দর্য্য অনেকখানি উপভোগ হয়ে যায়। সবুজ ঘন বনের ভেতর আঁকাবাঁকা নদী বেয়ে চলে ছোট তরী। সরু খালের দু’ধারে কেওড়া আর গোলগাছের সমারোহ। প্রায় দেড় ঘন্টার নদীপথ পাড়ি দিয়ে অবশেষে কুকরি মুকরি ঘাটে।
চার বছর আগের কুকরির সাথে এখনকার কুকরির মিল খুঁজি। অনেক ফারাক! সন্ধ্যা হতে না হতেই ইউনিয়নের প্রাণকেন্দ্র বলে পরিচিত কুকরি বাজারের আশপাশে জ্বলে ওঠে সড়ক বাতি। আলোর নিচে পাকা সড়ক। যেখানে ছিল কোন রকমের চলার পথ; ইট বিছানোর কথাও ভাবা যায়নি; সেখানে এখন ঢালাই রাস্তা। উত্তরে পাকা সড়ক বন ছুয়েছে, দক্ষিণে আমিনপুর ছাড়িয়ে গেছে। কুকরি বাজার থেকে ডাকাতিয়া মাছঘাট পর্যন্ত যাতায়াতে আগের ভোগান্তি এখন আর নেই। সেখানে রাস্তা পাকা হয়নি; তবে মাটির রাস্তাটা বেশ প্রশস্থ এবং উঁচু হয়েছে।
কুকরির দক্ষিণে মনুরা বাজারে যাওয়ার পথে মনির হোসেনের দোকানের সামনে জ্বলজ্বল করে আলো ছড়াচ্ছে সড়ক বাতি। আমিনপুরের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং মাদ্রাসার দিকে, কিংবা ইউনিয়ন পরিষদ ভবনের আশপাশের রাস্তায় সন্ধ্যার পর ঝকঝকে আলো দেখা যায়। পর্যটন বিকাশের চিন্তা বিবেচনায় রেখে কুকরিতে থ্রিস্টার মানের রেষ্ট হাউস নির্মিত হয়েছে। আরও হোটেল-মোটেল হওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। দক্ষিণ আইচা থেকে নদী পর্যন্ত রাস্তা এবং কুকরি উত্তরে বনের ভেতরের রাস্তা নির্মাণের কাজ শেষ হলে নদী পারাপারের জন্য ক্যাবল কার নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে বলে জানালেন ইউপি চেয়ারম্যান আবুল হাসেম মহাজন।
দক্ষিণ আইচার কচ্ছপিয়া ঘাট থেকে কুকরি যেতে হয়। এ পথে যাতায়াতে দুপুর সাড়ে ১২টায় এবং বিকেল ৪টায় রয়েছে ছোট লঞ্চ রয়েছে। এ লঞ্চ সার্ভিস অনেক পুরনো। এ পথে স্পীডবোট সার্ভিস চালু হয়ে কুকরির সঙ্গে নৌ যোগাযোগ ব্যবস্থার আরও উন্নয়ন ঘটিয়েছে। মুমূর্ষু রোগীদের ডাক্তারের কাছে পৌঁছানো কিংবা অন্য যেকোন জরুরি প্রয়োজনে খুব অল্প সময়ে এখানকার মানুষ যেকোনো স্থানে যেতে পারে। কুকরি চারদিকে বেড়িবাঁধ নির্মিত হওয়ায় মানুষজন অনেকটা নিরাপদ। সাধারণ মানুষের মুখ থেকেও কুকরি উন্নয়নের কথা শুনেছি।
আশপাশের চরমোন্তাজ, ঢালচর কিংবা এমনসব দ্বীপ ইউনিয়নগুলোর দিকে তাকালে কুকরি অনেকটা এগিয়ে আছে। অনেক দ্বীপ ইউনিয়নে বেড়িবাঁধ হয়নি। অভ্যন্তরীণ রাস্তাঘাটের তো দেখাই নেই। কিন্তু দ্বীপ হিসাবে শুধুমাত্র কুকরির দিকে তাকালে এই আলোর নিচেও রয়েছে আঁধার। সবগুলো ক্ষেত্রে এখানকার মানুষ নাগরিক সেবা কতটা পাচ্ছে? তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। স্বাস্থ্য-চিকিৎসা ব্যবস্থা নাজুক। বহু ছেলেমেয়ে স্কুলে যেতে পারছে না। বিদ্যালয়গুলোতে মানসম্পন্ন লেখাপড়া হয় কিনা- তা নিয়ে রয়েছে প্রশ্ন। নেই শিক্ষার পরিবেশ। বাল্যবিয়ে, একাধিক বিয়ে, তালাক, বিবাহ বিচ্ছেদ- এগুলো আছে প্রায় ঘরে।
কুকরি প্রবেশের আগেই ধারণা পাই এখানে বাল্যবিয়ের মাত্রা এখনও কমেনি। ৬টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং একটি মাত্র মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে মানসম্মত লেখাপড়ার পরিবেশের অভাব রয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব, দুর্যোগ-দুর্বিপাক, এসব তো আছেই। জলবায়ু ফান্ডের টাকায় কুকরি চারপাশে বেড়িবাঁধ হলেও এখনও বাইরে রয়ে গেছে পাতিলা ওয়ার্ডটি। অন্যদিকে কুকরি বেড়িবাঁধেও নানান ধরনের ত্রুটির কথা জানালেন বাসিন্দারা। স্লুইজগেট না হওয়ায় কোথাও কোথাও দেখা দিচ্ছে জলাবদ্ধতা। এরফলে চাষাবাদ বিঘ্নিত হচ্ছে। মনুরা, রসুলপুর, শাহবাজপুর, আমিনপুরের অনেক কৃষক চাষাবাদে সমস্যার কথা জানান।
