এক.
সাংবাদিকতা কিংবা লেখালেখির কোনো কাজে তাঁর কাছে অনেকবারই যেতে হয়েছে। সাক্ষাৎকারও নিয়েছি কয়েকবার। এছাড়া পত্রিকায় কাজের সুবাদে বিভিন্ন ইস্যুতে, সমস্যায় স্যারের মতামত কিংবা দিক নির্দেশনা জানার জন্য ফোন করতে হতো। ফোন করলে স্যার যত ব্যস্তই থাকুন না কেন সব কথা শুনে নিজের মতামত কিংবা প্রতিক্রিয়াটা একজন অভিজ্ঞ অভিভাবকের মতো আমাদের জানিয়ে দিতেন। শুধু তা-ই না, উদ্ভুত পরিস্থিতিতে আমাদের কিভাবে কি করতে হবে তা-ও বলে দিতেন। এরকম অনেকবার হয়েছে। এমনও সময় গেছে অনেক রাতে ফোন করেছি- স্যার হয়ত খাওয়া দাওয়া শেষে শোয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন তখনও খুব আন্তরিকতার সঙ্গে কথা বলতেন- কখনো তাঁকে বিরক্ত হতে দেখিনি। আমরা যারা গণমাধ্যমের মানুষ তাদের বেলায় আনিস স্যারের একটা নিঃশর্ত ভালোবাসা ছিল, দায়িত্বও ছিল।
যখনই তাঁর কাছে যেতাম তখন খুব অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতাম আর ভাবতাম এতটা বছর পেরিয়ে আসা একটা মানুষ এখনও কিভাবে এত প্রাণবন্ত আর সজীব থাকেন কী করে! আনিস স্যার আশি পার করেও চলনে বলনে, কাজে কর্মে, তারুণ্যে যেকোনো তরুণকে হারিয়ে দেন। দাদাভাইয়ের কচিকাঁচার আসরের অনেক অনুষ্ঠানে আমাদের তরুণ লিখিয়েদের পাঠাতেন প্রবীণ লেখকদের আনার জন্য। এ ব্যাপারে দাদাভাইয়ের যুক্তি ছিল, এতে করে নবীন প্রবীণের মধ্যে একটা সম্পর্ক তৈরি হয়। মাঝে মাঝে আনিস স্যার, কবি শামসুর রাহমান সহ অনেকের বাসায় আমাদের যেতে হতো। দাদাভাই কবে আমাদের এসব বিখ্যাত সব মানুষদের বাসায় পাঠাবেন আমরা সেই যাওয়ার ব্যাপারে মুখিয়ে থাকতাম।
আনিস স্যারের বাসায় গেলে আমাদের জন্য একটা বাড়তি প্রাপ্তি ছিল- স্যারের বাসায় যেসব জলখাবার পরিবেশন করা হতো তার সবই ঘরে তৈরি করা। স্যারের স্ত্রী অসম্ভব ভালো মানুষ- সজ্জন মানুষ। তাঁর রান্নার হাত যে দারুণরকমের ভালো সেটা আমরা খাবার সময় টের পেতাম। মজার মজার ভাঁজা পোড়া মচমচে স্বাদের খাবার আর অসাধারণ গন্ধযুক্ত ঘন দুধের চায়ে- আমরা তৃপ্তি সহকারে সেই খাবার খেতাম।
আনিস স্যারের বাসা থেকে ফেরার পর আমরা উন্মুখ হয়ে থাকতাম দাদাভাই কবে কচিকাঁচার আসরের অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে আসার কথা জানিয়ে আমাদেরকে কবে আবার আনিস স্যারের বাসায় পাঠান। আমরা সেই আশাতে থাকি।
আনিস স্যার কম কথা বলতেন কিন্তু যা কিছু বলতেন তা খুব গুছিয়ে এবং গম্ভীর স্বরে। আমরা তাঁর এই কথা বলার ধরণ খুব পছন্দ করতাম। চলে আসার আগে তিনি অনুষ্ঠানের দিন আর সময় জেনে নিয়ে বলতেন, দাদাভাইকে বল চিন্তা না করতে, আমি ঠিক সময়মত চলে আসব। ফেরার সময় আমাদের পকেটে বাসায় ফেরার মতো পয়সা আছে কি-না তাও তিনি জানতে চাইতেন। আমরা অবাক হতাম, কলেজে পড়ার সেইসব উড়নচণ্ডী দিনে একজন নবীন লিখিয়ের পকেটে যে টাকাপয়সা না-ও থাকতে পারে সেটা আনিস স্যার কিভাবে বুঝলেন!
স্যারের কথায় আমরা তরুণরা লজ্জা পেলেও অনুভব করতাম তিনিও আসলে আমাদের দলের মানুষ। আনিস স্যার তরুণ লিখিয়েদের যেমন খুব পছন্দ করতেন তেমনি তাদের কাছ থেকে তাদের অভিজ্ঞতার কথাও খুব মনোযোগ দিয়ে শুনতেন।
দুই.
