কবি, প্রাবন্ধিক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও বুদ্ধিজীবী ফরহাদ মজহারের অন্তর্ধান ও উদ্ধার রহস্যময় হয়ে ওঠেছে। গত দুই দিন এনিয়ে রহস্যের ডালপালা পাখা গজাচ্ছে। অপহরণ, নাকি আত্মগোপন- এনিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে দুই মত বাজারে প্রচলিত, এবং স্বভাবত অধিকাংশই দ্বিধাবিভক্ত।
ফরহাদ মজহারের বাড়ি থেকে বের হওয়ার সিসিটিভি ফুটেজ বিভিন্ন মিডিয়ায় দেখেছি। ফুটেজ দেখে প্রমাণ হয়েছিল তিনি ভোররাতে একা বাড়ি থেকে বের হয়েছিলেন। তার পরিবারকে উদ্ধৃত করে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম জানিয়েছে বাড়ি থেকে বের হওয়ার কিছু সময় পরই তিনি নিজের জীবনের বিপণ্ণতার খবর জানিয়েছিলেন; বলেছিলেন ৩৫ লাখ টাকা মুক্তিপণের কথা। তার এ নিখোঁজ সংবাদ প্রচারের পর পরই আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তৎপর হয়, এবং তারা মোবাইল ট্র্যাকিংয়ের মাধ্যমে তার অবস্থান শনাক্তের কথাও জানায়। বিষয়টি অনলাইন ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় প্রকাশ হয়।
পুলিশ বারবার ফরহাদ মজহারের অবস্থানের তথ্য জানাচ্ছিল, বলছিল মোবাইল ট্র্যাকিংয়ের কথা। মোবাইল চালু অবস্থায় এধরনের অবস্থান শনাক্ত সম্ভব, ফলে প্রমাণ হয় ফরহাদ মজহারের সাথে থাকা মোবাইল চালু ছিল; এবং শেষ পর্যন্ত এর সূত্র ধরেই তাকে উদ্ধার করে পুলিশ-র্যাব, যশোরে হানিফ পরিবহনের বাসে। এ বাসে করে তিনি রাতে ঢাকা ফিরছিলেন বলে পুলিশের ভাষ্য।
ফরহাদ মজহারের নিখোঁজের পর তার শত্রু-মিত্র প্রায় সকলেই উদ্ধারের দাবি জানিয়েছিলেন। তার এ নিখোঁজের ঘটনায় সরকার দায় এড়াতে পারে না বলে অভিমত ছিলো অনেকের, এবং এটিই ছিল স্বাভাবিক। কারণ সরকারের পক্ষ-বিপক্ষ মতের সকল মানুষের নিরাপত্তার দায়িত্ব সরকারের। ফরহাদ মজহার পরিষ্কারভাবে আওয়ামী লীগ সরকারের বিপক্ষের মানুষ। বিএনপির সরকার পতনের আন্দোলনের সময়কার বোমাবাজিকেও তিনি নিঃশর্ত সমর্থন দিয়েছিলেন। এমনকি মিডিয়ার অফিসে বোমা মারাকেও তিনি নৈতিক বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন। তার ভাষায় “বোমা হামলাকারীরা সন্ত্রাসী হলে মুক্তিযোদ্ধারাও সন্ত্রাসী (আমাদের সময়, ৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৫)। তিনি বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের শাস্তির দাবি জানানো মানুষদের বিপক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন, ৫ মার্চ মতিঝিলের শাপলা চত্বরে হাজার হাজার হেফাজত সমর্থক নিহত হয়েছিল বলে জোর দাবিদারদের অন্যতম তিনি। এতকিছুর পরেও দেশের একজন নাগরিক হিসেবে সরকারের দায়িত্ব তারও নিরাপত্তা বিধান করা। সে হিসেবে মানুষের প্রাথমিক ক্ষোভ ছিল সরকারের বিপক্ষে এমন অন্তর্ধানের পর। একই সঙ্গে দাবি ছিল অক্ষত উদ্ধারের।
সরকার-প্রশাসন প্রথম থেকেই বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে দেখেছিল। সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এ পর্যায়ে দায়িত্বশীল বক্তব্যও দিয়েছিলেন, জানিয়েছিলেন দ্রুত অবস্থান শনাক্তের বিষয়ে। পরে রাতে তাকে উদ্ধারও করা হয়।
উদ্ধারের পর পুলিশের পক্ষ থেকে করা সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, হানিফ পরিবহনে ঢাকা ফেরার পথে যশোর থেকে তাকে উদ্ধার করা হয়েছে। বাসে তিনি মি. গফুর নামে টিকিট কেটেছিলেন। এছাড়াও জানানো হয়, উদ্ধার হওয়ার সময়ে তার কাছ থেকে একটা ব্যাগ এবং ব্যাগের মধ্যে গেঞ্জি, মোবাইল চার্জার ও সামান্য টাকাপয়সাও পাওয়া গেছে। পুলিশের ধারণা সমূহ প্রস্তুতি নিয়েই তিনি ভ্রমণে বেরিয়েছিলেন। এদিকে, পুলিশ যখন ফরহাদ মজহারের সাথে ব্যাগ পাওয়ার কথা জানাচ্ছিল তার কন্যা জানাচ্ছেন তার বাবা যেধরনের ব্যাগ ব্যবহার করেন এ ব্যাগ সেরকম নয়। তাছাড়া সিসিটিভি ফুটেজে ফরহাদ মজহারের বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময়ে হাতে কোন ব্যাগ দৃশ্যমান হয় নি। তাহলে কোথা থেকে আসল এ ব্যাগ? তবে কী অন্য কোথাও গিয়েছিলেন তিনি যেখান থেকে ব্যাগ নিয়েছেন?
