চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

আরেকটি ৭ নভেম্বরের অলীক স্বপ্নে বিএনপি

আজ থেকে ৪০ বছর আগে ১৯৭৫ সালের এসময়ে ঢাকা সেনানিবাসের বাসায় গৃহবন্দী ছিলেন বেগম খালেদা জিয়া। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর সেনাপ্রধান হওয়া মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে ক্ষমতার দৃশ্যপট থেকে সরিয়ে দিতে গৃহবন্দী করা হলে স্ত্রী হিসেবে খালেদা জিয়াও সরকারি বাড়িতে বন্দি হয়ে যান। গৃহবন্দিত্ব দীর্ঘস্থায়ী হলে খালেদা জিয়া কী সিদ্ধান্ত নিতেন সে বিষয়ে খুব নিশ্চিত করে কিছু বলা যায় না। কারণ তার বছর চারেক আগে স্বামী জিয়াউর রহমান যখন মুক্তিযুদ্ধ করছিলেন তখন জিয়া একাধিকবার তাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য গেরিলা দল পাঠালেও খালেদা যাননি। তবে ৭৫-এ পরিস্থিতি সেরকম হয়নি। কয়েকদিনের মাথাতেই ৭ নভেম্বর পাল্টা অভ্যুত্থানে জিয়াউর রহমান মুক্ত হওয়ার পর প্রথমে তাকে আটক করা মেজর জেনারেল খালেদ মোশাররফ এবং পরে তাকে মুক্ত করা কর্নেল তাহেরকে হত্যা করেছেন।

চার দশক পর খালেদা জিয়া তিনবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আজ ওইরকম বন্দিদশায় না থাকলেও এক ধরণের রাজনৈতিক উদ্বাস্তুর জীবনে আছেন। তার কিছুটা নিজের রণকৌশলগত ভুলে, কিছুটা সরকারের দমনমূলক আচরণের কারণে। তবে তার চেয়েও বেশি ক্ষমতায় থাকার সময় দুর্নীতি-অপশাসন ও ক্ষমতা চিরস্থায়ী করার লোভ থেকে ওয়ান ইলেভেনকে ডেকে আনার কারণে এবং স্বাধীনতাবিরোধী রাজনৈতিক শক্তি আর তাদের সহায়ক জঙ্গি সংগঠনগুলোর সঙ্গে চিরস্থায়ী মুখচুম্বনের রাজনীতির কারণে।

নয় বছর ধরে ক্ষমতার বাইরে থাকা খালেদা জিয়া তাই রাজনৈতিক উদ্বাস্তুর জীবন শেষ করে সপুত্র ক্ষমতায় ফিরতে উদগ্রীব। রাজনীতির লক্ষ্য যেহেতু রাষ্ট্রক্ষমতা তাই তার এই উদগ্রীবতাকে দোষ দেওয়া যাবে না। তবে সমস্যা হচ্ছে ক্ষমতায় ফিরতে তিনি এখন ৭৫’র ৭ নভেম্বরের মতো ঘটনার অপেক্ষায় আছেন।

লন্ডন থেকে তিনি তাই বিবৃতিতে জাতীয় সংলাপ এবং নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে অনতিবিলম্বে নির্বাচনের কথা বললেও তার উপদেষ্টা এবং দলের নেতারা আকারে-ইঙ্গিতে সেটা বুঝিয়ে দিচ্ছেন।

কয়েকদিন আগে সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কৌতুকের ছলে বিএনপি নেত্রীর মনে মনে যে আশা থাকার কথা বলেছিলেন সেটা বিএনপি নেতা এবং পরামর্শকরা বলতেও শুরু করছেন।

দৈনিক ইত্তেফাকের সংবাদ অনুযায়ী, দেশে যে কোনো মুহূর্তে বড় ধরনের অঘটনের আশঙ্কা করছেন বিএনপির চিন্তক হিসেবে পরিচিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক এমাজউদ্দিন আহমদ। তিনি বলেছেন, এই অবস্থার অবসান হওয়া দরকার। ৭ নভেম্বর ‘জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস’ উপলক্ষে বৃহস্পতিবার জাতীয় প্রেসক্লাবে স্বাধীনতা ফোরাম কেন্দ্রীয় সংসদ আয়োজিত এক আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এরকম কথা বলেন।

এমাজউদ্দিন বলেন, দেশে শিক্ষক-শিক্ষার্থী-ব্যবসায়ী-জনতা— কারও মধ্যেই ঐক্য নেই। জাতি দুইভাগে বিভক্ত হয়ে গেছে। এটা জাতির অস্তিত্বের জন্য বড় হুমকি। ক্ষমতাসীন নীতিনির্ধারকদের এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য ভেবে দেখা উচিত। একইসঙ্গে সুশীল সমাজকেও এগিয়ে আসতে হবে। তিনি বলেন, এখন যা হচ্ছে, ২-৩ বছর আগেও এটা ছিল না।