কুকরির মানুষের ভালো থাকা মন্দ থাকা নিয়ে আলাপে মনুরা ও রসুলপুরের বাসিন্দারা বললেন, ‘বেড়িবাঁধ হলেও আমাদের দু:খ কমেনি।’ পাল্টা প্রশ্ন করি, ‘কেন?’ তারা বলেন, ‘বেড়িবাঁধ হওয়ার পর ডুবে যাচ্ছে ফসলি জমি। বেড়িবাঁধে সমস্যা নিরসন হয়নি। লবণ পানি বাংলা জ্যৈষ্ঠ মাসের শেষদিক থেকে ওঠা শুরু করে। জ্যৈষ্ঠ মাসের শেষ পর্যন্ত লবণ পানি থাকে। অথচ এই সময়টা রবিশস্য ওঠার সময়। স্লুইজগেট না হলে এ বেড়িবাঁধ কৃষকের কাজে লাগবে না। যদিও ইউপি চেয়ারম্যান এ বিষয়ে জানালেন, অচিরেই স্লুইজ গেট নির্মিত হবে। এর ফলে জলাবদ্ধতার সমস্যা থাকবে না।
কুকরি পূর্ব থেকে পশ্চিম, উত্তর থেকে দক্ষিণ, সর্বত্র উন্নয়নের সুবাতাস; কিন্তু আলোর নিচেই যেন অন্ধকার। দক্ষিণা হু হু বাতাসে বেড়িবাঁধের বাবলা গাছে সৃষ্টি করে এক মিষ্টি সুরের মূর্ছনা। বিকেল হতে না হতেই দ্বীপের ‘রাজধানী’ কুকরি বাজার জমে ওঠে। ইউপি চেয়ারম্যান এলাকায় থাকলে পরিষদ ভবনে বসে সালিস বৈঠক কিংবা অন্য জরুরি আলোচনা। কুকরি বাজারের চায়ের দোকান জমে ওঠে মানুষের গমগমা শব্দে। হোটেলে বাজে বাংলা সিনেমার সংলাপ কিংবা লেখার উত্তেজনা। বাজারের রাস্তাঘাটের উন্নয়ন ঘটেছে, টলঘর আরও মজবুত করে বানানো হয়েছে, তরকারি বেচাকেনার স্থান পাকা হয়েছে। বাজারের রাস্তাঘাটের কোথাও বৃষ্টির পানি জমতে দেখিনি। বাজারের ব্রীজের ওপরে আলোর নিচে বসে জমজমাট আড্ডা। ব্রীজের ওপারেও আরেক বাজার জমে উঠেছে। কিন্তু বাঁধের বাইরে থাকা মানুষ, কর্মহীন মানুষ, দেনার দায়ে জর্জরিত মানুষ, বার বার ব্যবসা বানিজ্যে মার খাওয়া মানুষের কাছে উন্নয়নের এই সুবাতাস কতটা পৌঁছাতে পারছে, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়।
কুকরির পূর্বে শাহবাজপুরের বন ঘেঁষে আবাসন নির্মাণ হতে দেখেছি। এখানে স্থান পেয়েছেন বহু ভূমিহীন পরিবার। ভর দুপুরে অনেক নারী-পুরুষ ও শিশুদের দেখি ‘সরকার থেকে পাওয়া’ নতুন ঘরের মেঝেতে মাটি ভরাট করছেন, মাটির সঙ্গে পানি মিশিয়ে মেঝে সমান করছে। কেউ বনের ধার থেকে মাটি কেটে আনছে, কেউবা সামনের পুকুর থেকে পানি তুলছে। আবাসনের নতুন ঘরগুলো দেখতে ভালোই লাগে। যেখানে মাথা গোঁজার ঠাঁই ছিল না; সেখানে সরকার না হয় একখানা থাকার ঘর দিল! কিন্তু এই মানুষগুলোর জীবিকার ব্যবস্থা কী হবে? সে বিষয়ে আমরা কতটা ভাবছি? উপকূলের বিভিন্ন এলাকার আবাসনের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, নতুন ঘর পেয়ে পুরানো ঘর ছেড়ে এসে যেন মানুষগুলো বিপাকে পড়েছে। শিক্ষা-চিকিৎসার কোন ব্যবস্থা আবাসনে থাকে না। এখানে থাকবে কীনা আমার জানা নেই।
চলতি পথে বহু মানুষের সঙ্গে দেখা হয়। অনেকের সঙ্গে নিজে ইচ্ছা করেই কথা বলি। অনেকে আবার এগিয়ে এসে নিজের গল্পটা জানাতে চান। আমি শুনি। কিন্তু আমার তো কিছু করার নেই। সম্বল কাগজ এবং কলম। একটা প্রতিবেদন লিখতে পারি মাত্র। শাহবাজপুরের অদুদ বয়াতির কথা আমি শুনেছি। তার ছেলে রুবেলের গল্পটাও শুনেছি। আবার জামাল মাতব্বরের মেয়ে কুমারী মাতা পনেরো বছর বয়সী সীমার গল্পটাও নোটবুকে টুকে নিয়েছি। মানুষগুলোর চোখে মুখে নিরব এক করুণ আকুতি। আমার কী করার আছে?
