ভাসানচর থেকে ফিরে: শুরু থেকেই মানবাধিকার সংগঠন এবং পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো বলে আসছিল ভাসানচর কোনভাবেই বসবাস উপযোগী নয়। এক্ষেত্রে তাদের পক্ষ থেকে যুক্তি দেখানো হচ্ছিলো, পানীয় জলের কোনো উৎস না থাকা, দ্বীপটির প্রতিনিয়ত জোয়ার-ভাটায় ডুবে যাওয়া, দ্বীপের অপেক্ষাকৃত উঁচু স্থানটি এখনো স্থায়ী না হওয়া, পাড় থেকে নেমে উঁচু স্থানে যেতে হাঁটু সমান কাদার স্তর থাকাসহ বিভিন্ন কারণ।
এর বিপক্ষে সরকারের যুক্তি ছিলো: ভরা জোয়ারের সময়ও পানির স্তর থেকে অন্তত চার ফুট উঁচুতে থাকে চরটি। বনের গাছগুলোও বেশ পোক্ত, তাছাড়া আনুষঙ্গিক অবকাঠামো করা হলে এখানে জনবসতি স্থাপনে কোনো সমস্যা হবে না। আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে চরটি বসবাস উপযোগী করা সম্ভব। সেই সঙ্গে ভাসানচরে বেড়িবাঁধ নির্মাণ হলে আর পানিও ঢুকবে না বলেও সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়।
পক্ষে-বিপক্ষে যুক্তি তর্কের সময় এখন দূর অতীত। নৌবাহিনীর প্রত্যক্ষ তত্বাবধানে এবং হাজারো শ্রমিকের ঘামে ক্রমেই বসবাস উপযোগী হয়ে উঠছে ভাসানচর। কাজ চলছে দিন রাত। কাঙ্খিত বেড়িবাঁধের কাজও শেষ পর্যায়ে। এরই মধ্যে কাজ শুরু হয়েছে সাইক্লোন সেন্টারের। পাইলট প্রজেক্টের আওতায় নৌবাহিনী তৈরী করেছে ক্লাস্টার পাইলট প্রজেক্ট। যেখানে রয়েছে বসবাস উপোযোগী ঘর, রান্নার স্থান, টয়লেট ও পানি ফিল্টারিংয়ের ব্যবস্থা। এটিকে অনুসরণ করেই তৈরী হবে ১২টি সেন্টারের ১ হাজার ৪শ’ ৪০টি ঘর।
ভাসানচরের কর্মযজ্ঞ এবং সেখানকার জীবনযাপন
৩০টি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের অধীনে চলছে ভাসানচরকে বসবাস উপযোগী করে তোলার বিশাল কর্মযজ্ঞ, যেখানে কাজ করছে প্রায় ১২০০ শ্রমিক। ভেতরে প্রবেশ করতেই চোখে পড়বে বড় বড় ট্রলারে করে এনে রাখা নির্মাণ সামগ্রী, যার সবটাই এসেছে চট্টগ্রাম-নোয়াখালীর মূল ভূখণ্ড থেকে। সেগুলো ছোট ছোট ট্রাক্টরে করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে চরের বিভিন্ন অংশে। এর পাশাপাশি উচু-নিচু জায়গাগুলো মাটি কাটার মেশিনের সাহায্যে সমতল করা হচ্ছে।

নৌবাহিনীর পক্ষ থেকে ভাসানচরের দায়িত্বে থাকা লেফটেন্যান্ট রশিদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেলো স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরতে এখনও সময় লাগবে তিন থেকে চার মাস। তবে সেটা প্রকৃতির অনুগ্রহের ওপর নির্ভর করছে।
মাটির রাস্তায় ট্রাক্টরে করে উচু স্থানের মাটি এনে নামানো হচ্ছে নিচু স্থানে। ট্রাক্টরগুলো যাওয়ার সময় ধুলোয় রাস্তায় হাটা দায় হয়ে দাঁড়ায়। এর মাঝেই চোখে পড়লো কয়েকজন বিদেশীকে, যারা এসব কর্মযজ্ঞের চিত্র ধারণ করছেন। সীমাবদ্ধতা থাকায় তাদের কাছ থেকে মন্তব্য নেওয়া সম্ভব না হলেও শ্রমিকদের কাছ থেকে জানা গেলো এরা প্রত্যেকেই উন্নয়ন সহযোগী সংস্থার সদস্য। প্রায়ই তারা এসে চরটি ঘুরে দেখেন। মাঝে মাঝে তাদের সঙ্গে কথা বলে ভালো মন্দ জানতে চান।
কথা হলো চাপইনবাবগঞ্জ থেকে আসা আছির উদ্দিনের সঙ্গে। তিনি জানালেন গত একমাসের অভিজ্ঞতার কথা। বলেন, এখানে এক মাস আগে আসছি। প্রথম দিকে তেমন কিছুই ছিলো না। শুনেছি এখানে দস্যুরা থাকতো। তবে, আমরা এসে পাইনি। এছাড়া চর জুড়ে মহিষের বাথান থাকার কথা জানালেন আছির।
কাজের পরিবেশ কেমন জানতে চাইলে কিছুটা অভিযোগের সুরেই তিনি বলেন: আমি আর সিরাজ এখানে এসেছিলাম রমিজ দালালের মাধ্যমে। টাকা কামাইতে। আমাদের বলা হয়েছিলো প্রতিদিন পারিশ্রমিক দেওয়া হবে ৬০০ টাকা, কিন্তু পাচ্ছি ৪৫০ টাকা। এখানেই শেষ নয়, অনেক সময় দালাল পারিশ্রমিকের টাকা নিয়ে টালবাহানা করে।
তবে, সবচেয়ে বড় সমস্যা খাওয়া দাওয়া। আমাদের খাবার আসে ২০ কিলোমিটার দূরের হাতিয়া দ্বীপ থেকে। ওখানকার কিছু লোকের সঙ্গে দালালদের যোগাযোগ রয়েছে। তারা প্রতিদিন সকালে এখানে আসে রান্নার জিনিসপত্র নিয়ে। রান্না করে আবার তারা চলে যায়। মাঝে মাঝে আমাদের সঙ্গে তাবুতে দু’একজন করে রয়েও যায়। কিন্তু সমস্যা তাদের নয়। আমাদের খাওয়ার দায়িত্ব যার ওপর রয়েছে তিনি ওদের বলেন এ বেলা ১০ জন খাবে। কিন্তু দেখা যায় সেই খাবার ২০ জন মিলে খেতে হচ্ছে। এখানে দালালরা টাকা বাঁচানোর চেষ্টা করে। এ কারণে আমাদের অনেক কষ্ট করতে হয়। পেটে ভাত না থাকলে তো আর কাজ করা যায় না।

এর মধ্যে তাদের গ্রুপ থেকে দু’দফা রান্নার ঠিকা নেওয়া লোকেরা কাজ ছেড়ে চলে গেছে বলে জানালেন আছির।
শ্রমিকরা সাধারণত তাবু করে থাকছেন চরটিতে। তবে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের অফিসারদের জন্য রয়েছে থাকার সু-ব্যবস্থা। ইট দিয়ে উঁচু করা স্থানে কার্গো ডেকার বসিয়ে থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। রয়েছে শীততাপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাও। এজন্য জেনারেটরের মাধ্যমে তৈরী করা হচ্ছে বিদ্যুৎ।
(শেষ পর্বে থাকবে ভাসানচরের ভৌগলিক অবস্থা, পরিবেশ ও জীবজগৎ সম্পর্কে বিস্তারিত)