সভার প্রধান বক্তা বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আব্দুল্লাহ আল নোমান ‘অরাজনৈতিক ধারায় পরিবর্তন কাম্য নয়’ বলে সেদিকেই ইঙ্গিত দিয়েছে। নোমান বলেছেন, বর্তমান পরিস্থিতি সরকার যদি উপলব্ধি না করে তাহলে আমরা জানি এর পরিণতি রাজনৈতিক ধারায় হবে না। অরাজনৈতিক ধারায় কোনো পরিবর্তন দেশের মঙ্গল আনতে পারে না। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা হচ্ছে সবচেয়ে উত্তম।

সভায় বিএনপির আরেক ভাইস চেয়ারম্যান সেলিমা রহমানও বক্তৃতা করেন।

ওই আলোচনা সভার দিনই বিএনপি একটি মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করে। জঙ্গি হামলায় নিহত ফয়সল আরেফিন দীপনের জন্য মিলাদের আয়োজন করে। ট্র্যাজেডি হচ্ছে কথিত নাস্তিক হত্যার ধারাবাহিকতায় দীপনকে হত্যা করা হয়েছে আর যাদেরকে নাস্তিক বলে হত্যা করা হচ্ছে তাদেরকে নাস্তিক ঘোষণা করেছিলেন স্বয়ং বেগম খালেদা জিয়া।

ওই মিলাদ থেকেও জাতীয় সংলাপ শুরুর তাগিদ দেওয়া হয়েছে। আমাদের জ্ঞানী-গুণী বুদ্ধিজীবীদের কেউ কেউ একইরকম কথা বলছেন। কিন্তু, সংলাপটা কার সঙ্গে কার হবে? যে রাষ্ট্রীয় মূল আদর্শই অস্বীকার করে তার সঙ্গে সংলাপ হবে কিভাবে?

বুদ্ধিজীবীদের কেউ কেউ এক্ষেত্রে রিকন্সিলিয়েশনের কথা বলতে গিয়ে সাউথ আফ্রিকার উদাহরণ টানেন। এখন তারা সিঙ্গাপুর বৈঠকের দিকে ইঙ্গিত করে বলছেন চায়না এবং তাইওয়ানের কথা।

কিন্তু, তারা ভুলে যান সাউথ আফ্রিকা নতুনভাবে স্বাধীন হওয়ার পর: ১. হোয়াইটরা আর আগের ব্যবস্থায় ফিরে যাবার কথা ভুলেও ভাবেনি। ২. বর্ণবাদী আদর্শ পুন:প্রতিষ্ঠার জন্য তারা কোনো তথাকথিত আদর্শিক বা রাজনৈতিক সংগ্রাম শুরু করেনি।

এখন যদি তাইওয়ান মূল চায়নার অংশ হয়ে যায় (যদিও সেটা অনেক দূরের বিষয়) তাহলে: ১. তারা চায়নাকে চায়না বলেই জানবে। ২. চায়নাকে তারা তাইওয়ান বানানোর কোনো শক্তি প্রয়োগের রাজনীতিতে যাবে না।

এখন আসুন বাংলাদেশ প্রসঙ্গে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু যে কাজ করেছিলেন: ১. পাকিস্তানী আদর্শের রাজনীতি যেনো ফিরে আসতে না পারে সেজন্য ওই দলগুলোকে নিষিদ্ধ ঘোষণা। ২. রিকন্সিলিয়েশনের অংশ হিসেবে চার ধরণের মানবতাবিরোধী অপরাধী ছাড়া অন্যদের সাধারণ ক্ষমা।

কিন্তু, পাকিস্তানী ভাবাদর্শে অনুপ্রাণিতরা বঙ্গবন্ধু এবং জাতীয় চার নেতাকে হত্যার পর জিয়াউর রহমান তাদেরকে রাজনীতি করার সুযোগ দেওয়ার পর জামায়াত: ১. যে তথাকথিত আদর্শ থেকে তারা বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্মের বিরোধিতা করেছিলো সেই আদর্শ প্রতিষ্ঠার রাজনীতি অব্যাহত রেখেছে। ২. ওই তথাকথিত আদর্শ যেহেতু শক্তি প্রয়োগের রাজনীতি তাই তারা রগ কাটা দিয়ে শুরু করে আজকের জঙ্গিবাদী সংগঠন প্রতিষ্ঠা এবং তাদের লালন-পালনের সব ব্যবস্থা করেছে।

সুতরাং, বাংলাদেশে যে কোনো রিকন্সিলিয়েশনের জন্য: ১. একাত্তরে যে আদর্শে থেকে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম, সকলের রাজনীতির ভিত্তি হতে হবে সেই আদর্শ। ২. যে তথাকথিত আদর্শ থেকে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্মের বিরোধিতা, চিরদিনের জন্য সেই রাজনীতি নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে হবে।

এই শর্ত মেনে খালেদা জিয়া কি কোনো সংলাপে আসতে পারবেন? তিনি যে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তিরও প্রধান নেত্রী!

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)