চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ

‘আমি সাহসী, আনিস চলে যাওয়ার পরও সব করছি’

প্রবেশ পথে জ্বলছে শতাধিক প্রদীপ। প্রদীপের আলোয় উদ্ভাসিত তার স্নিগ্ধহাস্যের বড় ছবি। শুভ্র চন্দ্রমল্লিকায় সাজানো মঞ্চ। সঙ্গে গ্ল্যাডিওলাস। এখানেও রয়েছে ছবি। তিনি এখন কেবলই ছবি।  শুভ্রতার সঙ্গে হারিয়ে ফেলার বেদনা মেশা মাঘের সন্ধ্যা। হারিয়ে ফেলাইতো। তাকে হারিয়ে ফেলেছে বাংলাদেশ। বড় অকালে। স্মরণের শুরুতে  ‘তুমি রবে নীরবে’ গেয়ে ওঠেন বুলবুল হোসেন। অলক্ষ্যে থেকেও তিনি ফিরে আসেন। আনিসুল হক। আপাদমস্তক স্বপ্নবাজ তিনি নিজেকে শিল্পী ভাবতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন। অমেয় ভালোবাসার নিবেদনে সুরে-সঙ্গীতে আর স্মৃতিচারণে তাকে স্মরণ করল রাজধানী।

বাংলা একাডেমীর আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ মিলনায়তনে ‘শিল্পীর পাশে ফাউন্ডেশন’ এর আয়োজনে অনুষ্ঠিত হয়েছে আনিসুল হক স্মরণ অনুষ্ঠান।

২০১০ সালে ক্যামেলিয়া মুস্তাফার অসুস্থতায় আনিসুল হকের কাছে অনেকেই গেলে তিনি বলেছিলেন এভাবে একজন শিল্পীর চলতে পারেনা। স্থায়ীভাবে তাদের জন্য তহবিল করতে হবে। তিনি ভোলেননি। করে দেখিয়েছিলেন। বন্ধু লাকী আখন্দের পাশে দাড়াতে গিয়ে ২০১৬ সালে গড়ে তোলেন ‘শিল্পীর পাশে ফাউন্ডেশন’। সে বছর ১৮ নভেম্বর ১৭ জন ট্রাস্টি নিয়ে যাত্রা শুরু করে ফাউন্ডেশন। যিনি দুঃস্থ শব্দটি একদম অপছন্দ করতেন। শিল্পী কখনও দুঃস্থ হতে পারেনা বলে মানতেন তিনি। ২৩ দিনে সবার সঙ্গে একক ভাবে যোগাযোগ করে ২ কোটি ৩০ লক্ষ টাকার তহবিল তৈরী করেছেন। যেখান থেকে এখন পর্যন্ত ৩৮ জন শিল্পী নানাভাবে সহায়তা পেয়েছেন। সদ্য প্রয়াত শিল্পী শাম্মী আখতারকে ১০ লক্ষ টাকা সহায়তা করেছিল ‘শিল্পীর পাশে ফাউন্ডেশন’।

সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর স্মরণ অনুষ্ঠানে বলেন, ১৯৭৪ সালে অভিনয় শুরু করি। তার কিছু পরে সম্ভব ৭৬/৭৭ এ শুরু করে সে। সম্পর্ক হয়ে গিয়েছিল। তারা কাজ আমরা উপভোগ করতাম আনন্দ পেতাম। বার্তাও পেতাম। রাজনীতিতে আসার সময় জিজ্ঞাসা করেছিল কি ঠিক করলাম? আমি বলেছিলাম, অবশ্যই।’  তিনি আরো বলেন, ‘আনিসের সঙ্গে শেষ দেখা হয়েছিল লাকী আখন্দের স্মরণ সভায়। তার চিকিৎসায় যে ব্যাকুলতা তার ছিল এটি আমাকে এখনও আপ্লুত করে।এত ভালো আবৃত্তি করত তারপরও সে আমার কাছে আবৃত্তি শিখতে চেয়েছে। সব কিছু মিলে আনিসুল হক একজন পরিপূর্ণ বাঙালি এবং মানুষ। যে শিল্পীদের জন্য নিজেকে বটগাছের ভূমিকায় নিয়েছিল।

ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘তার মৃত্যুশয্যায় ঢাকায় যে গুজব ছড়িয়েছে তা ছিল খুব বেদনাদায়ক। যারা গুজব ছড়িয়েছে তারা আনিসের দূরের ছিলনা।’

শিল্পীর পাশে ফাউন্ডেশনের সভাপতি ইমেরিটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বলেন, ‘সাধারণ মানুষের জন্য অপার মমতা ছিল তার। তার গড়া ফাউন্ডেশন আমরা টিকিয়ে রেখে তার প্রতি যথার্থ শ্রদ্ধা জানাব।’

অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, ‘তার বয়স ছিল একটাই, তারুণ্য। আমাদের মধ্যে সবচেয়ে তরুণ ছিল। রুবানা আমার ছাত্রী ছিল। প্রাণখোলা, স্পষ্ট কথা বলত। অস্থিরমতি। অস্থিরতা যে সব সময় খারাপ তা নয়। বরং উদ্যোগ নেওয়ার তীব্র তাগিদ ছিল। সব কিছু পাল্টে দেওয়ার স্বপ্ন ছিল তার। ঢাকার সবগুলো দেওয়াল সুশোভিত করার ইচ্ছা ছিল। ঢাকাকে পরিকল্পিত নগরীর এবং গোছানো। সে রাজনীতিকে পাল্টে দিয়েছিল। সে একটা মাপ এবং উচ্চতা তৈরী করে দিয়ে গেছে। তার পথে রাজনীতি হাঁটলে বাংলাদেশ অননুকরণীয় উচ্চতায় পৌঁছে যাবে। তার শূণ্যতা পূরণ হবে কি না জানিনা তবে তাকে অনুক্ষণ মনে পড়বে।

কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন বলেন, অনেক অনুজ হলেও তার প্রজ্ঞা ও জ্ঞান দিয়ে তিনি নিজে অনুসরণীয় করে তোলেন। টিভি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তকে আমি প্রথম চিনি। একজন মানুষকে যেভাবে পরিচর্যা করতেন তা ভাবলেই বিস্ময় জাগে। ফোরিয়া লারার মৃত্যুর পর ফাউন্ডেশন তৈরীর কাজেও তিনি পাশে দাড়িয়েছেন। উন্নয়ন মানে ইঠ-কাঠ-পাথর হবেনা তা সৃজনশীল হবে এ বিশ্বাসে তিনি পথে নেমেছিলেন। আনিসুল হকের মৃত্যু অপূরণীয় ক্ষতি। মেনে নিতে পারিনা এখনও।

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ বলেন, সাধারণত কারও মৃত্যু হলে আমি খুব কম গেছি। তার মানে এইনা মৃত্যু আমি এড়িয়ে চলি বা সেই মানুষকে অশ্রদ্ধা করি। জীবিত মানুষকে মনে রাখতেই আমি মৃত্যুতে যাইনা। তার সঙ্গে অনেক স্মৃতি অনেক কথা। বলে শেষ করা যাবেনা। তিনি মারা যাওয়ার পর সমস্ত শহর কেঁদেছে। তিনি রাজনীতি বিবর্জিত ছিলেন না। আমাদের এখানে রাজনীতিতে অন্য দলের কারো মৃত্যু হলে এক ধরণের খুশি হওয়ার প্রবণতা দেখা যায়। শহরের মানুষের স্বপ্নের সঙ্গে একাত্ম হতে পেরেছিলেন। সেই স্বপ্ন পূরণও সম্ভব তা তিনি দেখিয়েছিলেন। আমি করবই এই মনোভাবই তাকে সাফল্য দিয়েছে।’

তার ছবির দিকে প্রায় সারাক্ষণ চোখ রেখে জাদুশিল্পী জুয়েল আইচ বলেন, আনিস আসার আগে টেলিভিশনের উপস্থাপকরা যেন ছিল একে অপরের শত্রু। সে প্রথম সবার বন্ধু হয়। আমাদের কয়েকজন বন্ধুর একটা গ্রুপ ছিল। যাদের গাড়ি ছিলনা। সেই প্রথম কিনল। সে সবসময় আলাদা কিছু করার কথা ভাবত। যা অন্য কেউ ভাববেনা তাই ভাবত। আমি আর কিছু বলতে পারছিনা। কান্না এসে পড়বে। খুব কষ্ট হচ্ছে আনিস। আমরা চেষ্টা করব তোমার স্বপ্ন পূরণে।

