দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল এখনো শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত। তারা কুসংস্কারের অন্ধকারে নিমজ্জিত। কন্যা সন্তান জন্ম দেয়া, পুত্র সন্তান কিংবা আদৌ সন্তান না হওয়ার জন্য তারা নারীদের দোষারোপ করে থাকে। যা হাদিস-কুরআন কিংবা বিজ্ঞান সম্মত নয়। গ্রামাঞ্চলে একান্নবর্তী পরিবারগুলো এখনো টিকে আছে। যেখানে দাদা-দাদি, চাচা-চাচী, ফুপু, মা-বাবা সন্তানাদি নিয়ে একত্রে বসবাস করে। আবার এখনও দেখা যায় বিশাল উঠানকে ঘিরে অনেক সদস্যের একেকটা পরিবার নিয়ে একেকটা বাড়ি। যেখানে এতোই কুসংস্কারের ছড়াছড়ি যা বর্ণনা দিয়ে শেষ করা যাবে না। তথাপি অভিজ্ঞতার সংক্ষিপ্ত বিবরণ-
নিঃসন্তান নারীকে আঁটকুড়ে বলে ঘৃণা করা হয়। সকালে ঘরের দুয়ারে বিধবা কিংবা আঁটকুড়ে নারী চোখে পড়লে শুভ কাজে কুলক্ষণ দেখা দেয় বলে ভাবা হয়। এতিম কন্যাকে সর্বদা বকাবকি করে বলা হয় -“তুই অলক্ষী/রাক্ষসী, তাই মা-বাবাকে খেয়েছিস।” একই পরিবারের কন্যা সন্তানের জননীর তুলনায় পুত্র সন্তানের জননীকে অধিক গুরুত্ব দেয়া হয়। কন্যা সন্তানের জননীকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা হয়।
ইসলাম শান্তির ধর্ম; সেখানে বলা হয়েছে- “যে পিতামাতার ঘরে তিনটি কন্যা সন্তান রয়েছে এবং কন্যাদের স্বযত্নে লালন-পালন করে সুপাত্রে অর্পন করলে হজের সমান সওয়াব পাওয়া যায়। মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর ছিলেন চার কন্যা।
কুসংস্কারাচ্ছন্ন মনের মানুষগুলো বাড়িতে নববধুর প্রতি চালায় অমানবিক নির্যাতন। কয়েকটি বাস্তব উদাহরণ-
কোন এক শাশুড়ি রাগের বসে মাটির চুলার জ্বলন্ত চেলা বা লাকড়ি খড়ের চালে ছুঁড়ে মারে। তাতে আগুন ছড়িয়ে পড়ে অনেক কিছুই পুড়ে ছাড়খার হয়ে যায়। এর জন্য দায়ী করা হয় নববধুকে এই বলে-বাড়িতে আসতে না আসতেই আগুন।
গ্রামে প্রায়ই শোনা যায় কূল-বধুকে জ্বিন-ভূতে ধরেছে। এর মূল কারণ হচ্ছে-বধুটির নির্যাতনের যন্ত্রনা সইতে সইতে শেষ পর্যন্ত ধৈর্য্যের বাধ ভেঙে যায়। তখন সে জ্বালা-যন্ত্রনা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য ভূতে ধরার ভান করে গাছের ডালে এলো চুলে পা দুলিয়ে পেয়ারা খায় আর সুরেলা কন্ঠে গান গাইতে থাকে। অথবা পুকুরের জলে উত্তপ্ত রোদে আপন মনে সাঁতার কাটে।
মিনা নামের মা হারা এক শিশু। মামার বাড়িতে লালিত পালিত হয়। মামারা এক স্বচ্ছল গেরস্ত ঘরে বিয়ে দেয় তের বছরের মিনাকে। বাপের বাড়ি মামার বাড়ি দুই বাড়িতেই মিনা নাইওর করে। দিনগুলো খারাপ কাটছিল না। এভাবে কেটে যায় আটটি বছর। তবুও মিনার কোল জুড়ে সন্তান এলো না।
তখন মিনার স্বামী (মিনার তখন একুশ বছর) সন্তানের আশায় আবার নতুন বৌ নিয়ে এলো বাড়িতে। আর মিনার ঠাই হলো ঢাকা শহরের এক ইঞ্জিনিয়ারের বাসায় অর্থাৎ দূর সম্পর্কের ফুপাতো বোনের বাসায় কাজের বুয়া হিসেবে।
নির্যাতিত নারীরা জীবিকার সন্ধানে শহরমুখীও হচ্ছে অনেকে। তারা কেউ কেউ ভয়াবহ বিপদের মুখোমুখি। বেশির ভাগ নারীরা পোশাক শিল্পে কর্মসংস্থান করে সাবলম্বি হচ্ছে। বিভিন্ন বাসা-বাড়িতে গৃহকর্মীর কাজ করে অনেকে।
