চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ

আইএসকে কারা দেয় অর্থ কারা অস্ত্র

খুব সাধারণভাবে বলতে গেলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের টুইন টাওয়ার হামলার পর যে বৈশ্বিক সন্ত্রাসবাদের প্রবর্তন ঘটেছিলো ‘আল-কায়দা’র নামে তারই সর্বশেষ সংস্করণ ইসলামিক স্টেট বা আইএস। ইরাক ও সিরিয়া নিয়ে শরিয়া ভিত্তিক ইসলামিক ভূখণ্ড বা ‘খিলাফত’ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তথাকথিত ‘জিহাদ’ পরিচালনাকারী জঙ্গি গোষ্ঠীটিকে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে কখনো আইএস আবার কখনো আইএসআইএস (ইসলামিক স্টেট ইন ইরাক এন্ড সিরিয়া) নামেও পরিচিতি পেতে দেখা যায়।

তবে মধ্যপ্রাচ্যে পশ্চিমা ভূমিকার সমালোচনাকারী এবং ষড়যন্ত্র তাত্ত্বিকদের মতে যেভাবে মার্কিনীরা আফগানিস্তানে সোভিয়েত সৈন্য হটাতে মুজাহিদিন ব্যবহার করে হিতে বিপরীত ফল পাওয়া শুরু করেছিলো, সেরকমই আরেকটি পরিস্থিতি বর্তমান ‘আইএস সংকট’ কিংবা বলা যায় ধারাবাহিকতা।

সমগ্র ইরাক ও সিরিয়ার উত্তরাঞ্চল কবজা করে তথাকথিত খিলাফত প্রতিষ্ঠার পর নৃশংসতার নতুন নতুন নজির সৃষ্টির মাধ্যমে ২০১৪ সাল থেকে আন্তর্জাতিকভাবে আলোচনায় আসে আইএস। বিদেশী সাংবাদিক, ত্রাণকর্মী, ভিন্ন ধর্মাবলম্বী, প্রাচীণ ঐতিহ্যের সংরক্ষকদের অপহরণ, গণহত্যা, শিরোচ্ছেদ, পানিতে ডুবিয়ে ও আগুনে পুড়িয়ে হত্যা এবং এসব নৃশংস হত্যাযজ্ঞের ভিডিও সম্প্রচার আইএস-কে এনে দিয়েছে মূর্তিমান আতঙ্কের পরিচিতি।

কিন্তু নৃশংসতা-বর্বরতা সত্ত্বেও বিশ্বে অনেক তরুণের মধ্যে আইএসে যোগ দেয়ার প্রবণতা দেখা দেয়। আইএস এর ভিডিও দেখে অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, ফ্রান্সের মতো দেশ থেকেও পালিয়ে ইরাক-সিরিয়ায় গিয়ে আইএস-এ যোগ দেয়ার প্রবণতা গোটা বিশ্বকে দুঃশ্চিন্তায় ফেলেছে। অগ্রসরমান আইএস দমনে যুক্তরাষ্ট্রসহ মিত্রদেশগুলো বিমান হামলা চালানোর কথা বললেও সিরিয়া-ইরাকে তাদের অবস্থান দিন দিন পাকাপোক্ত হচ্ছিলো। এমন অবস্থায় সিরিয়ার বাশার সরকারকে সহযোগিতা করতে আইএসের বিরুদ্ধে এবার মধ্যপ্রাচ্যের রণাঙ্গণে বিশ্বের অন্যতম পরাশক্তি রাশিয়া।

কী চায় আইএস?
২০১৪ সালের জুনে ইরাক-সিরিয়ার বিশাল অঞ্চল দখল করে শরিয়া আইন চালু করে খিলাফত প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেয় জঙ্গি গোষ্ঠী আইএস। আর খিলাফতের প্রধান বা খলিফা হিসেবে ইব্রাহিম আওয়াদ ইব্রাহিম আল বাদরি আল সামাররাই ওরফে আবু বকর আল বাগদাদীর নাম ঘোষণা করা হয়। বিশ্বের সকল মুসলমানকে এই জঙ্গি নেতাকে খলিফা মেনে তার অনুসারী হওয়ার আহ্বান জানায় আইএস। এই আহ্বানে অনেক ছোট-ছোট জঙ্গি গ্রুপ সাড়া দেয়।

বিশ্বে শরিয়া আইন কায়েম করে তাদের মতানুযায়ী আল্লাহর শাসন নিশ্চিত করা এবং অবিশ্বাসী ও ধর্মচ্যুতদের ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে তারা জিহাদ করছে বলে প্রচার করে আইএস।

