অনেক বড় প্ল্যান-প্রোগ্রাম করে ঘুরতে যাওয়া হয় না। এটা অনেকটা, ‘ইচ্ছে হলো, বেরিয়ে পড়লাম’ গোছের। আমার ক্ষেত্রে বেড়াতে যাওয়াটা এমনই। তবে এবার কথা ছিল বান্দরবান যাব। কিন্তু শেষ মুহূর্তে সিদ্ধান্ত বদল করি। কারণ আমাদের সাজেক যাওয়া হয়নি। অথচ পরিচিতরা প্রায় সবাই গেছে। ফিরে এসে অনেকে অনেক গল্পও দিয়েছে। যদিও এই ভরাবর্ষায় সাজেক যাওয়াটা বেশ রিস্কি, তারপরও সিদ্ধান্ত: সাজেকই যাব। যা হয় হবে। নীলগিরিতে রাত কাটিয়েছি। কিন্তু সাজেকে রাত কাটানো হয়নি। এবার সেই সুযোগটা নিতে হবে।
যেমন ইচ্ছে তেমন কাজ। এবার বড় টিম নয়, তা ছাড়া এই ঘনবর্ষায় প্রতিনিয়ত ভূমিধস হওয়া মৌসুমে বাচ্চা-কাচ্চাবর্জিত টিম হওয়াই ভালো। ছোট্ট টিম। আমি, আমার বউ ববি আর বন্ধু পরিমল। অলসের গঙ্গা নাকি হাতের কাছেই থাকে। আমার ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম হলো না। আমার তুখোড় ও উদ্যমী সহকর্মী খাগড়াছড়ির বাসিন্দা নবলেশ্বর দেওয়ানকে পেয়ে গেলাম হাতের কাছে। বলামাত্র সে একে-ওকে ফোন করল। আমাকে জানাল, নো চিন্তা, সব ঠিকঠাক!
সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কলাবাগানে টিকেট কাউন্টারে গিয়ে বৃহস্পতিবার রাতে খাগড়াছড়িগামী বাসের টিকেটের সন্ধান। না, কোন বাসে কোন টিকেট নেই। অবশেষে ‘শান্তি পরিবহন’ নামে একটা গাড়ির পেছনের দিকে তিনটে টিকেট পাওয়া যায়। অগত্যা তাই-ই সই। শখ বলে কথা!
নবলেশ্বর খাগড়াছড়ি ও সাজেকে রাত কাটানোর জন্য হোটেলের বুকিং দিয়ে দিয়েছে। ওই দুই হোটেলের দুজনের কন্টাক্ট নম্বর দিয়ে বলেছে, হোটেলে গিয়ে ‘লায়নের গেস্ট’ বললেই হবে। বুঝলাম নবলেশ্বর নিজ এলকায় ‘সিংহ’ তথা ‘লায়ন’ হিসেবেই পরিচিত!
১১ আগস্ট রাত সাড়ে দশটায় কলাবাগান থেকে আমাদের বাস খাগড়াছড়ির উদ্দেশে ছেড়ে যাবার কথা। আমরা দশটার মধ্যে কাউন্টারে পৌঁছে যাই। কাউন্টারের সামনে ‘শান্তি’ নামের একটা বাস পেয়েও যাই। কিন্তু শুনি ওটা নয়টার বাস! সাড়ে দশটার বাস আসতে এক ঘণ্টা লেট হবে। অগত্যা ফুটপাতেই বসে পড়তে হয়। বসে বসে চলে ফেসবুকচর্চা আর অপেক্ষা। একে একে খাগড়াছড়িগামী সব বাসই ছেড়ে যায়, কিন্তু আমাদেরটা আসেই না! অবশেষে রাত ১১টা ৪০মিনিটে আমাদের ‘শান্তি’র দেখা মেলে!
বাস চলা শুরু হওয়া মাত্র পেছনের চাকার ওপরের সিটে বসে দুলুনি আর ধাক্কায় আমরা বুঝে যাই, খবর আছে! ফকিরেরপুল পার না হতেই শুরু হয় বৃষ্টি। এরপর কমলাপুর ছাড়ানোর পর বাস আর নড়তেই চায় না। মহাজ্যামে আটকে থাকে!
