চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ

‘অবাক হবো না মেয়েরা যদি সেমিফাইনালে যায়’

টি-টুয়েন্টি বিশ্বকাপ-২০১৮, শুরু ৯ নভেম্বর

দীর্ঘদিনের কঠোর পরিশ্রমের পথ ধরে অনেক বড় প্রাপ্তি। শক্তিশালী ভারতকে হারিয়ে এশিয়া কাপ জয়। তার রেশ ধরে এসেছে আরও কয়েকটি সাফল্য। বেড়েছে সালমা-রুমানাদের আত্মবিশ্বাস। টাইগ্রেস ক্রিকেট ঘিরে বড় হয়েছে দেশের মানুষের প্রত্যাশার বেলুনও। এখন চাওয়া, বিশ্বকাপেও ভালো কিছু।

মঙ্গলবার সন্ধ্যায় টি-টুয়েন্টি বিশ্বকাপ খেলতে ওয়েস্ট ইন্ডিজ রওনা হবেন সালমা-জাহানারারা। দেশ ছাড়ার আগে নারী ক্রিকেটের দেখভালের দায়িত্ব থাকা নাজমুল আবেদিন ফাহিম চ্যানেল আই অনলাইনকে দেয়া একান্ত সাক্ষাতকারে জানালেন বিশ্বকাপ ঘিরে প্রত্যাশা, বাস্তবতা, চ্যালেঞ্জ ও স্বপ্নের কথা।

এশিয়া কাপ জেতার পর পুরো চিত্র বদলে গেছে। আগের দুটি বিশ্বকাপে অংশ নেয়াই ছিল গৌরবের। এবার নিশ্চয় বড় স্বপ্ন নিয়ে যাবে বাংলাদেশ দল?
আমরা সে পর্যায়ে এখনও যাইনি যে বলে দিতে পারব বিশ্বকাপে খুব সন্তোষজনক কিছু করে ফেলব। তবে হ্যাঁ, ম্যাচ জিততে পারব। সেমিফাইনালে যেতে পারব সেটা খুব আত্মবিশ্বাস নিয়ে বলতে পারব না। যদিও আমরা এশিয়া কাপ জিতেছি, তবে ওই পর্যায়ে আসিনি যে জোর গলায় বলে দিতে পারব বিশ্বকাপে সেমিফাইনালে উঠে যাব।

আমরা এশিয়া কাপ জিতেছিলাম, কারণ অনেকগুলো বিষয় একসঙ্গে হয়ে গিয়েছিল। যেটা হওয়ার সম্ভাবনা সবসময় থাকে না। আশাবাদী যে আমরা ভালো করব। ওখানে গিয়ে খেলার পর বোঝা যাবে আমরা কোথায় আছি। আমরা বদলের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি। এশিয়া কাপ জেতার পর প্রত্যাশা অনেক বেড়েছে। খেলোয়াড়দের চিন্তা-ভাবনায়ও অনেক পরিবর্তন এসেছে। ওরাও চায় ভালো করতে। বিশ্বকাপে কী হবে অনিশ্চয়তার ব্যাপার। সবকিছু মিলিয়ে আমাদের যেহেতু অভিজ্ঞতা নেই ওই ধরণের পরিস্থিতি মোকাবেলা করার, সেজন্য না দেখা পর্যন্ত নির্দিষ্ট করে বলা যাবে না আমরা কতটা ভালো করতে পারব। তবে মেয়েরা খুব চেষ্টা করছে।

নারী ক্রিকেট দেখভালের দায়িত্বে আপনি যোগ হয়েছেন। ভারতীয় কোচিংস্টাফ যোগ হয়েছে। অল্পদিনের ব্যবধানে অনেকগুলো সাফল্য নিয়ে আসার পেছনে কী কী বিষয় কাজ করেছে?
এশিয়া কাপের আগের যে একটা বছর আমরা ঘরোয়া ক্রিকেটে খুব মনোযোগ দিয়েছি। ওদের অনেক খেলার সুযোগ নেই এটা সত্যি, কিন্তু যতটুকু খেলেছে সুযোগ পেয়েছে সেগুলো খুব ভালভাবে খেলেছে। ওদের জাতীয় লিগ হয় বা প্রিমিয়ার লিগ হয়। আরও একটা টুর্নামেন্ট পেয়েছিলাম, চার দলের টুর্নামেন্ট হয়েছিল লালমনিরহাটে। সবকিছু মিলিয়ে সব খেলার মধ্যে আমরা চেষ্টা করেছি মনিটর করতে। ভালো খেলোয়াড় যারা আছে, তাদের চোখের মধ্যে রেখেছি, ফিডব্যাক পেয়েছি কী করলে ওরা আরও ভালো করতে পারবে। সবাই একটা মোটিভেশন নিয়েই খেলেছে পুরো মৌসুম। সেটাই মানসিকভাবে অনেক পরিবর্তন এনেছে।

