চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

আমার নানা নানী…

এক
আমার নানা ছিলেন আলা ভোলা টাইপের একজন মানুষ। অর্থবিত্তের প্রতি এই মানুষটার কোনো ধরনের মোহ ছিল না। একরকম আলা ভোলা প্রকৃতির মানুষ ছিলেন তিনি। আমার নানা মানুষটা এক জীবনে অনেক কষ্ট করে, অনেক সংগ্রাম করে নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছিলেন এই ঢাকা শহরে। ছিলেন সরকারের কর্মকর্তা। অসহ্য রকমের সৎ থাকার কারণে জীবনে কিছুই করতে পারেননি। বোকা স্বভাবের হলে যা হয় আমার নানা আর নানী ছিলেন তাই। তারা কখনো ছেলেমেয়েদের কথা ভেবে বৈষয়িক চিন্তাভাবনা করে জায়গা জমির কথা ভাবেন নি। আর আরেকটা ব্যাপার ছিল আমার নানীর আজিমপুরের কলোনির বাড়িতে গ্রাম গ্রামান্তরের লতায় পাতায় জড়ানো আত্মীয়স্বজনদের উৎপাত লেগে থাকত সব সময়।

আমার নানী খুব ভালো বাজার করতে পারতেন। বাজার করাটা ছিল আমার নানীর এক ধরনের নেশা। পলাশী, নিউমার্কেট, কাপ্তান বাজার, ঠাটারি বাজার, আনন্দ বাজার- আরও কত জায়গায় আমার নানী বাজার করতে যেতেন…

কলোনির অনেকেই চাকরি বাকরি শেষে কলোনি ছেড়ে যে যার মতো নিজের তৈরি করা বাসাবাড়িতে গিয়ে উঠলেও আমার নানা নানী প্রায় চল্লিশ বছর আজিমপুর কলোনিতে থেকে ১৯৯২ সালে শ্যাওড়াপাড়ার এক ভাড়াবাড়িতে উঠেছিলেন। অথচ তা নিয়ে আমার নানার কোন মাথা ব্যথা ছিল না।

তিনি মনে করতেন ছেলেমেয়েদের জন্য আমার যে দায়িত্ব পালন করার কথা আমি পালন করেছি তার পুরোটাই।

আমার নানা তার ছেলেমেয়েদের ভেতর তৈরি করে দিতে পেরেছিলেন এক ধরনের বোধ আর উপলব্ধির যেটা কলোনির অনেক বাবাই তৈরি করতে নিষ্ঠার সঙ্গে ব্যর্থ হয়েছিলেন।

আমার নানা পায়ে হেঁটে আজিমপুর কলোনি থেকে সচিবালয়ে যেতেন। কখনো কখনো সরকারি যানবাহনে।

নানা মাস শেষে যে ক’টা টাকা বেতন পেতেন তার পুরোটা আমার নানীর হাতে তুলে দিয়ে বলতেন, ‘জিবন্নেছা বেগম, এই নেন আপনার সংসার নির্বাহের টাকা।’

আমার নানা বেশ গুছিয়ে মানে বইয়ের ভাষায় কথা বলতেন। প্রচুর গল্প উপন্যাস পড়তেন তিনি। আর আমার নানী কথা বলতেন তাঁর নিজের ভাষায়- খাঁটি বিক্রমপুরের ভাষায়। আমার খালা আর মামাদের আজিমপুর কলোনির বাসা জুড়ে ছিল খালি বই আর বই।

টাকা দেয়ার সময় আমার নানার মুখে লেগে থাকত ছেলেমানুষের মতো মধুর হাসি। ছোটবেলায় আমি আমার নানার মুখে সব সময় এই হাসিটা লেগে থাকতে দেখেছি।

আমার নানার হাসির মধ্যে সম্ভবত এক ধরনের জাদু ছিল না হলে আমার নানী তাঁর সৎ আর নির্বিকার রকমের সংসার বিবাগি স্বামীর মাস শেষের বেতনের ঐ ক’টা গোনা টাকা দিয়ে কিভাবে যে তাঁর চার ছেলে,চার মেয়ের বিশাল সংসার খরচ টেনে চালিয়ে নিতেন তা ভাবলে এখনো আমি অবাক হই।

আমাদের সেইসব দারুন অভাব আর তীব্র টানাপড়েনের দিনগুলোতে আমার কাছে আমার নানা নানীকে পৃথিবীর সেরা বাজিকর বলে মনে হতো।
দুই
বাবা মা মারা যাবার পর আমরা ছয় ভাইবোন এসে উঠলাম আজিমপুর কলোনির বাসায়। নানার গোনা টাকার সংসারের মধ্যে আমরা এতগুলো বাপ মা মরা এতিমের দল এসে পড়লাম! আমাদের পাশে দাঁড়াবার মতো যে কেউ ছিল না, আমরাই বা কই যাব? আমাদের চোখে মুখে তখন রাজ্যের অন্ধকার। আমাদের সেই অন্ধকার দেখা দিনগুলোতেও আমার নানার মুখে ছিল সেই মধুমাখা হাসি। শুধু আমার নানী মাঝে মাঝে তাঁর মৃত মেয়ে মুকুলের নাম ধরে আহাজারি করতেন।
আমার নানীকে আমি কখনোই কাঁদতে দেখিনি।

তিন
নানা নানী মারা গেছেন অনেক দিন হলো।
আজ, এত বছর পর আমার মনে হয়, আমার নানাই শুধু জাদু জানতেন না, আমার নানীও আমার নানার চেয়ে কোনো অংশে কম জাদু জানতেন না…