কুকরির দক্ষিণে রসুলপুরের বেড়িবাঁধের বাইরে থাকা সুমি, যার অতি অল্প বয়সেই বিয়ে হয়েছিল জেলে ইউনুস মৃধার সাথে। আপন মায়ের অনুপস্থিতিতে সৎ মা নিলুফা লেখাপড়া বন্ধ করে বিয়ে দিয়েছিল সুমিকে। বিয়ের বয়স হয়তো এখনও হয়নি; কিন্তু তার কোলে এখন দুটি যমজ কন্যা সন্তান। কী তাদের ভবিষ্যত আমি জানি না। সদ্য বাল্যবিয়ে হওয়া আবদুল হকের মেয়ে জয়নব বেগমের খোঁজ নিতে গিয়ে দেখি, শুধু জয়নবের বাল্যবিয়ে হয়নি। তার বড় ভাই জুয়েল যাকে বিয়ে করে এনেছে; সেই রেশমা বেগমও শিশুকালেই এ ঘরের বউ হয়ে এসেছে। তার কোলেও দু’টি সন্তান। পাশের বাড়ির নূর হোসেন মাতব্বরের স্ত্রী নূর নাহার, যার বিয়ে হয়ে অতি অল্প বয়সে, তিনি এখন তিন সন্তানের মা। নিজের মেয়েকে শিশুকালে বিয়ে দিয়ে আর ভুল করতে চান না তিনি।
একইভাবে রাখাল ফিরোজ, রাজমিস্ত্রী মো. বেল্লাল, টেইলর আবদুর রহিম, জেলে আবুল মাঝিসহ আরও অনেকের গল্প শুনি। কোন ঘটনায় ব্যথিত হই। আবার কোন ঘটনা শুনে ভাবনা আসে, এমন না হয়ে এমনটা কেন হলো না? ফিরোজ কেন লেখাপড়া করতে পারলো না? রহিমের শিশু সন্তানটি কেন বাঁচিয়ে রাখতে পারলো না? জেলে আবুল মাঝি কেন দেনার জালেই আটকে আছে যুগ যুগ? প্রশ্ন জাগে, কুকরি বাজার থেকে খানিক দূরে ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্রটি কেন মানুষের কল্যাণে আসতে পারলো না? চার বছর আগে এখানে যে চিত্র দেখে গিয়েছি, এবারের চিত্র আরও খারাপ। কথা বলার জন্য কোন লোককেই পাওয়া গেল না।
আলো আঁধারের কুকরি; ভালোমন্দের কুকরি। সম্ভাবনার এ দ্বীপ ঘিরে সরকারের রয়েছে নানামূখী পরিকল্পনা। পর্যটক আকর্ষনের জন্য এখানে হচ্ছে আরও অনেক কিছু। সেই সুবাদে কিছু মানুষের হাতে টাকা উড়বে, চায়ের দোকানের টেবিলে আসবে কাপের পর কাপ চা। দিন শেষে ব্যবসায়ীরা বৃদ্ধা আর তর্জনীতে মুখের থু থু লাগিয়ে টাকার হিসাব কষবেন। যা দেখে বোঝা যাবে কুকরি এগোচ্ছে উন্নয়নের পথ ধরে। কিন্তু সেই উন্নয়নের আলো ফেলতে হবে প্রতিটি কোনায়। আলোর নিচের জায়গাটা যেন অন্ধকারে ঢাকা না থাকে!
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)