নাজমুল আবেদিন ফাহিম

সাউথ আফ্রিকায় যে ট্যুর ছিল, আমরা একটা ম্যাচও জিতিনি; কিন্তু গ্র্যাজুয়্যালি উন্নতি হয়েছে। সেটা আমরা অনুভব করতে পারছিলাম যে, আমরা আস্তে আস্তে এগিয়ে যাচ্ছি। সাউথ আফ্রিকায় আমরা শেষের এক বা দুইটা টি-টুয়েন্টি জিতে যেতে পারতাম। ধাপে ধাপে টিমটা উঠে এসেছে। তার ফলশ্রুতিতে এশিয়া কাপ জেতা। এশিয়া কাপ পুরোটাই একটা মনস্তাত্ত্বিক ব্যাপার ছিল আমাদের জন্য। মানসিকভাবে আমাদের দলটা খুব ভালো অবস্থায় ছিল। হার-জিত তো ছিলই, কিন্তু খুব ভালো খেলতে হবে এবং ভালো খেলতে পারি, এই বিশ্বাসও ছিল দলের মাঝে। সেটা বড় কারণ ছিল এশিয়া কাপে ভালো করার।

বিদেশের মাটিতে টানা সাফল্যের মধ্যে থাকা দলটি ঘরের মাঠে পাকিস্তানের সঙ্গে টি-টুয়েন্টি সিরিজে ভালো করেনি। সেটার প্রভাব দলের মাঝে কতটা আছে?
কক্সবাজারে পাকিস্তানের বিপক্ষে টি-টুয়েন্টিতে মোটেই ভালো করতে পারিনি। এটা একদিক থেকে ভালো হয়েছে; আমরা যে ভালো অবস্থায় নেই সেটা পাকিস্তানের সঙ্গে না খেললে বুঝতে পারতাম না। ওখানে এবং তারপর আমরা কিছু কাজ করেছি। পাকিস্তানের সঙ্গে কিছু কিছু জায়গায় একটু ভালো খেলেছিও। শেষে ওয়ানডে ম্যাচটা জিতেছি, যা কিছুটা আত্মবিশ্বাস দেবে।

তবে দল এখনও সে অবস্থায় নেই, এশিয়া কাপের সময় যে অবস্থায় ছিল মানসিকভাবে। সামনে যেকটা দিন আছে, হয়ত আত্মবিশ্বাস আরেকটু বাড়বে। আত্মবিশ্বাস এখন বড় ইস্যু হয়ে যাবে আমাদের জন্য। খেলা যত কাছে আসবে ওরা মানসিকভাবে একটু চিন্তিত হতে থাকবে। আগে প্রত্যাশার ভার নিয়ে ওদের খেলার অভিজ্ঞতা কখনও হয়নি, এখন সেটা হচ্ছে। সেটা ওদেরকে কীভাবে প্রভাবিত করে সেটাই দেখার। আমাদের চেষ্টা থাকবে জায়গাটায় ওদের সাহায্য করার, যেন শক্ত থাকতে পারে, স্থির থাকতে পারে। আশা করছি সেটা ওরা পারবে।

আমাদের শক্তির জায়গা তো স্পিন। ওয়েস্ট ইন্ডিজের মাটিতে কুবরা-রুমানা-সালমা নাহিদারা সফল হতে পারবে কিনা?
আমাদের মূল শক্তি আসলেই স্পিন। স্পিনাররা যদি প্রতিপক্ষকে ধরে রাখতে পারে, সম্ভাবনা থাকবে ম্যাচ জেতার। যেকোনো উইকেটে ওরা ভালো করতে পারে, ব্যাটসম্যানদের আটকে রাখতে পারে। সে ক্ষমতা ওদের আছে। সাউথ আফ্রিকা, আয়ারল্যান্ডের মতো কন্ডিশনেও দেখেছি। ওদের উপর খুব নির্ভর করবো আমরা। পাশাপাশি ব্যাটারদের ভালো একটা পুঁজি এনে দিতে হবে। আশা করছি না ওখানে ১৪০-১৫০ রান করে দেবে ব্যাটসম্যানরা। করার সক্ষমতা নেই সেটা বলছি না। আশা করছি আমাদের বোলাররা প্রতিপক্ষকে কম রানে আউট করবে। ব্যাটসম্যানরা যদি ১২০-১২৫ রান করতে পারে, সেটা ডিফেন্ড করার মতো শক্তি ওরা রাখবে। সেটাই আশা করছি।

এশিয়া কাপ জয়ী টিম টাইগ্রেস

অনুশীলনে দেখেছি রানিং বিটুইন দ্য উইকেটে ব্যাটসম্যানরা আগের তুলনায় অনেক ফাস্ট। এটির উপর কী বিশেষ জোর দেয়া হচ্ছে?
আগের চেয়ে ফিটনেস যথেষ্ট ভালো হয়েছে। এখন ওরা অল্পতেই ক্লান্ত হয়ে যায় না। স্পিড বেড়েছে। দৌড়ের আগ্রহটা বেড়েছে। এ ব্যাপারে ওদের কৃপণতা নেই, যেটা একসময় ছিল। কিছু কাজ হয়েছে রানিং বিটুইন দ্য উইকেট নিয়ে। যার ফল আমরা পাচ্ছি। আমার ধারণা ৫-৭টা রান বেশি হতে পারে আগের তুলনায়। কারণ ওরা উন্নতি করেছে।

নারী দলের কোচিংস্টাফদের কী মনোভাব বিশ্বকাপ নিয়ে?
ওরা খুব পরিশ্রম করছে ক্রিকেটারদের নিয়ে। এশিয়া কাপ জেতার পর ওরাও খুব আশাবাদী দল বিশ্বকাপেও ভালো করবে। গত মাসদুয়েক অনেক কাজ করেছে। যতটুকু কাজ হয়েছে, ফল আমরা এখনও দেখতে পাইনি। আমার ধারণা আস্তে আস্তে দেখতে পাবো। গত দুই-তিন সপ্তাহে অনেক কাজ হয়েছে। সপ্তাহখানেক আগেই আমরা ওয়েস্ট ইন্ডিজ যাচ্ছি। গ্রেনেডায় আরও অনুশীলনের সুযোগ আছে। আমাদের কোচেরা অত্যন্ত পরিশ্রমী। আমার বিশ্বাস এই দল ভালো করবে।

বিশ্বকাপের মতো আসরে ক্রিকেটারদের মানসিক চ্যালেঞ্জ কী থাকবে আর আপনার পরামর্শ কী থাকবে?
কেউ যদি সন্তুষ্ট হয়ে যায় আমরা এশিয়া কাপ জিতে গেছি, সবাই আমাকে চেনে, আমি একজন প্রতিষ্ঠিত খেলোয়াড়, আমার জীবনে আর পাওয়ার কিছু নেই, বিশ্বকাপ খেলে বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসের একটা অংশ হয়ে গেলাম; যদি এভাবে ভেবে থাকে সেটা ভুল হবে। সেটা তাকে আবার নিচে নামিয়ে আনবে। জার্নিটা কেবল শুরু হল। আমরা সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পেরেছি। এশিয়া কাপের মধ্য দিয়ে বা তারপরের কয়েকটি সাফল্যের মধ্য দিয়ে। এটা ধরে রাখাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। যে চেষ্টা, উদ্যম, স্বপ্ন যাদের মধ্যে থাকবে সত্যিকার ভালো খেলোয়াড় কিন্তু তারাই।

চ্যালেঞ্জটা যারা গ্রহণ করবে এবং পার হতে পারবে সত্যিকার খেলোয়াড় তারাই। আমরা সেটাই আশা করবো, খেলোয়াড়রা যেন সেই চিন্তাটা করে। সবাই ওদের চেনে, ওরা ভাল ক্রিকেটার; এটা যদি ওরা মনে করে তাহলে সেটি সবচেয়ে দুঃখজনক হবে। ওদের দায়িত্ব হল পরবর্তী এক-দুই-তিন বছর বাংলাদেশের মহিলা ক্রিকেটকে বাঁচিয়ে রাখা। তারপর আরেকটা প্রজন্ম আসবে তারা হয়তো পরের ভারটা নেবে। ওদের দায়িত্বটা এখন অনেক বড়।