এদিকে আমাদের মাথায় চিন্তা বাড়তে থাকে। পরিকল্পনা মতে, আমাদের সকাল সাড়ে ছয়টার মধ্যে খাগড়াছড়ি পৌঁছানোর কথা। সেখানে ‘গাইরিং’ হোটেলে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নাস্তা করবো। তারপর সিএনজি বা চাঁন্দের গাড়িতে করে সাজেকের উদ্দেশ্যে রওনা হব। সাজেকে দিনে দুইবার যাত্রার অনুমতি আছে। সকাল সাড়ে দশটায় আর বিকেল সাড়ে তিনটায় দীঘিনালা থেকে সাজেক যাবার যান চলাচলের অনুমতি দেয়া হয়। উল্লেখ্য, খাগড়াছড়ি থেকে দীঘিনালা আর্মি ক্যাম্প হয়ে সাজেক যেতে হয়। এরপর ১০ নং বাঘাইহাট পুলিশ ও আর্মি ক্যাম্প। যেখান থেকে নিতে হয় সাজেক যাবার মূল অনুমতি।
আমরা যদি সকালের ট্রিপ মিস করি তাহলে আবার সাড়ে তিনটার ট্রিপ ধরতে হবে। সেক্ষেত্রে পৌঁছতে সন্ধ্যা হয়ে যাবে। এদিন আর তেমন কিছু দেখা যাবে না। পরদিন আবার রয়েছে ফেরার তাড়া। সব মিলিয়ে আমাদের টাইট-শিডিউল!
যাহোক, আমাদের গাড়ি যতটুকু না চলে অপেক্ষা করে তার কয়েকগুণ বেশি। এভাবে চলতে চলতে সকাল সাড়ে ছয়টায় পৌঁছলো কুমিল্লা। যখন আমাদের থাকার কথা খাগড়াছড়িতে!
এর পর অবশ্য গাড়ি ভালোই চলেছে। সকাল সাড়ে এগারোটা নাগাদ আমরা প্রচণ্ড বৃষ্টি মাথায় নিয়ে খাগড়াছড়ি পৌঁছলাম। দেখলাম সেখানে রাস্তা দিয়ে পানির স্রোত বইছে। যাহোক, বাস থেকে নেমেই আমরা ছুটলাম হোটেল গাইরিং-এ। সেখানে রিসেপশনিস্টকে ‘আমরা লায়নের গেস্ট’ বলা মাত্র আমাদের জন্য তিনতলায় ঝকঝকে এক রুম বরাদ্দ দেওয়া হলো। আমরা তাকে নাস্তার কথা বললাম। সুযোগ থাকলে নাস্তা করেই সাজেকের উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে পড়ব এ কথাও জানালাম। এই রিসেপশনিস্ট ছেলেটি হোটেলের ম্যানেজার, নাম নয়ন। অতি শান্ত-ভদ্র যুবক নয়ন আমাদের সব কথাতেই সম্মতি দিলেন। যাহোক, সীমাহীন বৃষ্টিকে উপেক্ষা করে আমরা নাস্তা শেষে বেরিয়ে পড়লাম গাড়ি ভাড়া করতে। যেখান থেকে সাজেকগামী যান ছেড়ে যায়, সেখানে গিয়ে আমরা একটা অটোরিক্সা ভাড়া করলাম যা বেশি পরিচিত সিএনজি হিসেবে। সে আমাদের তিনজনকে নিয়ে যাবে, রাতে থাকবে। পথে পথে যা কিছু দেখার দেখাবে। এরপর দুপুর তিনটায় সাজেক থেকে ফিরে গাইরিং হোটেলে পৌঁছে দেবে। মোট হাদিয়া ৪০০০ টাকা।
এই অটো চালকের নাম কুদ্দুস। চটপটে, হাসিখুশি। বয়স ত্রিশের কোঠায়। বিবাহিত। খাগড়াছড়িতেই জন্ম, বড় হওয়া। আদিনিবাস সুনামগঞ্জ। কোনো কিছুতে তার ‘না’ নেই, বিরক্তিও নেই। আমরা কুদ্দুসের ফোরস্ট্রোক অটোতে করে রওনা হয়ে গেলাম। দীঘিনালায় পৌঁছে সেনাচৌকিতে নাম-ঠিকানা লিখতে হলো। তারা একটা টোকেন ধরিয়ে দিল। অবশেষে পৌনে চারটার সময় সাজেকগামী গাড়ির বহর চলার অনুমতি পেল। এর মধ্যে চলছিল ধুম বৃষ্টি।
