চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

আমার সংসার বিবাগী নিরীহ বাবা

আমার কখনও এমন হয় না। অথচ কয়েকদিন ধরে এরকম হচ্ছে। বার বার হচ্ছে। সারাদিন অফিসের কাজ শেষ করে ছেলেমেয়েকে নিয়ে সন্ধ্যার দিকে ঢাকা মেডিক্যালে যাই লুনার কাছে। কয়েকদিন ধরে সে মেডিক্যালের কেবিনে। চিন্তার খুব একটা কারণ না থাকলেও আমরা চিন্তাগ্রস্ত। সকাল থেকে ঘরে থাকে অথই আর হৃদ্য। ঘরে আত্মীয়স্বজন আরও দু’একজন থাকে। আমি কি খাব না খাব সেটা জেনে নিয়ে মেয়ে ফোন করে মার কাছ থেকে টিপস নিয়ে রান্না করে। মেয়ে রান্না শিখেছে তার মায়ের মতো, তার দাদীর মতো। দিনের মধ্যে হয় ছেলে না হয় মেয়ের ফোন, বাবা কখন মার কাছে যাবা?

অফিস শেষে রিকশা করে ঢাকা মেডিক্যালে যাওয়ার সময় বাপ-মেয়ে-ছেলেতে কত কথা! সামনে মেয়ের ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা। সন্ধ্যার পর গেলে মাঝে মাঝে সে মায়ের সঙ্গে থেকে যায়। মাকে খাইয়ে দেয়। মায়ের দেখভাল করে। আমি কিছু বলি না।

রাতের বেলায় আমি আর ছেলে লুনার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাড়ি ফিরি। ছেলে আমার রিকশা চড়তে খুব পছন্দ করে। ইমারর্জেন্সি গেট থেকে রিকশা নিয়ে বাড়ি ফেরার সময় আমি চুপচাপই থাকি। এই সময়টায় কেন যেন আমার বাবার কথা মনে হয়। ঘরে ফিরে গিয়ে আমি আমার মেয়ের হাতে রান্না করা খাবার খাব। আহারে আমার বাবা বেচারার কপাল কত খারাপই না ছিল! চল্লিশ এক চল্লিশ বছর আগে আমার বাবা এই ঢাকা মেডিক্যাল থেকে রাতের বেলা একা একা বাড়ি ফিরতেন। সারাদিন কোর্ট কাচারি, মামলা মোকদ্দমা শেষ করে সন্ধ্যার দিকে মেডিক্যালের কেবিনে এসে মার পাশে বসে থাকতেন দিনের পর দিন। আমাদের পুরোটা ছোটবেলা কেটেছে মা’হীন অবস্থায়। বছরের দশ মাস আমার মাকে পড়ে থাকতে হতো মেডিক্যালের কেবিনে কেবিনে। আমার মার ছিল জটিল রোগ। সন্ধ্যা থেকে অনেক রাত অবধি বাবা মা’র পাশে নৈশ প্রহরীর মতো থাকতেন তারপর রাত বেশি হলে মা-ই বাবাকে পাঠিয়ে দিতেন বাড়ি। বাবা তখন ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় ঘরের দিকে পা বাড়াতেন।

আমার বাবা মেডিক্যাল থেকে চানখারপুল, ফুলবাড়িয়া, নবাবপুর, ঠাটারি বাজার, যোগিনগর, বনগ্রাম, টিপু সুলতান রোড, খ্রিস্টান কবরস্তান, নারিন্দা রোড, শরত গুপ্ত রোড হয়ে বসুবাজার লেনের বাসায় এসে উঠতেন। প্রায়ই বাবা অনেক রাত করে ফিরতেন। বাবা যখন রাত কাঁধে করে ঘরে ফিরতেন আমরা ছোট ছোট চার পাঁচ ভাই তখন হয়ত খেয়ে না খেয়ে, কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়েছি।

এতকাল পর যখন আমি আমার ছেলেকে নিয়ে রিকশায় ঘরে ফিরি তখন মনে প্রশ্ন জাগে, আচ্ছা, আমার বাবা মেডিক্যাল থেকে বাড়ি ফিরে যাওয়া সেসব রাতে কার হাতের রান্না করা খাবার খেতেন? আমার বাবার তো আমার অথইয়ের মতো অত বড় মেয়ে ছিল না। আমার ছোট বোন মুন্নির বয়স তখন দেড় কি দু’বছর হবে। সেসব রাতে বাবা কি খাওয়া দাওয়া করতেন নাকি না খেয়ে দুশ্চিন্তায় দুশ্চিন্তায় ঘুমিয়ে পড়তেন!

এতগুলো ছোট ছোট ছেলেমেয়ের দিকে তাকিয়ে তিনি কি রাতের বেলায় পাগল হয়ে যেতেন! এখন আমি আমার বাবার জায়গায় নিজেকে কল্পনা করি আর ভাবি, বাবার জায়গায় আমি হলে সত্যি সত্যি পাগল হয়ে যেতাম…।

আজ রাতে ছেলেকে লুনার ওখান থেকে বাড়ি ফেরার সময় এসব ভাবনায় এতটাই আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিলাম যে আমি আমার নিরীহ সংসার বিবাগী বাবা মানুষটার জন্য আর কান্না ধরে রাখতে পারছিলাম না। আমার অজান্তে আমার চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়তে শুরু করল।

সমাজ সংসারের নিরীহ বাবাদের এই এক গুণ। তারা দীর্ঘদিন পর পর তাদের গোবেচারা সন্তানদের চোখের জলকে কি এক আশ্চর্য জাদুমন্ত্রে টেনে বের করে আনেন।

বিশেষ দ্রষ্টব্য: আজ আমার বাবার মৃত্যুদিন। এইদিনে ছেলে হিসেবে আমার উপলব্ধি।