ঢাকার অদূরে টঙ্গী’র গোপালপুর শিশু বিদ্যানিকেতন একালার জীর্ণশীর্ণ একটি সরু গলির বস্তিতে রবিবার সকাল থেকে ‘রাজন দ্য কিং’ নাটকের শুটিং করছিলেন জনপ্রিয় অভিনেতা মোশাররফ করিম। সন্ধ্যায় শুটিং বিরতিতে তিনি আলাপ করতে বসেন চ্যানেল আই অনলাইনের সঙ্গে:
শুরুতেই জানতে চাই ‘রাজন দ্য কিং’ নাটকটি নিয়েই?
মুরসালিন শুভ’র গল্প ও পরিচালনায় ‘রাজন: দ্য কিং’ নামের একটি নাটকের শুটিং এর জন্য এমন জায়গা নির্বাচন করা হয়েছে। নাটকের চিত্রনাট্য লিখেছেন অপূর্ণ রুবেল। নতুন নতুন কাজের অংশ হিসেবেই এমন ‘র’ লোকেশনে কাজ করছি। অপরাধ জগতের গল্প এবং সেখান থেকে বেরিয়ে আসার গল্প। গল্পে অনেক প্যাচ রয়েছে। টিভিতে এমন গল্পের কাজ কম হয়েছে। মনে হচ্ছে কাজটি আমাকে তৃপ্তি এনে দেবে। আমি আমার জায়গা থেকে খুব সন্তুষ্ট এই কাজটি নিয়ে।
সর্বশেষ ঈদে দেখেছি আপনার কাজের সংখ্যা আগের তুলনায় কম। এই পরিবর্তনের ভাবনাটা কেন আসলো?
যেকোনো ক্রিয়েটিভ ক্ষেত্রে পরিবর্তন দরকার। আমি নিজে অনেকবার ভেবেছি তৃপ্তির ব্যাপারটা আসলে কোথায়! সম্পত্তি, গাড়ি, বাড়ি ওগুলো আমাকে তৃপ্তি দেয় না। একটা দৃশ্য যখন মনের মতো করে ‘ওকে’ হয় তখনই আমার কাছে আসল তৃপ্তিটা আসে। যতটুকু পরিবর্তনের চেষ্টা করেছি শুধুমাত্র তৃপ্তি পাওয়ার ও দেয়ার জন্য। আরেকটা বিষয় হলো, আমি নতুন ধরণের কাজ করতে চাই।
কী ধরণের কাজ আপনাকে তৃপ্তি দেয়?
এটা আনলিমিটেড এবং একজন অভিনেতার চাওয়া-পাওয়া আনলিমিটেডই হওয়া উচিত। কিন্তু আমাদের উপমহাদেশে একটা জিনিস দেখা যায়, কিছু হিট হলে সবাই তার পিছনেই ছোটে। মাথা না কাটিয়ে ওই অনুকরণে চলতে থাকে। এতে হয় কি, যারা ক্রিয়েটিভ না তাতেই তাদের হয়ে যায়। এটা একটা বন্ধ্যাত্য নিয়ে আসে। কিন্তু আমরা যারা একটু সৃষ্টিশীল কাজ করতে চাই, শিল্পসম্মত কাজ চাই তারা একটু অসহায় হয়ে যাই।
অনেকের অভিযোগ নাটকের মধ্যে অশ্লীল সংলাপ, পোশাক এবং সুড়সুড়ি মূলক দৃশ্য বাড়ছে। আপনার কাছে বিষয়টি কেমন মনে হয়?