সাফল্যে বেড়েছে প্রত্যাশা

প্রথম ম্যাচেই ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন ও স্বাগতিক দেশ ওয়েস্ট ইন্ডিজ আমাদের প্রতিপক্ষ। ইংল্যান্ড, সাউথ আফ্রিকার মতো বড় দলও আমাদের গ্রুপে।
আমাদের দলটা এখন এমন পর্যায়ে আছে হয়তো তারা ফেভারিট না, হয়তো ফেভারিট হিসেবে মাঠে নামতে পারবে না, কিন্তু সব দলকে হারানোর মতো সুযোগ আছে। যদি ম্যাচে কিছু কিছু জিনিস ঘটে তাতে যেকোনো দলকে হারানোর শক্তিই তাদের আছে। এটা বারবারই বলবো, ইংল্যান্ড বা ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে আমরা ফেভারিট হিসেবে নামতে পারবো না; কিন্তু তার মানে এই না আমরা ম্যাচ জিততে পারব না। যদি ভালো খেলতে পারি, বিশেষ করে বোলাররা ভালো করে, ব্যাটসম্যানরা যদি সাপোর্ট দেয়, আমরা অবশ্যই জিততে পারব। আমি খুব অবাক হবো না যদি সেমিফাইনালে চলে যাই।

এশিয়া কাপের সময় মেয়েদের খেলায় চোখ রেখেছিল দর্শকরা। বিশ্বকাপে তো খেলা দেখার আগ্রহ আরও বেশি থাকবে। টাইগ্রেস ক্রিকেটের ব্র্যান্ডিংয়ে বিশ্বকাপে ভালো পারফরম্যান্স কতটা জরুরী?
দেশকে যারা প্রতিনিধিত্ব করে তারা যদি আন্তর্জাতিকভাবে দেশের মুখ উজ্জ্বল করতে পারে সবাই খুশি হয়। সেটা ছেলে হোক বা মেয়েরা। মেয়েরা যদি একটা বড় দলকে ওখানে হারাতে পারে বা সেমিফাইনালে উঠতে পারে, সেটার গৌরব সবাই অনুভব করবে। মেয়েদের খেলার যে প্রচার হবে, সেটা ছেলেদের খেলার মতোই হবে। বিশ্বব্যাপী সবাই দেখবে। সেটার ভাগ যদি আমরা নিতে পারি, মেয়েরা যদি ভালো খেলে নিতে পারে, সেটার ভাগীদার তো আমরা সবাই হবো। আমি নিশ্চিত দেশের মানুষ সমান গৌরবান্বিত হবে। সবাই বোধ হয় অপেক্ষা করছে এটার জন্য যে মেয়েরা কেমন করে। কারণ টিভিতে খেলা দেখবে। আমার ধারণা অনেকেই খেলা দেখবে এবং আশা করছি মেয়েরা ভালো করবে।

আপনি নিজে কতটা মুখিয়ে আছেন সামনে থেকে মেয়েদের পারফরম্যান্স দেখতে?
আমি খুবই এক্সাইটেড। এশিয়া কাপে এক ধরণের এক্সাইটমেন্ট ছিল। এখন আমরা একটা প্রস্তুতি নিয়ে যাচ্ছি। কিছু প্রত্যাশা নিয়ে যাচ্ছি। অন্য ধরণের চিন্তা-ভাবনা কাজ করছে সবার মাঝে। প্রত্যাশার ব্যাপার আছে। সেটার সাথে মিলিয়ে কতটা পারফর্ম আমরা করতে পারবো, মুখিয়ে আছি দেখতে। মেয়েরা কেমন করে, সেটার উপর মেয়েদের ক্রিকেটের ভবিষ্যতও নির্ভর করবে। যদি আমরা ভালো করতে পারি, অনেকেই স্পন্সর হিসেবে আসতে চাইবে। মেয়েদের ক্রিকেট এগিয়ে যাবে, সুনাম হবে। অনেক কিছুই নির্ভর করছে বিশ্বকাপে পারফরম্যান্সের উপর।