ফরহাদ মজহারের নিখোঁজের পর বিএনপির পক্ষে থেকে সংবাদ সম্মেলন করা হয়েছে। দলটির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া নিজে টুইটারে পোস্ট দিয়েছেন। বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবীর রিজভী এটাকে অপহরণ হিসেবে আখ্যা দিয়ে এরজন্যে সরকারের বিভিন্ন এজেন্সি জড়িত থাকতে পারে বলেও মন্তব্য করেছিলেন। এর পরিণতি শুভ হবে না বলেও কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে দলটি। কেবল বিএনপির আনুষ্ঠানিক বক্তব্যই নয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ড. আসিফ নজরুল, তুহিন মালিক, আনু মুহাম্মদ, মাহমুদুর রহমান মান্না সহ আওয়ামী লীগ বিরোধি রাজনীতিবিদ ও এক্টিভিস্টরা এজন্যে সরকারকে দোষারোপ করেছেন। মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল তাদের ওয়েবসাইটেও এনিয়েও সংবাদ প্রকাশ করে, যদিও উদ্ধারের পর পরই অ্যামনেস্টির সে প্রতিবেদন আর খুঁজে পাওয়া যায় নি।
কেবল আওয়ামী লীগ ও সরকারবিরোধি মানুষজনই না, অনেক আওয়ামী লীগ সমর্থকও ফরহাদ মজহারকে উদ্ধারের দাবি জানিয়েছিলেন। এর কারণ বাংলাদেশের চলমান হত্যা, গুম, অপহরণের সংস্কৃতি। বিএনপির সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক এম ইলিয়াস আলীর নিখোঁজের ঘটনা এখনও রহস্যাবৃত। তার বেঁচে থাকার সম্ভাবনা ক্ষীণ হলেও সরকার-প্রশাসনের পক্ষ থেকে এখনও মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করা হয় নি। এরবাইরে আরও অনেক অন্তর্ধানের কাহিনী আছে। মানুষের আশঙ্কা ছিল আগেকার ঘটনাগুলোর সাথে এঘটনার মিলের ব্যাপারে। সুখবর হলো এমন কিছু হয় নি, অক্ষত ও সুস্থ অবস্থায় উদ্ধার করা হয়েছে ফরহাদ মজহারকে।
ফরহাদ মজহারের এ অন্তর্ধানের ঘটনা দেশ-বিদেশে ব্যাপক আলোচিত হয়েছে মূলত তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের কারণে। একসময়ের অজ্ঞেয়বাদী এ ব্যক্তিত্ব বর্তমানে তুমুল ডানপন্থী। আবার একইভাবে তিনি বামপন্থীদেরও প্রিয়ভাজন। দক্ষিণপন্থাপ্রিয় ডান-বাম দুই দলের কাছেই তিনি সমভাবে প্রিয়। রহস্যে ঘেরা জীবনের অধিকারী ফরহাদ মজহার একাধারে কবি, প্রাবন্ধিক, কলামলেখক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক, এনজিও মালিক, গবেষক, গীতিকার, সমাজকর্মী, ভাবশিল্পী, যুক্তিবাদী, আধ্যাত্মবাদী- সকল ক্ষেত্রেই তার অবস্থান। তিনি এক লেখায় সৃষ্টিকর্তাকে অস্বীকার করে বাতিল ঘোষণা করেন, আবার অন্য লেখায় সে তিনিই বিনত হন সৃষ্টিকর্তার সমীপে।
শেষ পর্যন্ত ফরহাদ মজহার ফিরেছেন এটা আপাত স্বস্তি, কিন্তু কেন তিনি নিখোঁজ হলেন, কী প্রক্রিয়ায় তাকে ফেরত আনা হলো এবং দীর্ঘ ১৮ ঘণ্টা সময়ের নানা ঘটনাপ্রবাহ রহস্যের জন্ম দিচ্ছে। ভোররাতে একা ঘরে থেকে বের হয়ে অপহৃত হয়েছিলেন, আবার মাঝরাতে তাকে উদ্ধারও করা হলো- এই সময়ে যত ঘটনা ঘটল তার কোনোটির সাথে কোনোটির ধারাবাহিকতা থাকছে না, সবকিছু কেমন জানি অগোছালো! উদ্ধারের পরের দিন মঙ্গলবার বেলা সোয়া একটার দিকে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) মিডিয়া সেন্টারে অনুষ্ঠিত ব্রিফিংয়ে ডিএমপির যুগ্ম কমিশনার আব্দুল বাতেন বলেছেন, “ফরহাদ মজহারকে কয়েকজন চোখ বেঁধে মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে গিয়েছিল। সোমবার ভোরে তিনি নিজের বাড়ি থেকে ওষুধ কিনতে বের হয়েছিলেন। পথে এ ঘটনা ঘটে।” পুলিশের এমন তথ্যও রহস্যজনক। ভোর ৫টায় ওষুধের জন্যে বাইরে যাওয়া রীতিমত প্রশ্নবোধকই, তাছাড়া এমন তথ্য আগে ফরহাদ মজহারের পরিবার কখনও দেয় নি। উদ্ধারের পর ফরহাদ মজহার কি নিজে পুলিশকে জানিয়েছেন এমন কিছু?
উদ্ধারের পর র্যাব, পুলিশ, গোয়েন্দারা ফরহাদ মজহারকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। ওই সূত্র ধরে পুলিশও জানাচ্ছে বিভিন্ন তথ্য। সরকারবিরোধিরা একে সরকারের বিপক্ষে এক হাতিয়ার হিসেবে নানামুখী বক্তব্য প্রচার করছে, বিএনপিপন্থীরা নিতে চাইছে রাজনৈতিক ফায়দা। নিখোঁজের পর বিএনপি যেখানে দ্রুত উদ্ধারের দাবি জানিয়েছিল সেখানে উদ্ধারের পর হঠাতই আশাহত হয়ে ওঠা সে বিএনপিই আবার এঘটনাকে নাটক হিসেবে আখ্যা দিতে শুরু করেছে। মঙ্গলবার বিকেলে রাজধানীর নয়াপল্টনে ভাসানী ভবনে জাতীয়তাবাদী স্বেচ্ছাসেবক দল, ঢাকা মহানগর দক্ষিণের কর্মী সভায় রিজভী বলেন, “কোরবানি ঈদের জন্য সরকার নাটক সিনেমা তৈরি করছে যার পরিচালক প্রযোজক সরকার নিজেই। তারই অংশ হিসেবে ফরহাদ মজহারকে অপহরণ করার পর যখন দেখেছে দেশের মানুষ জেগে উঠছে তখনই আবার ছেড়ে দিয়েছে।” ফরহাদ মজহারকে হেনস্থা করার বিষয়টিকে রিজভী বিএনপিকে নির্বাচন থেকে দূরে রাখার একটি ষড়যন্ত্র হিসেবেও উল্লেখ করেন।
এদিকে, আদালতেও জবানবন্দি দিয়েছেন ফরহাদ মজহার। তার ওপর মিডিয়ায় বিভিন্ন বক্তব্যও এসেছে। মিডিয়া, পুলিশ, পরিবার, রাজনৈতিক দল ও বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষের মতামতের পর বিষয়টি আরও প্যাঁচ লেগে যাচ্ছে। এক ঘটনার সঙ্গে আরেকটার অমিল কিংবা ধারাবাহিকতাহীনতায় তার অন্তর্ধানের বিষয়টি রহস্যময় হয়ে ওঠেছে।
এমন অবস্থায় রহস্যের জট খুলবে কীভাবে? ফরহাদ মজহার নিজে কি সৎ ও সত্য বক্তব্য দেবেন? তার দীর্ঘ ভাব, চিন্তা, চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, ধ্যানজ্ঞানে সরকারবিরোধিতা, সরকারবিরোধিপক্ষের অব্যাহত উসকানি সত্বেও একবার মনে হয় সত্য বক্তব্য দেবেন তিনি, আরেকবার মনে হয়- “না”! অথচ এক্ষেত্রে রহস্যের উন্মোচন জরুরি ছিল।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)