জায়েদা নামের গৃহকর্মী। সে জানায়- “কপাল মন্দ বইলা মাইনসের বাসাত কামে আইছি। আমার দেওয়রের হের শশুর বাড়িত থাইক্যা পঞ্চাশ হাজার টেকা দেওনের কথা আছিল, কিন্তু বছর ঘুইরা বছর আইল তবু টেকা দেওনের নাম-গন্ধ নাই। ‘বাপের বাড়িত থাইক্যা টেকা-পয়সা না আনলে হেই সংসারে অলক্ষী ছাড়ে না’। দেওরে হেরে এমন পিটনা দেয় তবু কুনু শরম নাই, একদিন পিটনা খাইয়া দাঁতি লাগজে (জ্ঞান হারা)। শেসৈ জাইজিন খাইয়া মইরা গেছে। অহন হেই কেউছে আমরারেও আসামী বানাইছে। অহন হাজিরা দিতে মুমেনসিং(ময়মনসিংহ) যাওয়ন লাগে মাসে মাসে।”
বাসার সামনে রাস্তার ধারে এক খালা পিঠা বানিয়ে বিক্রি করে। সেই খালার নিকট থেকে জানা গেল দুই/তিন জ্বীন-পরীর ঘটনা।
প্রায় দশ বছর ধরে (আনুমানিক দশ বছর) এক মহিলাকে দেখছি- বাসার আশে-পাশে, জহুরা মার্কেটের রাস্তায় চলা ফেরা করে। এলাকায় সবার জানামতে সে পাগলি, তার কোনো রাত দিনের পার্থক্য নেই। যেখানে সেখানে ঘুমিয়ে থাকে। যখন তখন হল্লা-চিল্লা করে। তবে তাকে কেউ কিছু বলে না।
সেদিন পিঠা কিনতে যেয়ে দেখলাম পাগলি মহিলা চেচামেচি করছে। পিঠা তৈরির খালাকে (খালার সাথে অনেকদিনের পরিচয়, ফল ও শাক-সব্জি বেচে) জিজ্ঞেস করলাম এমনটি কেন করছে? খালা সংক্ষেপে বলল, জ্বীনের আছর আছে। তারপর খালা বলল, তার নিজের সাথেও জ্বীন আছে (নিজের কথা বলার উৎসাহে মহিলার কথা সংক্ষিপ্ত করল) এবং তার বার/তের বছরের ছেলের উপর পরীর আছর। গর্ভে থাকা অবস্থায়ই নাকি ছেলেটির উপর পরীর দৃষ্টি পড়েছিল। পরী প্রায়ই ছেলেটিকে উধাও করে ফেলে, যখন বাড়ি ফিরে, তখন নিজেরা এবং লোক দিয়ে বেঁধে মার-ধর করতে হয়। খালা বলল, আজও প্রচন্ড মেরেছে ছেলেটিকে।
মূলত অজ্ঞতার বসে কুসংস্কারে আচ্ছন্ন হয়ে এরা ছেলেটাকে মারছে। ছেলেটি নোশ-ভানে অভ্যস্ত হয়ে পড়বে।
আর পাগলি মহিলাটি, কিছুটা জেনেছি বাকিটা অনুমান- মহিলাটি তো অবশ্যই কোন না কোন পরিবার থেকে এসেছে। হয়তো তার একটি সাজানো সংসার ছিল। মহিলাটি কারো কন্যা, কারো স্ত্রী, কারো মা। হতে পারে মহিলাটি চারপাশের নির্যাতনে দিশেহারা হয়ে রাতের অন্ধকারে বের হয়ে এসেছে নিজ আলয় থেকে। বাড়ির মান-সম্মান নষ্ট হবে অথবা জ্বীন ভূতে উধাও করে ফেলেছে, এই ভেবে তার খোঁজখবর নেয়ার প্রয়োজন বোধ করেনি কেউ। মহিলাটির সাথে প্রায়ই কথা বলার চেষ্টা করেছি, কিন্তু সে নিজেকে আড়াল করে রাখে। ধারণা করা যায় মহিলাটি মোটেও পাগল নয়।
আট/নয় বছর বয়সের একটি ছেলে। মাদ্রাসায় পড়ে। পড়ায় ভীষণ অমনযোগী। মাদ্রাসা থেকে ফেরত এনে এখন আবাসিক মাদ্রাসায় দেয়ার চিন্তা ভাবনা চলছে। এখানেও ধরে নেয়া হয়েছে, ছেলেটিকে জ্বীন-পরীতে উদাসিন বানিয়ে রেখেছে।
বিজ্ঞান আজ কত বেশি অগ্রসর অথচ এখনো মানুষ দৈত্য-দানব, জ্বীন, পরী, ভূত-পেত্নির অন্ধকারে নিমজ্জিত। জ্বীন ভূতের আছর ছাড়ানার জন্য আক্রান্ত ব্যক্তির উপর চলে মার-ধর। আর অন্যান্য রোগের চিকিৎসায় গ্রাম্য হাতুরে ডাক্তারের ভুল চিকিৎসা, অথবা পানি পড়া, ঝাড়-ফুক, তাবিজ কবচ।
মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ পল্লি সাহিত্য প্রবন্ধে লিখেছেন, “পল্লির প্রত্যেক পরতে পরতে পল্লি সাহিত্য ছড়িয়ে আছে।” তেমনি পল্লির মাঠে, পথে-ঘাটে, বনে-বাদারে, ঘুরে দুয়ারে; সকাল-দুপুর-সন্ধ্যা রাত নিশিতে ছড়িয়ে আছে কুসংস্কারের ঘুটঘুটে অন্ধকার। এই অন্ধকার থেকে বেড়িয়ে আসা আজ বড় বেশি প্রয়োজন। এই অন্ধকারই মনে করিয়ে দেয় কবির সেই কথা-
মেঘ দেখ কেউ করিস নে ভয়
আড়ালে তার সূর্য হাসে
হারা ধনের হারা শশী
অন্ধকারেই ফিরে আসে
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)