খেয়াল রাখতে হবে নাটকের দর্শকরা ফ্যামিলি ম্যাটারিয়াল। বাবা, মা, ভাই, বোন সবাই একসঙ্গে বসেই কিন্তু নাটক দেখে। সেই ক্ষেত্রে এমনকিছু করা উচিত নয় যে বাবা, ছেলে, মেয়ে, মা পাশাপাশি বসে থাকার পর নাটকের ওগুলো দেখে প্রত্যেকেই উঠে গেল। আমার কাছে মনে হয়, এগুলো না হওয়াই ভালো। তবে কখনও কখনও কোনো ভিন্ন গল্প বলতে গেলে দু-একটি ‘স্ল্যাং ওয়ার্ড’ অপরিহার্য হয়ে দাঁড়ায়! এতে আরও বেশি জীবন্ত হয়ে ওঠে ব্যাপারটা। সেক্ষেত্রে ওই শব্দ ব্যবহার করে ‘মিউট’ করা যেতে পারে। অন্যথায় শুধুশুধু গালমন্দের প্রয়োজন নেই। যদি কারও উদ্দেশ্য থাকে ‘স্ল্যাং ওয়ার্ড’ ব্যবহারের ফলে কিছু ভিউজ বাড়বে তাহলে সেটা ভালো উদ্দেশ্য না। সবকিছুর সঙ্গে শিল্প সচেতনার পাশাপাশি সমাজ সচেতনা থাকতে হবে।
এক্ষেত্রে দায়বদ্ধতা বেশি কার, নির্মাতা নাকি অভিনেতা-অভিনেত্রীদের?
প্রধানত নির্মাতার। কারণ এটা ডিরেক্টরস মিডিয়া। তবে একজন শিল্পীর সততা সবচেয়ে বেশি জরুরী। যেহেতু কাজটির বিচার করা যাচ্ছে না, তাই শিল্পী নিজেই বিচারক। কোন উদ্দেশ্যে ‘স্ল্যাং’ ব্যবহার করা হচ্ছে ওই শিল্পীই ভালো জানেন। সে কি একটি নির্দিষ্ট জেনারেশনের দর্শক ধরার জন্য বলছেন নাকি আসলেই স্ল্যাং শব্দটা অপরিহার্য ছিল! সবকিছুর সাথে ভাবতে হবে কাজগুলো দেখবে কারা।
অনেক সংকটের মধ্যেও নাটকের সার্বিক অবস্থা কেমন দেখছেন?
নাটকের সার্বিক অবস্থার কথাটা আনন্দিত, এমনটা বলতে পারলে ভালো লাগতো। কিন্তু পারছিনা। কারণ, এভাবে চলা উচিত না। তবে আমি বিস্মিত। এ জন্য বিস্মিত যে, এতো সংকটের মধ্যেও এতো ভালো নাটক হচ্ছে কীভাবে! বাজে কিছু কাজ হলেও অসংখ্য ভালো কাজ হচ্ছে এগুলো আমাকে বিস্মিত করছে। এখানে ভালো কাজ উপহার দেয়ার মতো সেই মানের কোনো ইন্সটিটিউশন নেই। যেখানে থেকে বড়বড় ক্যামেরাম্যান বের হবে, এডিটর বের হবে, অভিনেতা বের হবে, পরিচালক বের হবে। ইন্ডিয়াতে শতশত ইন্সটিটিউশন। সেখান থেকে লেখাপড়া করে শিখছে বিধায় তারা ভালো কাজ উপহার দিতে পারছে। আমাদের এখানে শেখার প্রতিষ্ঠান কোথায়? তাহলে ভালো কাজ আসবে কোথা থেকে? তারপরেও এতো ভালো ভালো কাজ হচ্ছে যা দেখে বিস্মিত না হয়ে উপায় নেই। আমাদের দেশে গোটা বিশেক ক্যামেরাম্যান আছেন একেবারে আন্তর্জাতিকমানের। তারা কই থেকে তৈরি হলো? তারা কিন্তু নিজেদের তৈরি করেছেন দেখে, শিখে। এভাবে পরিচালক, অভিনেতাও তৈরি হচ্ছে। তবে অভিনেতাদের ক্ষেত্রে থিয়েটার আছে শেখার জন্য। কিন্তু থিয়েটার কখনও ক্যামেরাম্যান বানাতে পারবে না। আমরা এই দিকগুলো ভাবছি না। শুধু বলছি, এখানে ভালো নাটক হচ্ছে না। আমার প্রশ্ন হলো, হতেই হবে কেন? তেমন কিছু তো নেই, তাহলে কই থেকে হবে? শিক্ষার জায়গায় নাই বিধায় ‘প্রফেশনাল অ্যাটিচিউট’ বা সঠিক কাজের প্রক্রিয়া তৈরি হয়নি।
নাটকে নাকি গ্রুপ্রিং চলছে! কোরামের বাইরে কয়েকজন কাজ ই করছেন না?
আমি এসব বিষয়ে খুব একটা জানি না। তবে আমার কাছে মনে হয় আর্টের জায়গাটা খুব বেশি বদ্ধ করতে পারিনা। আমি মনে করি, আমি যে নাটকে অভিনয় করি আমার বিপরীতে কে অভিনয় করবে সেটি প্রধানত নির্ধারণ করবেন পরিচালক। তার আগে উনি আমার সাথে আলোচনা করতে পারেন যে অমুককে নেয়ার কথা ভাবছি। এটা হতে পারে! কিন্তু আমরা আর মামারা মিলে কাজ করলাম, আর কেউ করবে না; পৃথিবীর কোথাও এমনটা আছে কিনা আমার জানা নেই। এর আগে একই নাটকে ফরিদী ভাই, আফজাল ভাই, তারিক আনামকে দেখেছি। আমি, চঞ্চল, মিলনসহ অনেকেই একই নাটকে কাজ করেছি। কিন্তু নির্দিষ্ট শিল্পী ও পরিচালকদের সঙ্গে কাজ শিল্পের ক্ষেত্রে বন্ধ্যাত্ব নিয়ে আসবে। আমি আমার ক্ষেত্রে বলছি, পৃথিবীর কোনো শিল্পীর সঙ্গে আমার কাজ করতে অসুবিধা নেই যদি কাজটি ভালো হয় এবং আমার মনে তৃপ্তি এনে দেয়ার ক্ষমতা রাখে।
অনেকেই চড়া পারিশ্রমিক দাবী করেন। এতে বাজেটের অর্ধেকই চলে যায়, এর প্রভাব কি সামগ্রিকভাবে একটি ভালো নাটক না হওয়ার অন্তরায় নয়?
একজন শিল্পী পারিশ্রমিক চাইতেই পারে। কারণ তিনি কারও চাকরী করেন না। সে তার পেমেন্টই নিচ্ছে। তবে শিল্পীর পারিশ্রমিক চাহিদার ধরণটা সবক্ষেত্রে একই হওয়া উচিত। এতে বাকি শিল্পীদের পেমেন্ট থাকছে না কারণ সেখানে বাজেট সংকট। এই সংকটের কারণে বহু আগেই নাটক থেকে ভালো মেকআপ আর্টিস্ট, শিল্প নির্দেশক, কস্টিউম ডিজাইনার সরে গেছে।
ফেসবুক সেলেব্রেটি থেকে অভিনেতা-অভিনেত্রী বনে যায়। এই প্রক্রিয়াটা কীভাবে দেখেন?
দুদিন আগে আমাকে ঠিক এমনই একজন বলেছিল, আমাকে একটু সুযোগ দেন আমি অভিনয় করবো। মজা করে আমি তাকে বলেছিলাম, মনে করেন আপনি অসুস্থ। এখন আমি ডাক্তার হয়ে আপনার চিকিৎসা করবো! ব্যাপারটা তো তাই!
নতুন সিনেমায় কাজে খবর?
নতুন কোনো সিনেমা নিয়ে খবর নেই। এটা যে করতেই হবে আমার কাছে বিষয়টা এমন না। চরিত্র আর গল্প ভালো হলে কাজ করবো। আর তা না হলে জীবনে একটি সিনেমাও করা হবে না। কয়েক বছরে বেশ কিছু ভালো সিনেমা হয়েছে আমাদের দেশে। এই ধারাবাহিকতা ধরা রাখা প্রয়োজন। শুটিংয়ে আসার সময় দেখলাম ভিনদেশি সিনেমার পোস্টার রাস্তায়, দেয়ালে দেয়ালে ঝুলছে। অথচ আমাদের দেশের একটি সিনেমার পোস্টার কোথাও চোখে পড়লো না। আমি অবাক হয়ে গেলাম।