শিল্পীর জন্য ফাউন্ডেশনের ট্রাস্টি শিল্পী সৈয়দ আব্দুল হাদী বলেন, তার সঙ্গে পরিচয় ঘনিষ্ঠতা দীর্ঘ দিনের। কিন্তু ফাউন্ডেশন নিয়ে কথা বলার সময় তার মনে শিল্পীর জন্য অফুরন্ত ভালোবাসার ঝর্ণার খোঁজ পেয়েছি। স্বপ্নাক্রান্ত জাতি হলেও তা বাস্তবায়নের সফলতার উদাহরণ তিনি তৈরী করেছেন।

আবেগে ভাসিয়ে দিয়ে প্রয়াত আনিসুল হকের স্ত্রী  রুবানা হক বলেন, নিজের ক্যানভাসটা নিজের মত করে এঁকে চলে আনিস। আমি এখনও ভাবতে চাইনা আনিস নেই। প্রতিদিন সকালে ওই সময়টাতে মনে হয় নীল পাঞ্জাবী পরে ও বের হচ্ছে। আমার সন্তানদের মাঝে, শরাফের পাঠশালায় নিরন্তর আমি ওকে ফিরে পাই। আমি সাহসী। ও চলে যাওয়ার পরও সব করছি। আমাদের টেলিভিশন নাগরিক আসবে সামনের মাসে। তারপরও (কান্না) প্রতিমুহূর্তে ওকে অনুভব করি। (আবেগ নিয়ন্ত্রণে এনে) আমি শুধু স্বামী হারাইনি, বন্ধু-প্রেমিক হারাইনি, বরং আমার প্রায় পুরোটাই হারিয়েছি। ওতো আমার জীবনের আক্ষরিক অর্থে ৯০ ভাগ ছিল। এখন আমি ১০ ভাগ হয়ে বেঁচে আছি।’ রুবানা হক আরো বলেন, জীবন কঠিন বরং মৃত্যু সহজ। এক জীবনে অনর্থক আমরা লড়াই করি। মৃত্যুকে মেনে নিয়ে জীবনকে সাজানো উচিত আমাদের।

শিল্পীর পাশে ফাউন্ডেশনের মহাসচিব ওমর সাদাত বলেন, ‘যে আলো জ্বালিয়ে দিয়ে গেছেন কয়েক দশকে এবং এই প্রতিষ্ঠানের তা কখনও নিভবেনা।’

অনুষ্ঠানে আরো বক্তব্য রাখেন ব্যবসায়ী অঞ্জন চৌধুরী পিন্টু, বেঙ্গল এর কর্ণধার আবুল খায়ের লিটু এবং টিভি ব্যক্তিত্ব নওয়াজিশ আলী খান। অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করেন আবদুন নূর তুষার।

অনুষ্ঠানে ঢাকা সিটি কর্পোরেশনে উত্তরের আওয়ামী লীগ মেয়র পদপ্রার্থী আতিকুল ইসলাম উপস্থিত ছিলেন। তিনি বলেন, ‘আনিস ভাইয়ের কোন ক্ষয় নাই। মানুষের জন্য যে কাজ করে গেছেন তা অব্যহত রাখতে হবে। তিনি যে এজেন্ডা ফিক্সড করে গেছেন তা বাস্তবায়ন করলেই নগরী সেজে উঠবে।’

অনুষ্ঠানের শুরুতে দ্বিতীয়‘মৃত্যু নাই নাই দুঃখ আছে শুধু প্রাণ’ নজরুল সঙ্গীতটি গেয়েছিলেন খায়রুল আনাম শাকিল। শারমীন সাথী ইসলাম গেয়েছেন ‘সবারে বাসরে ভালো, নইলে মনের কালো ঘুঁচবেনারে’। অনুষ্ঠান শেষে অনুভূতিটি সবার মাঝেই বিরাজ করেছে যে, যিনি সবাইকে ভালোবেসে ঘুঁচিয়েছেন সমাজের মনের কালো তার মৃত্যু নেই।