চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ

আমাদের গেছে যে দিন একেবারেই কি গেছে

পৃথিবীর প্রত্যেক জাতিরই রয়েছে নিজস্ব সংস্কৃতি। আর এই সংস্কৃতি প্রেম-ভালবাসায় সিক্ত মানুষের অন্তর আত্মার সাথে মিশে একাকার হয়ে আছে। কালের যাত্রায় সংস্কৃতি সর্বদাই গতিশীল। পৃথিবীর অন্যান্য জাতির মতো আমাদেরও আছে হাজার বছরের প্রবাহমান সংস্কৃতি। আবার কালের স্রোতে বস্তুগত-অবস্তুগত অনেক কিছু হারিয়েও যাচ্ছে আমাদের সংস্কৃতি থেকে।

আশির দশকে বাংলাদেশ টেলিভিশনে ‘কালস্রোত’ নামে একটি খণ্ড নাটক প্রচারিত হতো। ওই সময় কালস্রোত নাটকের ‘কাল’ শব্দটি নিয়ে এক বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছিল। ছয় খণ্ডের নাটকটিতে অভিনয় করেছিলেন মানস বন্দ্যোপাধ্যায়, মেঘনা, লুৎফুর নাহার লতা। যাই হোক, কালোস্রোত কিংবা কালস্রোত নাটক এখানে আলোচনার মূল বিষয় নয়।

হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের শিল্প-সাহিত্য, ঐতিহ্য-ঐশ্বর্য, সাহিত্য জীবনের দর্পণ। আর সাহিত্যের গল্প-উপন্যাসের মতো; সাহিত্য ভান্ডারে সঙ্গীত একটি বিশেষ অংশ। কিন্তু কালের প্রবাহে আমরা হারিয়ে ফেলছি অনেক মূল্যবান গান।

রবীন্দ্রসঙ্গীত, নজরুল সঙ্গীতের মর্যাদা আমরা যেভাবে অক্ষুণ্ণ রেখেছি, ঠিক সেভাবেই জারি-সারি-পালাগান, পুঁথিপাঠ, গীতিকাব্য জীবন্ত করে রাখা দরকার। যা দেখে এবং শুনে বিদেশিরাও মুগ্ধ হতে পারে। যেমন- গীতিকাব্যের মধ্যে ‘মৈমনসিংহ গীতিকা’ (ড. দীনেশ চন্দ্র)। আমরা জানি, রোঁমা রোঁলা নিজে মৈমনসিংহ গীতিকায় বর্ণিত মদিনা বিবির সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়েছেন।

আমাদের লোকসঙ্গীতের মধ্যে আরও আছে পল্লীগীতি, মুর্শিদী, মারফতি, ভাওয়াইয়া, ভাটিয়ালি গান। লালনগীতির চর্চা মোটামুটি আছে এখনও। এমন মনোমুগ্ধকর গানগুলো মানুষের মনকে ছুঁয়ে যায়।

এই যে এসব গানে নদী, মাঝি, নৌকা, ধূ ধূ মাঠে গরুর গাড়ির কথা উল্লেখ আছে তাতে কিন্তু প্রগতিকে কিংবা প্রযুক্তিকে বাধাগ্রস্ত করা নয়। সময়ের প্রয়োজনে প্রযুক্তির অবদান ব্যাপক। ওইসব গানের মধ্য দিয়ে বাংলার মানুষের অতীত জীবনের সুখ-দুঃখের কথা জানা যায়।

বই মানুষের নিত্যসঙ্গী, একথা বুঝাতে গিয়ে কবি ওমর খৈয়াম যেমন বলেছেন-
‘রুটি মদ ফুরিয়ে যাবে
প্রিয়ার কালো চোখ ঘোলাটে হয়ে যাবে কিন্তু বইখানি অনন্ত যৌবনা। যদি তেমন বই হয়।’
তেমনি সঙ্গীতও মানুষের এমন সঙ্গী হতে পারে যা জীবন সঞ্জীবনী সুধার মতো। জীবনের সকল চাওয়া-পাওয়া মিশে আছে গানের মধ্যে। যদি তেমন গান হয়।

আমাদের জাতীয় দিবসগুলো (বিশ্ববাসীর) আন্তর্জাতিকভাবে সমাদৃত। আমাদের আছে উৎসব, আছে মেলা পার্বণ, চৈত্র সংক্রান্তি। চৈত্র সংক্রান্তিতে গঙ্গাস্নানের সাথে চরকপূজা (ময়মনসিংহ অঞ্চলে দেখা যায় ব্রহ্মপুত্র নদে গঙ্গাস্নানের কার্য সম্পন্ন করে) বসন্ত বিদায়ের উৎসবও চলে এখানে। চৈত্র সংক্রান্তিতে আরেকটা বিষয় ছিল গ্রামে ওই দিন অর্থাৎ চৈত্র মাসের ৩০ তারিখে নানা রকমের শাক সংগ্রহ করে (বারো রকম শাক যমন ধানকুলি, ঢেঁকিশাক, ডন্ট কলস, হেলেঞ্চা) গরম ভাতের সাথে খাওয়া হতো। গ্রামবাসীর ধারণা তাতে শরীরের বাতের ব্যথা উপশম হয়।

আজকাল গ্রামের তুলনায় শহরে কিংবা শিক্ষিত জনমনে উৎসবের গুরুত্ব অধিক দেখা যাচ্ছে। এক সময়ের কৃষিভিত্তিক গ্রাম প্রধান জনগণ বর্তমানে বাঙালি সংস্কৃতি থেকে দ্রুতগতিতে বেরিয়ে আসতে চাচ্ছে।

কাঁচামরিচ ডলে পান্তা খেয়ে ভোর না হতে রোজ রোজ কৃষক যেতো লাঙল-জোয়াল কাঁধে নিয়ে। আজকাল কৃষকের ঘরে আর দেখা যায় না পান্তা ভাত। সেই কাঁচা মরিচ-পান্তার সাথে ইলিশ ভাজা এখন শহরে পহেলা বৈশাখের নানা আয়োজনের একটি অংশ।

আমাদের কৃষিতে এসেছে সমৃদ্ধি। দরিদ্র কৃষকের দুঃখ-বেদনা দূর হয়েছে। তবে পান্তা ভাত তো আমাদেরই উৎপন্ন ধান থেকে তৈরি টাটকা খাবার। আমাদের সাহিত্যিকগণ পান্তা ভাতও তাদের রচনায় স্থান দিয়েছেন। পান্তা নিয়ে আছে গল্প কবিতা।

আজ যারা শহরের উচ্চপদস্থ তাদের অনেকেরই শৈশব-কৈশোর কেটেছে পান্তা ভাতে। পান্তা আমাদের জাতীয় ঐতিহ্য।

এক সময় বাংলার ঘরে ঘরে নবান্নের উৎসব চলত মহাধুমধামে। ইতিহাস থেকে জানা, লোকমুখে শোনা ছাড়াও কিছুটা চোখে দেখেছি নবান্নের উৎসব। নব অর্থ নতুন, অন্ন অর্থ ভাত অর্থাৎ নতুন ধানের ভাত। গ্রামের প্রতিটি বাড়িতে নতুন ফসল ঘরে তোলার পর গ্রামবাসীদের দাওয়াত করে খাওয়ানো হতো। বড় উঠানের চারদিক ঘিরে পাটি, মাদুর, চাটাই অথবা চট বিছিয়ে অতিথিদের বসানো হতো। খাবারের আয়োজনে থাকত নানা পদ। যেমন মাছ, ভাত, মাংস, (পোলাও-কোরমা-কোপ্তা-কাবাব নয়) রুই মাছের মাথা দিয়ে মুড়িঘণ্ট, শোল মাছের দোপেঁয়াজা, লাউ, ডাল, পায়েস, দধি, আর থাকতো হরেক রকমের আঞ্চলিক পিঠা। খাবার শেষে নানা রকম সুগন্ধী জর্দা দিয়ে পান সুপারির ধূম পড়ে যেতো। খাবার খেতে খেতে চলও রস-রসিকতা, হাসি-তামাসা। রান্নার গুণকীর্তন করে রমণীদের উদ্দেশ্যে বলা হতো-
‘পানেতে হয় না লাল
লাল হয় চুনে
রূপেতে ভরে না মন
মন ভরে গুণে’

আর বলা হতো যে রাঁধে সে চুলও বাঁধে।

বড় আক্ষেপের বিষয়, সেই নবান্নের উৎসব আর পালন হয় না গ্রাম বাংলায়। অথচ গোয়াল ঘরে (ছোটবেলায় নানাবাড়ি/দাদাবাড়ি দেখেছি) গাভী, বাছুর প্রসব করলেও পায়েস রান্না করে খাওয়ানো হতে পাড়া-পড়শিদের। এই পায়েস পরিবেশন হতো কলার পাতায়। ময়মনসিংহের আঞ্চলিক ভাষায় এটিকে বলা হতো গোয়ালির ক্ষীর।

এক সময় এদেশের পরিবারগুলো ছিল একান্নবর্তী পরিবারের অন্তর্ভুক্ত। পুত্রগণ, পুত্রবধূগণ, নাতি-নাতনী, পুতি পর্যন্ত নিয়েছিল দাদা-দাদীর সংসার। যেন একেকটা সংসার একেকটা চাঁদের হাট। সেখানে ছিল না কোনো সুখের অভাব। বিদেশি পর্যটকদের মুখে মুখে ছিল বাঙালির এমন সুখ্যাতির কথা। যা হয়তো আগামী প্রজন্ম শুনবে রূপকথা অর্থাৎ কল্পকাহিনী হিসেবে। এই পরিবার ভাঙনে আমরা কতটা সফল হতে পেরেছি? কতটা আধুনিকতার মানদণ্ডে আমরা উন্নীত হয়েছি। বর্তমান যুগে একক পরিবারগুলোতে কখনো কখনো মা-বাবাকেও বোঝা মনে করা হচ্ছে।

সংস্কৃতির একটি বিশেষ অংশ খেলাধুলা। হা-ডু-ডু বা কাবাডি, দাড়িয়াবান্ধা, গোল্লাছুট, কানামাছি, বৌচি, মোরগের লড়াই, কুস্তি, নৌকাবাইচের মতো আরও অনেক মজার মজার খেলা বিলুপ্তির পথে। এগুলো খেলেও ছিল আনন্দ, দেখাও ছিল উপভোগ্য।

কবি সুফিয়া কামাল তাঁর ‘আজিকায় শিশু’ কবিতায় লিখেছিলেন-
‘আকাশের তলে আমরা যখন উড়িয়েছি শুধু ঘুড়ি
তোমরা এখন কলের জাহাজ চালাও গগণ জুড়ি।’

কলের জাহাজ চালাতে গিয়ে এ যুগের মানুষ আজ ঘুড়ি উড়ানোর আনন্দটাই ভুলে গেছে।

এই তো সেদিন, সত্যিই কিছুটা অভিভূত হলাম- উত্তরা ১৪ নং সেক্টরের খেলার মাঠে। একটি বালক মাঠে দাঁড়িয়ে আপন মনে ঘুড়ি উড়াচ্ছে। আমরা যখন ছোট অর্থাৎ আমাদের শৈশবকালে ঘুড়ি উড়ানোর উৎসব-আনন্দ চলত।

কাটাকাটি করে ঘুড়ি দখল, সুতায় মাঞ্জা দেয়া, লাটাইয়া সুতা প্যাঁচানো, ঘুড়িগুলিও ছিল লেজ লাগানো রংবেরঙের। যেমন- লাল, নীল, হলুদ, সবুজ, বেগুনি, কমলা এমন আরও কত রঙের! তখন ঘুড়ি উড়ানোর খেলাটা প্রায় ছেলেদের জন্যই বরাদ্দ ছিল। তবে ডানপিটে ধরনের দুই-একটা মেয়েও খেলত। বোকা-সোকাগুলো পেছনে পেছনে দৌড়ঝাপ পাড়ত। যদিও এ যুগের ছেলেমেয়েদের ঘুড়ি সম্পর্কে অতটা ধারণা নেই; তবে আবার যদি ঘুড়ি উড়নো চালু হয়, প্রত্যাশা করব মেয়েরাও যেন অংশ নিতে পারে স্বতঃস্ফূর্তভাবে।

উন্নত দেশ জাপান, সেখানে একটি নির্দিষ্ট দিবসে ঘুড়ি উৎসব পালন করা হয়।

আমাদের ধ্যান এবং খেয়াল বিদেশিদের অনুসরণ করা, অনুকরণ করা। কিন্তু এই অনুসরণ আর অনুকরণ করা হয় খাবারে, পোশাকে আর ভাষায়।

যুগ যুগ ধরে আমরা ছিলাম মাছে-ভাতে বাঙালি। সেটাও আজ হারিয়ে যাচ্ছে।

আবহমান কাল থেকে বাংলার শাশ্বত নারী রূপটি ফুটে উঠেছে শাড়িতে। বাংলার অতীতের এবং বর্তমানের প্রধান প্রধান শাড়িগুলোর মধ্যে- ঢাকাই মসলিন, জামদানি, সিল্ক, গরদ, তসর আর চমৎকার তাঁতের শাড়ি। এইসব শাড়ি যুগ যুগ ধরে আমাদের ঐতিহ্যকে বয়ে চলেছে। বর্তমানে আমাদের দেশীয় পোশাক, বিশেষ করে নারীদের পোশাক কোনটা মানানসই তা বুঝতে পারা না পারা রুচির অপারগতা।

যা-ই হোক, জাতীয় ও ঐতিহ্য রক্ষা যেমন দরকার তেমনি দরকার প্রগতিশীলতাকে স্বাগত জানানো। কর্মক্ষেত্রে নারীর নির্দিষ্ট পোশাক (পুলিশ সেনাবাহিনী, বিমানবাহিনীর নারী) পেশার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ, যা নারীর ব্যক্তিত্ব ও আত্মবিশ্বাসকে দৃঢ় চেতনায় বলীয়ান করে তুলবে।

ভাষা। হাজার বছরের ধারাবাহিকতায় আমাদের বাংলা ভাষার সমৃদ্ধ ঘটেছে। যে সমৃদ্ধশালী বাংলা ভাষাকে রক্ষা করতে আমরা করেছি আন্দোলন, নেমেছি মিছিলে, স্লোগানে। রক্ত দিয়ে জীবন দিয়ে আমরা আমাদের প্রাণের ভাষা বাংলা ভাষাকে রক্ষা করেছি। তা কোনোভাবেই ধ্বংস হতে দেয়া যাবে না। বাংলা আমাদের মায়ের ভাষা। আর সংস্কৃতি বিকাশের প্রধান ধারক এবং বাহক হচ্ছে ভাষা। ভাষা চর্চার মাধ্যমেই কোনো জাতি উন্নতির চূড়ান্ত সোপানে পৌঁছাতে পারে। বিদেশি ভাষা ইংরেজির প্রতি কতক বাঙালির দারুণ আগ্রহ। যেনো সকল কল্যাণ এবং আধুনিকতা ইংরেজির মধ্যেই বিদ্যমান। শিশু এবং মহিলাদের মধ্যে অনেকেরই হিন্দি ভাষার প্রতি টান লক্ষ্য করা যায়।

যেহেতু ইংরেজি আন্তর্জাতিক ভাষা, সেহেতু অবশ্যই তা শিক্ষাগ্রহণ করতে হবে। তাই বলে মাতৃভাষার সাথে প্রতিযোগিতায় নয়।

সংস্কৃতি মানব জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। একটি জাতির দীর্ঘদিনের জীবন যাত্রার প্রণালীই তো সংস্কৃতি বা কৃষ্টি। আবার অপসংস্কৃতি মানুষকে বিবেকবর্জিত পশুতে পরিণত করে। সংস্কৃতি মানুষকে সুন্দর ও কল্যাণের পথ দেখায়। মাটি ও মানুষের সুন্দর ও কল্যাণের পথ দেখায়। মাটি ও মানুষের প্রতি ভালোবাসার শিক্ষা দেয় সংস্কৃতি। সংস্কৃতি স্থবির নয়, সর্বদাই চলমান। তাই কালের স্রোতে অনেক কিছু বদলে যায়, হারিয়ে যায়। তথাপি আমরা আমাদের মূল্যবান সম্পদগুলো হারাবো না। আমরা বাঙালিত্বকে বিসর্জন দেব না। বহুমুখী সম্পদে বাংলাদেশ পরিপূর্ণ সম্পদগুলোর যথাযথ ব্যবহার করলে বিশ্বে আমরা শ্রেষ্ঠ জাতিতে পরিণত হতে পারব।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)