এখানে বলে রাখা দরকার যে, সাজেক হচ্ছে দেশের বৃহত্তম ইউনিয়ন। পার্বত্য জেলা রাঙ্গামাটির বাঘাইছড়ি উপজেলায় এ ইউনিয়ন। যার আয়তন ৭০২ বর্গমাইল। সাজেকের উত্তরে ভারতের ত্রিপুরা, দক্ষিণে রাঙামাটির লংগদু, পূর্বে ভারতের মিজোরাম, পশ্চিমে খাগড়াছড়ির দীঘিনালা। সাজেক রাঙামাটি জেলায় অবস্থিত হলেও এর যাতায়াত সুবিধা খাগড়াছড়ির দীঘিনালা থেকে। খাগড়াছড়ি জেলা সদর থেকে এর দূরত্ব ৭০ কিলোমিটার। আর দীঘিনালা থেকে ৪৯ কিলোমিটার । বাঘাইহাট থেকে ৩৪ কিলোমিটার। সমুদ্রপৃষ্ট থেকে প্রায় ১ হাজার ৮০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত সাজেকে রয়েছে পাশাপাশি দুটি গ্রাম। একটির নাম রুইলুই আর অপরটির নাম কংলাক। সাজেকের পর্যটন স্পটটি রুইলুই গ্রামে।
কংলাক গ্রামে গাড়ি নিয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। এজন্য পায়ে হেঁটে পাহাড় বয়ে উঠতে হয়। সাজেকে এটাই সবচেয়ে উঁচুস্থান। কংলাক থেকে এক নজরে সাজেক দেখার সুযোগ মেলে।
যাহোক, দুই ধারে ঘন বন, মাঝে পিচঢালা বৃষ্টিভেজা আঁকা-বাঁকা পিচ্ছিল পথে গাড়ির বহরের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আমাদের সিএনজি পাহাড়ি পথ ধরে এগিয়ে চলল। সবুজ পাহাড়ের বুক চিরে বয়ে গেছে পিচঢালা সড়ক। যাওয়ার পথে কখনো গাড়িগুলো আকাশের দিকে, কখনো পাহাড়ের গহীনের দিকে চলতে থাকে। সড়কের পাশে দাঁড়িয়ে পাহাড়ি শিশুরা হাত নেড়ে অতিথিদের অভিবাদন জানায়। পুরো পথেই আমরা দেখেছি অসংখ্য ছোট-বড়-মাঝারি পাহাড়ের মাথা-কাঁধ-কোল জুড়ে মেঘের ঝাঁকের উড়াউড়ি। একই সঙ্গে বিরতি দিয়ে দিয়ে পাহাড়ি ঢল। সবচেয়ে আকর্ষণীয় ছিল বিচিত্র মেঘের খেলা। প্রবল বাতাসে মেঘ উড়ে দূরে চলে যায়, আবার পরক্ষণেই ঢেকে ফেলে পুরো এলাকা।
প্রায় তিনঘণ্টা সবিরাম চলার পর আমরা পৌঁছলাম সেই কাঙ্ক্ষিত সাজেকে। তখন সন্ধ্যা প্রায় ঘনিয়ে এসেছে। যেন আমরা পৌঁছে গেলাম অন্য এক উপত্যকায়। ঘন মেঘের চাদরে ঢাকা এক নরম মেঘ-পিণ্ড। এই মেঘ ছাপিয়ে একটু পর পরই নামছে বৃষ্টি। অনেক বাঁধা-বিঘ্ন অতিক্রম করে, পাহাড়ি ঢলে পথে জমে যাওয়া জল মারিয়ে। স্থানে স্থানে ভূমিধসের কারণে গাছপালা ও মাটি মূল সড়কে পড়ে চলাচলের অনুপযোগী করে তুলেছে। সেগুলো তাৎক্ষণিকভাবে সরিয়ে কোনো মতে আমরা বেশ কিছুটা উদ্বেগ নিয়ে এগিয়ে চলি সাজেক অভিমুখে।
যদিও তখন সন্ধ্যা, কিন্তু মেঘ ও বৃষ্টির কারণে অসময়েই রাতের অন্ধকার নেমে এসেছে। আমরা পৌঁছে যাই আমাদের কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে। পাহাড়ের উপত্যকায় সাজানো-গোছানো এক অসাধারণ স্থানের নাম সাজেক। সেখানে গিয়ে পর্যটকদের জন্য নির্মিত রঙ্গিন সব কটেজ দেখেই চোখ ও মন জুড়িয়ে যায়। বিভিন্ন দামের ও মানের কটেজের অভাব নেই সাজেকে। একরাতের জন্য জনপ্রতি তিন শ’ টাকা থেকে শুরু করে দশ হাজার টাকা পর্যন্ত গুণতে হয়।
সাজেক ও রুনময় নামে অত্যাধুনিক দুটি রিসোর্ট নির্মাণ করেছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। এই দুটিতেই রয়েছে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা। এ দুটি কটেজে থাকতে হলে সেনাবাহিনীর যোগসূত্র ধরে আগেই বুকিং দিতে হয়। তবে এই যোগাযোগ না থাকলেও ক্ষতি নেই। সাজেকে এখন বেসরকারি উদ্যোগে অসংখ্য ছোট-বড় রিসোর্ট নির্মিত হয়েছে পাহাড়ের ঢালে। এগুলো দেখতে যেমন আকর্ষণীয়, মানও ভালো। এগুলোতে থাকা-খাওয়া দুই সুবিধাই রয়েছে। এছাড়া এসব রিসোর্টের বারান্দায় বসেই আছে মেঘ-পাহাড়ের মিতালী দেখার সুযোগ।
আমরা ‘তাপং টং’ নামে রিসোর্টে গিয়ে উঠি। যথারীতি ‘আমরা লায়নের গেস্ট’ বলা মাত্রই একযুবক আমাদের ব্যাগ নিয়ে একটা ছোট্ট পাহাড়ের পাদদেশে দোতলায়, কাঠ আর টিন দিয়ে তৈরি সুন্দর একটা খেলনা-বাড়ির মতো কটেজে নিয়ে যায়। আমরা সেখানে ব্যাগ রেখে চা-পান করে বেড়িয়ে পড়ি।
যেদিকে তাকাই কেবল মুগ্ধ হবার পালা। এ যেন মেঘের সঙ্গে লুকোচুরি খেলা খেলতে খেলতে পাহাড়ের ঘুমিয়ে পড়ার কাব্য! প্রকৃতি যেন তার অকৃত্রিম রূপ-রস দিয়ে সাজিয়েছে রাঙামাটির সাজেক ভ্যালিকে।
আমরা মেঘকে সঙ্গী করে সোজা সড়ক ধরে এগিয়ে চলি। চারদিকে তাকিয়ে মনে হয়, নজরুলের সেই বিখ্যাত গান: ‘আকাশে হেলান দিয়ে পাহাড় ঘুমায় ঐ!’ এখানে সত্যি সত্যি আকাশ পাহাড়ের সঙ্গে মিতালী করে। হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যায় মেঘের পালক। মেঘের দল এখানে খেলা করে আপন মনে। সে এক রোমাঞ্চকর অনুভূতি। মনে হয় যেন আমরা উড়ে বেড়াচ্ছি আকাশের বুকে মেঘের সঙ্গে। আকাশ বাতাস সবুজ আর মেঘের দল লুটোপুটি খায় পদতলে।
আমরা জিরো পয়েন্ট, হ্যালিপ্যাড হয়ে মেঘের দাপটের কাছে হার মেনে ফিরে আসি। তারপর রাতের খাবার। দেশি মুরগির মাংস, সবজি, ডাল। অসাধারণ রান্না ‘তাপং টং’ রিসোর্টের।
