এক.
‘যেভাবে বললি সেভাবে লিখবি। সহজ ভাষায়। ছোট ছোট শব্দে। ইন্ট্রোটা যে কোন ফিচারের আসল। ইন্ট্রো বুঝিস তো! শুরু। ইন্ট্রোডাকশন। চার থেকে ছয় শব্দের বাক্য তৈরী করবি। প্রথম দশ বাক্যে যেন একটা ছবি পায় পাঠক। কৌতুহল তৈরী হয়। এ কৌতুহল তাকে লেখার শেষ পর্যন্ত পড়তে আগ্রহ যোগাবে। পাঠকের চোখের সামনে যদি শব্দ দৃশ্যকল্প না তৈরী করে, রঙ না ছড়ায় সেটা কি আর লেখারে!’
চোখটা পুড়ে যাচ্ছে। জ্বলছে স্মৃতিসমুদ্রের লোনা জ্বলে। আউলা বাতাস খেলছে স্মরণের প্রান্তরে রঙিলা পালে। ও পোড়া চোখ সমুদ্রে যাও।
‘পারত পক্ষে বাক্যে ‘ই’প্রত্যয় ব্যবহার করবি না। এতে বাক্য ঝুলে যায়। ঝুলে যাওয়া বুঝিস নিশ্চয়। বাড়ি পালিয়ে ট্রেনে করে ঘুরে আসলি কোলকাতা-বোম্বে। রেল লাইনের পাশে যে খুঁটি থাকে ওতে তার থাকে লম্বা, ওটা গরমে খেয়াল করলে দেখবি একটু প্রসারিত হয়ে বাঁকা হয়ে যায়। এটা ঝুলে যাওয়া। ওটা কি দেখতে ভালো লাগে? লেখার শরীরও কিন্তু ঝুলে যায়, যদি অকারণে অপ্রয়োজনীয় শব্দ ব্যবহার করিস। মেদহীন ঝরঝরে বাক্য তোর লেখাকে সুন্দর করবে।
৯৮ সাল। বাড়ি থেকে পালিয়ে কোলকাতা-বোম্বের ২ মাসের জাদুবাস্তব দিন। পাসপোর্ট ভিসাবিহীন। ফুটপাথের হোটেলে কাজ আর আরব সাগর তীরে শাহরুখ খান দর্শন। নভেম্বরে সে সময়ের ভোরের কাগজ অফিসের চার তলা ফিচার বিভাগে টেবিলের ওপারে বসে কথাগুলো বলেছিলেন তিনি। মাঝে প্রায় দুই দশকের ব্যবধান। কিন্তু এখনও বেজে চলে সারাক্ষণ স্বপ্নের জন্য শব্দ-সুরবাজী করে যাওয়া মানুষটির কণ্ঠ। লেখার শরীর নির্মাণের সেই ছবক আজও মূলমন্ত্র হিসেবে কাজ করে। দেখতে পান কি দ্রোণাচার্য। অবিরাম বৃষ্টিভেজা সুর ফিরে পেতে চাওয়া মানুষটি সঞ্জীব চৌধুরী। আমার প্রথম ফিচার এডিটর। কাঁচাপাকা গোফ আর সারাক্ষণ বাতাসে আন্দোলিত হতে থাকা এলোমেলো চুলের প্রিয় সঞ্জীব দা।
দুই.