আইএস এর উত্থান
আইএস এর শেকড় খুঁজতে ফিরে যেতে হবে ২০০৩ সালে। ইরাকে মার্কিন আগ্রাসনে ওসামা বিন লাদেন শিষ্য আবু মুসাব আল জারকাওয়ী আল কায়দা ইন ইরাক (একিউআই) গঠন করেন। ২০০৬ সালে জারকাওয়ী নিহত হলে অচলপ্রায় জঙ্গি সংগঠনটি মাথাচাড়া দিতে ছোট ছোট জঙ্গিগোষ্ঠীগুলোকে এক ছাতার নিচে আনতে গঠন করা হয় ইসলামিক স্টেট ইরাক বা আইএসআই। কিন্তু একদিকে আল-কায়দাকে দুর্বল করতে মার্কিন হামলা অপরদিকে সাধারণ আরব উপজাতী গোষ্ঠীগুলোর নবজাগরণে আবারও তারা কোণঠাসা হয়ে পড়ে।

তবে ২০১০ সাল থেকে মার্কিন কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়া বাগদাদীর হাত ধরে আবারও তৎপর হয়ে ওঠে জঙ্গি গোষ্ঠীটি। ২০১৩ সালে তাদের বেশ কয়েকটি বর্বর হামলায় রক্তের বন্যায় ভেসে যায় ইরাক।

এরইমধ্যে সাবেক প্রেসিডেন্ট সাদ্দামের অনুসারীদের কাজে লাগিয়ে শিয়া প্রধান রাজনীতির মাঠেও সক্রিয় হয় আইএস। সুন্নিদের সমর্থনে দখল করে নেয় ফালুজার মতো কেন্দ্রীয় শহর। এরপর দখল করে নেয় মসুল। আইএস নৃশংসতায় প্রাণ হারান সংখ্যালঘু বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষ।

ইরাকে থাবা বসানোর পর এবার আইএস-এর নজর পরে গৃহযুদ্ধ উপদ্রুত সিরিয়ার দিকে। ইরাকের আইএস এবার ইসলামিক স্টেট ইন ইরাক এন্ড লেভান্ট (আইএসআইএল) বা আল-নুসরা ফ্রন্ট নামে সিরিয় প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করে।

গত বছর জুনে ইরাক-সিরিয়ার বিশাল অঞ্চল দখল করে ব্যাপক গণহত্যা ও ঐতিহাসিক স্থাপনা ধ্বংসের পর তথাকথিত খিলাফত কায়েমের ঘোষণা দেয় আইএস।

আয়তনে আইএস ‘খিলাফত’
২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে মার্কিন সন্ত্রাসবাদবিরোধী কেন্দ্রের তথ্যানুযায়ী টাইগ্রিস-ইউফ্রেটিস নদী অববাহিকা অর্থাৎ সমগ্র ইরাক ও সিরিয়ার একটি বিশাল অংশ এখন আইএস এর দখলে। দখলকৃত এই তথাকথিত খিলাফতের আয়তন প্রায় ২ লাখ ১০ হাজার বর্গ কিলোমিটার।

এতো গেলো ভৌগলিক দখলদারিত্বের কথা। তবে নৃশংসতা প্রবণ আইএস এর কবলে কতো সাধারণ ইরাকি-সিরিয় নাগরিক দাসত্ব করছে তার কোনো সঠিক পরিসংখ্যান জানা যায়নি। তবে ২০১৫ সালে রেডক্রসের হিসাব অনুযায়ী এখনো প্রায় এক কোটি মানুষ কার্যতঃ আইএস এর হাতে জিম্মি রয়েছে।

তথাকথিত ‘জিহাদে’ বিদেশী যোদ্ধা
মার্কিন গোয়েন্দা তথ্য অনুযায়ী আইএস কমপক্ষে ২০ থেকে ৩০ হাজার জঙ্গির সম্মিলিত গোষ্ঠী। ইরাকি বিশেষজ্ঞ হিশাম আল হাশিমির মতে মাত্র ৩০ শতাংশ ‘জিহাদী’ আইএস এর আদর্শে বিশ্বাস করে। বাকীরা কেউ ভয়ে, কেউ আবার জোরপূর্বক আইএসে নাম লিখাতে বাধ্য হয়েছে।