এরপর আমাদের রুমের বারান্দায় গিয়ে বসি। কিন্তু বৃষ্টির ঝাপটা আমাদের ঘরে ঠেলে দেয়। পাহাড়ি ঢলের প্রভাব এবং কিছুটা ঝড়ো বাতাস শীতের আমেজ নিয়ে আসে। গায়ে কম্বল জড়িয়ে শুয়ে পড়ি। শুয়ে শুয়ে শুনি টিনের চালে বৃষ্টির একটানা শব্দ। বৃষ্টির ফোঁটাগুলো এতই বড় যে, মনে হচ্ছিল কেউ যেন উপর থেকে টিনের চালে একটানা ঢিল ছুঁড়ছে! এক সময় এই ‘ঢিল ছোঁড়া’র আওয়াজটাও এক অপূর্ব রাগে পরিণত হয়। এই রাগ শুনতে শুনতে ক্লান্ত-শ্রান্ত হয়ে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি জানি না!
সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি মেঘের চাদরে ঢাকা রয়েছে এই সাজেক। আমরা তৈরি হয়ে বেরিয়ে পড়ি। হেলিপ্যাডে দাঁড়িয়ে খানিকক্ষণ মেঘের সঙ্গে মিতালী করে ভুনা খিচুড়ি ও ডিমের ঝোল দিয়ে নাস্তা সেরে যাত্রা শুরু করি কংলাক গ্রামের দিকে। সাজেকের সর্বশেষ সীমানা কংলাক। কংলাক রুইলুই থেকে প্রায় দেড়ঘন্টার পায়ে হাঁটার পথ। কংলাকে পাংখোয়াদের আদিনিবাস। পাংখোয়ারা সবসময় সবার উপরে থাকতে বিশ্বাসী, তাই তারা সর্বোচ্চ চূড়ায় বসবাস করে। কংলাকের পরেই ভারতের মিজোরাম।
মেঘ বিছানো রাস্তা দিয়ে চলার সময় নিজেকে মেঘের রাজ্যের অতিথি মনে হচ্ছিল। পর্যটকদের অনেকেই কংলাক গ্রাম দেখতে বেরিয়েছেন। মাটির রাস্তা। বৃষ্টিতে কর্দমাক্ত। অনেকেই গাইড ও বাঁশের একটা লাঠি হাতে নিয়ে চলেছেন। আমরা অবশ্য লাঠি এবং গাইড ছাড়াই কংলাক ভ্রমণে চলি।
অসংখ্য পাহাড়ের বন্ধনে সবুজে ঢাকা অপরূপ এই কংলাকের রাস্তা! বৃষ্টিতে সবুজে ঢাকা এই পথ আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। কালো মেঘ বারবার হাতছানি দেয় বৃষ্টিকে। ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামে। এই বৃষ্টিমুখর দিনে পিচ্ছিল পথে আমরা অন্বেষণ করে চলি সাজেকের অপূর্ব সৌন্দর্যরূপ।
বেশ খানিকটা খাড়া পথ বেয়ে আমরা পৌঁছে যাই কংলাক গ্রামে। সবুজ পাহাড়ের চূড়া ঘিরে রয়েছে সাদা মেঘের আবরণ। দিগন্ত বিস্তৃত উপত্যকা মিশে গেছে মিজোরামের নীল পাহাড়ে (ব্লু ম্যাউনন্টেইন)। সাদা তুলোর মতো ছোট ছোট মেঘের স্তুপ ভেসে বেড়াচ্ছে পাহাড়ের বুকে। উপত্যকার সামনে দাঁড়িয়ে মনে হয় সত্যি এ এক অপার্থিব সৌন্দর্য! সাজেকের সবচেয়ে উঁচু গ্রাম এই কংলাকে দাঁড়িয়ে আমরা পাখির চোখে দেখে নিই পুরোটা মেঘের রাজ্য।
বৃষ্টির বাড়াবাড়ির কারণে আমরা খুব একটা সুবিধা করতে না পেরে ফেরার পথ ধরি। উঁচুতে উঠতে যতটা কষ্ট হয়েছিল, নামতে ততোটা হয়নি। পতন সততই বুঝি সহজ!