তিনি লিখেছিলেন, আমি তোমাকেই বলে দেব/ কি যে একা দীর্ঘ রাত/ আমি হেঁটে গেছি বিরান পথে। আমি তোমাকেই বলে দেব/ সেই ভুলে ভরা গল্প/ কড়া নেড়ে গেছি ভুল দরজায়।’ তিনি তাই করে গেছেন। অবিরাম ভুল দরজায় করাঘাত। কার জন্য তিনি লিখেছিলেন, আমাকে অন্ধ করে দিয়েছিল চাঁদ। আমকে নিঃস্ব করে দিয়েছিল চাঁদ। কার জন্য? যার জন্য লিখেছিলেন তার কি মনে পড়ে? মনে পড়ার কি দরকার। হয়ত পড়েও। শিল্পের পথে হাঁটতে গিয়ে ভীষণ একা সময় যখন আসে, তখন মনে পড়ে তার। আমিতো খুব বেশি সময় পেয়েছি তা নয়, তবু জানতাম। সেসময় যারা তার খুব কাছের তারা জানতেন। কি জানতেন না জেবতিক ভাই, বাপ্পা, আগুন আর প্রভাষদা (প্রভাষ আমিন)। বাপ্পা মজুমদারকে সঙ্গে গড়ে তোলা ‘দলছুট’।
বাংলাদেশের ব্যান্ডের গানে সহজিয়া শব্দের গভীর ব্যঞ্জনাময় ধারা গড়ে তুলেছিলেন। আজকের বাপ্পা মজুমদারের ক্যারিয়ারের ভিত অনেকটা গড়ে উঠেছিল সঞ্জীবদার শব্দের জাদুতে। বাপ্পা’দা নিজেও বলেন এই কথা। আর ‘মেলা’র কথা না বললে নয়। প্রতি সোমবার বের হত। একটি ফিচার পেইজ যে কত জনপ্রিয় হতে পারে বা নিছক একটি সাপ্লিমেনটারির জন্য একটি পত্রিকার সার্কুলেশন বেড়ে যাওয়ার কথা বললে এ সময়ের অনেকে হয়ত বিশ্বাস করবে না। কিন্তু অবিশ্বাস্য হলেও এটি সত্য। এই ‘মেলা’র মাধ্যমে কত লেখক তৈরি হয়েছে বাংলাদেশের সংবাদপত্রের ফিচারে তার ইয়ত্তা নেই। লেখার স্বাধীনতা দিতেন। সে স্বাধীনতার মাঝে থাকত মানবিক বোধের মিশ্রণ।
তিন.
বড় বেহিসেবী ছিলেন। বড্ড বোহেমিয়ান। অবিন্যস্ত জীবনের রাশপ্রিন্ট। তার বোহেমিয়ান কিন্তু আদ্যেপান্ত সৃজনশীল সত্ত্বাকে সঠিক ভাবে ব্যবহার করতে পেরেছিল কি কেউ? কেউ করেনি। প্রেম-পরিবার-সংসারের প্রথাবদ্ধ বন্ধনে জড়িয়েছিলেন অনেক দেরিতে। কারণ এই নষ্ট শহরে ছিলেন তিনি ‘কিংবদন্তী’। কেবল সঞ্জীব চৌধুরী পারেন নিজের কন্যার এমন অসাধারণ নাম রাখতে। হয়ত তিনি বুঝেছিলেন খুব তাড়াতাড়ি তিনি চলে যাবেন নষ্ট শহর ছেড়ে। রাগ করে। চাইলেও তাকে বেঁধে রাখা যাবেনা।
তার প্রস্থানের দশ বছর পার হয়েছে। অথচ সৃজন সত্ত্বায় সঞ্জীব দা’র উপস্থিতি টের পাই বারবার। দাদা এজন্য কি লিখেছিলেন, পাগল রাগ করে চলে যাবে/ ফিরেও আসবেনা।/ ধর তাকে ধরে ফেল/ এখনই সময়।’ কেউ আমরা আপনাকে ধরে রাখতে পারিনি আরো বেশি দিন। কত যে দরকার ছিল আপনাকে আজকের এই অসহিষ্ণু সময়ে।
বুক জুড়ে এই বিজন শহর/ হা হা শূন্য আকাশ কাঁপাও।/ আকাশ ঘিরে শঙ্খচিলের/ শরীর চেরা কান্না থামাও।’ কান্নাতো আটকে রাখতে পারছিনা দাদা। হৃদয়ের রঙিলা পালে সঞ্জীব দা’র আউলা বাতাস খেলে যাবে, যতদিন নশ্বর এ ভুবনে বেঁচে আছি ততদিন।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)