তবে আশ্চর্যের বিষয় যে, এই জঙ্গিদের বেশির ভাগই ইরাকি কিংবা সিরিয় নয়, বিদেশী। আরব রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে তিউনিসিয়া থেকে আইএস-এ যোগ দেয়া জঙ্গির সংখ্যা সবচেয়ে বেশি।

এর পর রয়েছে সৌদি আরব। তবে সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধে বেশ সরব থাকা অস্ট্রেলিয়া, জার্মানি, ফ্রান্স,যুক্তরাজ্য থেকে আইএস-এ যোগ দেয়ার মাত্রাও কম নয়। আর দক্ষিণ এশিয় দেশগুলোর মধ্যে পাকিস্তান থেকে আইএস-এ যোগ দেয়ার সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের তথ্যানুযায়ি জঙ্গি গোষ্ঠীটিতে ২২ হাজারেরও বেশি বিদেশী যোদ্ধা রয়েছে।

আইএস-এর অস্ত্রের যোগান
আইএস ভারী ও হালকা অস্ত্রে সুসজ্জিত জঙ্গি গোষ্ঠী। এমনকি বিমান বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র, ভূমি থেকে উৎক্ষেপণযোগ্য মিসাইল, ট্যাঙ্ক থেকে শুরু করে মার্কিন মেরিন সেনাদের বিশেষায়িত ‘হামভি’ যুদ্ধযানেরও মালিক তারা।

নিয়মিত অস্ত্র ও গোলবারুদের সরবরাহও তারা পাচ্ছে। এই অস্ত্র ও গোলবারুদের জোরে তারা ইরাকি বাহিনী এবং কুর্দী পেশমেরগা বাহিনীকেও একাধিকবার পর্যদুস্ত করেছে।

কিভাবে আসছে অর্থ, কারা দিচ্ছে সমর্থন?
আইএস বিশ্বের সবচেয়ে বেশি বিত্তশালী জঙ্গি গোষ্ঠী। ধনী আরব রাষ্ট্রগুলোর অনুদান, অপরিশোধিত তেল বিক্রি, অপহরণ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ জমা হয়েছে তথাকথিত খিলাফতের রাজকোষে। মার্কিন ট্রেজারির হিসেবে গত বছর শুধু তেল বিক্রি করে এক হাজার কোটি টাকা এবং অপহরণের মুক্তিপণবাবদ আরও ২’শ কোটি টাকা আয় করেছে আইএস। সংখ্যালঘুদের বিশেষ কর, প্রটেকশন মানি, চাঁদাবাজি, লুটতরাজ,ব্যাংকে হানা, প্রত্নসম্পদ বিক্রি করেও বিপুল আয় করছে জঙ্গি গোষ্ঠীটি।

সিরিয়ার আসাদ সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করতে ধনী আরব রাষ্ট্রগুলো আইএস-কে অর্থায়ন করছে। কাতার ভিত্তিক রয়্যাল ইউনাইটেড সার্ভিসেসের পরিচালক মাইকেল স্টিফেন্সের মতে, কাতার, তুরস্ক এবং সৌদি আরব থেকে টাকা যাচ্ছে আইএস-এর কাছে। শিয়া প্রধান ইরানের কর্তৃত্ব খর্ব করতেই সিরিয়ার আসাদ সরকারের বিরুদ্ধে আইএস-কে অর্থ দিয়ে যাচ্ছে সুন্নি প্রধান এসব রাষ্ট্র।

এতোটা নৃশংস কেনো আইএস?
সুন্নি মতাদর্শের আইএস-এর দাবি, তারাই একমাত্র বিশুদ্ধ ইসলামিক চেতনায় বিশ্বাসী। অন্যদের ইসলামের শত্রু ও ধ্বংসের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত বলে নির্বিচারে ভিন্ন মতবাদের মুসলিম-অমুসলিমদের হত্যাকে জায়েজ করে চলেছে বর্বর এই জঙ্গিগোষ্ঠী।

সাধারণ মানুষের মনে ত্রাস সৃষ্টির জন্যই তারা শিরোচ্ছেদ, পাথর মেরে হত্যা, ব্রাশ ফায়ার করে গণহত্যা চালাচ্ছে।

তবে সাধারণ মুসলিমরা এই বর্বরতা-নৃশংসতা সমর্থন করেন না। এমনকি এই নৃশংসতার বিরোধীতা করেছেন খোদ আল-কায়দা প্রধান আয়মান আল জাওয়াহিরি। তিনি মনে করেন এসব নৃশংসতায় শান্তি প্রিয় মুসলিমরা আইএস থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে।