চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

অভ্যুত্থান সফল করতে কারাগারে প্রস্তুত ছিলো হাজারো জাসদ কর্মী

১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর কারাগারে থাকায় দেশে যে অভ্যুত্থান-পাল্টা অভ্যুত্থান হচ্ছে, জাসদ এবং গণবাহিনীও যে এতে জড়িয়ে পড়েছে সেটা কারাগারে বসে জাসদ নেতারা সেভাবে টেরই পাননি। তবে জানার পর কারাগারের ভেতরে হাজার হাজার জাসদ কর্মী অভ্যুত্থান সফল করতে প্রস্তুত ছিলেন। চ্যানেল আই অনলাইনকে সেই সময়ের কথা জানিয়েছেন তখন জাসদ রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার কারণে কারাবন্দী সাংবাদিক সুমন মাহমুদ। 

৪০ বছর আগে নভেম্বর ঘটনাবলী যখন সংঘটিত হয় তার মাস সাতেক আগে থেকেই জরুরি ক্ষমতা আইনে গ্রেফতার হয়ে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দী ছিলেন তিনি। সে কারণে সেই সময়ের টালমাটাল পরিস্থিতি স্বাভাবিকভাবে দেখার, জানার বা উপলব্ধি করার ক্ষেত্রে কিছুটা ঘাটতি ছিলো। কিন্তু, একেবারেই যে পরিস্থিতি থেকে বিচ্ছিন্ন ছিলেন এমনটা নয়।

তিনি বলেন, ৭৪-এর ১৭ মার্চ দুই শীর্ষ নেতা মেজর জলিল ও আ স ম আবদুর রব গ্রেফতার হওয়ার পর কারাগারে তাদের সঙ্গে বাইরের সংগঠনের যোগাযোগ রক্ষার নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা জরুরি হয়ে পড়ে। ‘ঘটনাচক্রে তার সঙ্গে আমি সম্পৃক্ত ছিলাম। ফলে আমি যখন কারাগারে যাই তখন স্বাভাবিকভাবেই সংগঠনের প্রধান যোগাযোগ ব্যবস্থার আবর্তনের মধ্যেই আমার অবস্থান তৈরি হয়। সংক্ষেপে বলা যেতে পারে, বাইরের কোনো তথ্য পৌঁছে দেয়ার দায়িত্ব পাওয়ার আধ-ঘন্টার মধ্যেই তা কারাগারের ভেতরের যথাস্থানে পৌঁছে যাওয়া সম্ভব ছিলো।’

পরে তিনি নিজেই গ্রেফতার হয়ে যান। কিন্তু যোগাযোগ নেটওয়ার্ক সক্রিয় থাকার ফলে জেলের ভেতরে বসে বাইরের পরিস্থিতি দেখতে না পেলেও অনেকটাই সেই পরিস্থিতি অনুধাবন করতে পেরেছিলেন সুমন মাহমুদ।

তিনি বলেন, ৭ নভেম্বরের অভ্যুত্থান-প্রচেষ্টা সরাসরি না দেখলেও, আমরা কারাবন্দীরা তার উত্তাপ থেকে দূরে ছিলাম না এ কথা যেমন সত্য, তেমনিভাবে এ কথাও একশত ভাগ সত্য যে, ৭ নভেম্বর অভ্যুত্থান প্রয়াসের সিদ্ধান্ত এবং কারাগারে আটকদের ব্যাপারে করণীয় সম্পর্কে অন্তরীণ প্রধান নেতাদের কাছে বাইরে থেকে কোনো আগাম ইঙ্গিত পৌঁছেনি।

‘বিপ্লবী গণ-বাহিনী’র চীফ পলিটিক্যাল কমিশার মোহাম্মদ শাহজাহান ও জাসদ-এর অন্যতম সহ-সভাপতি মীর্জা সুলতান রাজা তখন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দী ছিলেন। শাহজাহান ভাই ও আমি দুজন একই সেল-এর বাসিন্দা ছিলাম। রাজা ভাই ছিলেন আমাদের পাশের সেলে। জাসদ-এর অপর ৪ শীর্ষ নেতা মেজর জলিল, আসম আবদুর রব, শাজাহান সিরাজ ও নূর আলম জিকুকে অবশ্য আগেই দেশের অন্যান্য কারাগারে স্থানান্তরিত করা হয়েছিলো।’

তিনি জানান: ৭ নভেম্বর সম্পর্কে বিশদভাবে কিছু না জানার কারণে আরো বছর দেড়েক পরে কারামুক্ত হয়ে নেতাদের অনেকের কাছ থেকেই জানার চেষ্টা করেছি কী কারণে এ রকম হলো যে, শুরুর মাত্র কয়েক ঘন্টার মধ্যেই সশস্ত্র অভ্যুত্থানের অপমৃত্যু ঘটলো। এর স্পষ্ট কারণ বা জবাব কারো কাছ থেকেই পাননি সুমন মাহমুদ।