আমি তখন সাপ্তাহিক ২০০০ এর বিশেষ সংবাদদাতা। মাঝে মাঝেই স্যারকে ফোন দেই- খোঁজখবর নেই। আগেই কথা হয়েছিল। সাক্ষাৎকারের জন্য সময় দিয়েছেন। দুপুরের আগে যেতে বলেছেন। আমি জানি সময় মেনে চলা মানুষ। সময়মত হাজির হয়ে গেলাম। বিকেল তিনটায় স্যারকে বাংলা একাডেমীর মিটিংয়ে থাকতে হবে। সুতরাং সময় মত হাজির না হলে ঝামেলায় পড়ে যাব। স্যার নিজেই দরোজা খুলে দিলেন। সাদার ওপর নকশা করা লুঙ্গি আর চিরচেনা খদ্দরের কলার অলা পাঞ্জাবিতে স্যারকে বেশ লাগছে। তখন দুপুর। স্যারকে দেখে মনে হল তিনি বুঝি মাত্রই ঘুম থেকে উঠে এলেন। আমি স্যারের সঙ্গে কথা বলছি এমন সময় একজনের ফোন এলো। স্যার কথা বলছেন। স্যার বলছেন, ‘হ্যাঁ, কাজল, কৈ, মাগুর, শিং, পাবদা, শোল, বড় দেশি বেলে, মেনি, আইর- এসব মাছ আমি পছন্দ করি। আর তোমাদের কিশোরগঞ্জ কুলিয়ারচরের বিলের মাছের কথা অনেক শুনেছি’- বুঝলাম ফোনের ওপারের কাজল নামের ভদ্রলোক স্যারকে মাছের কথা বলছেন।
পরে বুঝেছি স্যার কথা বলছেন চন্দ্রাবতী প্রকাশনীর কাম্রুজ্জামান কাজলের সাথে। স্যার যে ভীষণ ভোজন রসিক মানুষ সেই কথাও সেদিন সাক্ষাৎকার নেয়ার সময় বুঝে নিয়েছিলাম। আমি তখন সুযোগ বুঝে সাক্ষাৎকারে স্যারের খাবার দাবারের ব্যাপারে কয়েকটা প্রশ্ন করেছিলাম। স্যার বাঙালির রসনা বিলাস নিয়ে অনেক মজার মজার কথা বলেছিলেন।
তিন.
স্যারের লেখার অনুরাগী পাঠক ছিলাম- যখন হাতের কাছে যা পেয়েছি পড়েছি তাঁর বই। গবেষণা, লেখালেখি, জীবনস্মৃতি, ইতিহাস রচনা,সাম্প্রতিক কথন- সব বিষয়েই ক্ষুরধার ছিলেন। দেশের যেকোনো ক্রান্তিকালে ছায়ার মতো মানুষের পাশে থেকেছেন, মানুষকে আশ্রয় দিয়েছেন। ‘বিপুলা পৃথিবী’ নামে এক অসাধারণ আত্মজীবনী লিখেছেন যা পড়লে মুগ্ধ হওয়া ছাড়া উপায় থাকে না।। এছাড়া ‘আমার একাত্তুর’, ‘বাঙালি মনীষার প্রতিকৃতি’, ‘মুক্তির সংগ্রাম’, ‘আমার চোখে’, ‘বিদ্যাসাগর ও অন্যেরা’, ‘সমাজ, সংস্কৃতি, রাজনীতি’, ‘দীপ্র মনীষা’, ‘মুসলিম মানস ও বাংলা সাহিত্য’, ‘মুসলিম বাংলার সাময়িকপত্র’, ‘আঠারো শতকের বাংলা চিঠি’, ‘পুরোনো বাংলা গদ্য’, ‘সাহিত্যে ও সমাজে’ , ‘পূর্বগামী ও কাল নিরবধি’।
চার.
আমি যতবার স্যারের কাছে গিয়েছি ততবারই আমার মনে হয়েছে এই বুঝি প্রথমবারের মতো তাঁর কাছে এলাম। স্যারের ভেতরে এই গুণটা ছিল তিনি প্রতিবারই নিজেকে নতুন রুপে তুলে ধরতে পারতেন- তাঁকে দেখলে ভেতর থেকে আপনা-আপনি একটা অনুপ্রেরণা জাগ্রত হতো। তিনি অন্যের ভেতর অনুপ্রেরণা তৈরি করে দিতে পারার মন্ত্রটা জানতেন। স্যার তাঁর দীর্ঘ জীবদ্দশায় দেশের অগণিত মানুষের মধ্যে দেশকে ভালোবাসার, বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও অসাম্প্রদায়িক চেতনায় উজ্জীবিত হওয়ার আর মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে লড়াই করার স্বপ্নকে বুনে দিয়েছিলেন।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)