‘তবে আমি কারাগারে যাওয়ার আগের মাসগুলোতে যার সার্বক্ষণিক সঙ্গী হিসেবে একই শেল্টারে ছিলাম, জাসদ-এর তৎকালীন কার্যকরী সভাপতি, প্রয়াত দাদা বিধানকৃষ্ণ সেন আমাকে জানিয়েছিলেন, ৭ নভেম্বরের অভ্যুত্থান (এবং এর সঙ্গে তার সভাপতিত্বাধীন দল জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের সম্পৃক্ততা) সম্পর্কে তিনি ঘটনা ঘটার আগে কিছুই জানতেন না। উল্লেখ্য, ৭ নভেম্বরের পরে গ্রেফতার হয়ে বিধান দা বেশ কয়েক বছর কারাবাসে কাটিয়েছেন।’

ওই সময়ের কথা উল্লেখ করে সুমন মাহমুদ বলেন, দলের নেতৃত্বে বিপ্লব সংঘটিত হয়েছে, রাষ্ট্রক্ষমতা দলের কব্জায় চলে এসেছে, এ রকম একটা পরিস্থিতিতে উল্লসিত হওয়াই তো স্বাভাবিক! কিন্তু ক’ঘন্টা পরেই যে আনন্দের কারণ লোপ পায় তা নিয়ে বেশি কিছু বলার থাকে না।

শুরুর কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই অভ্যুত্থান এমন ম্রিয়মান হয়ে পড়ার কারণ ব্যাখা করতে গিয়ে সুমন মাহমুদ বলেন, ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের তখনকার ধারণ ক্ষমতা ছিল ১৯৬৬ জন। কিন্তু সেখানে তখন সব মিলিয়ে বন্দী ছিল এরচেয়ে বহুগুণ। যাদের অর্ধেকেরও বেশি ছিল রাজনৈতিক বন্দী। আর তাদেরও ৮০ শতাংশের বেশি ছিল জাসদের লোকজন। সারা দেশ থেকে নেতৃস্থানীয় লোকদেরও এনে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে রাখা হয়েছিলো।

‘শুধু ঢাকা জেলের জাসদ কর্মীদের বের করে আনলেই ঢাকা শহরে অভ্যুত্থান পরিপূর্ণভাবে সফল হতে পারতো। কিন্তু কারাগারের প্রায় সাত/আট হাজার মানুষকে বের করে আনতে একমাত্র নায়েক সিদ্দিককে একা ভেতরে ঢুকতে দেখা গেছে। বিপ্লবী পরিস্থিতির কারণেই সময়ক্ষেপণ পরিহার করে তিন নেতাকে দ্রুত বের হয়ে যেতে দেয়া হয়েছিলো। সিদ্দিক পরে বলেছেন, নেতাদের ‘কন্ট্রোল রুমে’ পৌঁছে দেয়ার পর তাকে অন্য কাজে পাঠিয়ে দেয়া হয়। কারাগারের অন্যান্য লোকদের মুক্ত করে আনার বিষয়টি সম্ভবত: ততক্ষণে পরিত্যক্ত হয়ে গিয়েছিলো।’

এর কারণ ৭ নভেম্বর যেভাবে অভ্যুত্থান শুরু হয়েছিলো তার প্রেক্ষাপট ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই বদলে যায়। কিন্তু,৭ নভেম্বর সম্পর্কে এর গৌরব-গাথা বর্ণনা করা ছাড়া জাসদীয় পরিমণ্ডলে রাজনৈতিকভাবে নিরপেক্ষ নির্মোহ আলোচনা কখনো তেমনভাবে পাননি বলে জানান এই সাবেক জাসদকর্মী।  

১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্টের পর ৩ নভেম্বর সেনাবাহিনীর ডেপুটি চিফ ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ অভ্যুত্থান ঘটান। সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের বাসভবনে গৃহবন্দী করেন। একইসঙ্গে তিনি প্রধান বিচারপতি আবু সা’দাত মোহাম্মদ সায়েমকে দেশের রাষ্ট্রপতি পদে বসান।

কিন্তু ৬ নভেম্বর গভীর রাতে কর্নেল তাহের জাসদ সমর্থিত সেনাসদস্যদের সহযোগিতায় পাল্টা অভ্যুত্থান ঘটিয়ে জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করেন। পরের দিন নিহত হন খালেদ মোশাররফসহ অনেক মুক্তিযোদ্ধা সেনা কর্মকর্তা। জিয়া সরকার পরে কর্নেল তাহেরকেও মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করে।