কংলাক থেকে ফিরে আমরা রক প্রশান্তি ক্যান্টিনে খেয়ে সাজেক ত্যাগ করার জন্য তৈরি হই। এর মধ্যেই খবর রটে যায়, রাস্তার বিভিন্ন স্থানে অতিরিক্তি পানি জমে যাবার কারণে আজ কোন গাড়ি যাবে না। সকালেও কোন গাড়ি আসতে পারেনি।
এই খবর আমাদের কিছুটা হতাশ ও শংকিত করে। কারণ যেভাবে বৃষ্টি হচ্ছিল তাতে যদি পানি আরও বেড়ে যায়, আমাদের যদি আরও কয়েকদিন থাকতে হয়, সে ক্ষেত্রে কী হবে! অনেকেরই আবার ছুটিছাটা নিয়ে সমস্যা আছে। দেখলাম পর্যযটকদের মধ্যে এক ধরনের হতাশা!
যাহোক, আমরা কিছুক্ষণ রেস্ট নিয়ে বিকেলে আবার বেরিয়ে পড়ি। এবার গিয়ে বসি হেলিপ্যাডের পাশে ‘ঝাড়ভোজ পিকনিক’ স্পটে। সেখানে প্রতিজন বিশ টাকা করে টিকেট কাটতে হয়। তবে জায়গাটা চমৎকার। এখানে পাহাড়ের ধারে সুন্দর বসার ব্যবস্থা আছে। তিনটি টিনের ছাওনি দেওয়া গোল শেডগুলো দেখতে সুন্দর। সাজেক উপতক্যার পূর্ব দিকটা এ শেডগুলো থেকেই সবচেয়ে ভালো দেখা যায়। আমরা বসে বসে পড়ন্ত বিকেলে পাহাড়ের সৌন্দর্য উপভোগ করতে থাকি। এর মধ্যেই আমাদের পাশে এসে যোগ দেয় একটি দল। তারা সবাই ডাক্তার। রাঙামাটি ও চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের তারা। তাদের সঙ্গে কথা হয়। এই গ্রুপের একজন নারী দেখলাম একটি চেয়ারে বসে পাহাড়ের দিক তাকিয়ে অনুচ্চ স্বরে আনমনে একের পর এক গান গেয়ে চলছেন। সন্ধ্যা, লতা, আরোতি, রবীন্দ্রসঙ্গীত, নজরুল গীতি-সব মিলিয়ে তিনি সাত-আটটি গান গাইলেন। আমরা হালকা-পাতলা কথা বললেও সবার মনোযোগ ছিল তার গানে। এই চিকিৎসক ভদ্রমহিলার কণ্ঠ সত্যিই অপূর্ব। খুব ভালো গান গাইতে পারেন। স্বেচ্ছায় এই পাহাড়ের নির্জনতায় একজন ভদ্রমহিলা গান গেয়ে গোধূলিকে রাঙিয়ে দিয়ে গেলেন যেন। এটা যেন সত্যিই স্রষ্টার এক বিশেষ উপহার। এমন ‘লাইভ’ গান শুনে মনটা সত্যিই ভরে যায়। এদিকে বৃষ্টির মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় আমরা সেখান থেকে পথের ধারে একটি রেস্টুরেন্ট গিয়ে চা পান করি। সেই চায়ের কী স্বাদ! আসলে স্থান-কাল-পাত্র-পরিস্থিতি ইত্যাদির কল্যাণে অনেক সময় খাবারেও বেহেস্তি স্বাদ এসে বাসা বাঁধে!
রাতে আমরা ‘রক প্রশান্তি ক্যান্টিনে’ চিকেন বার-বিকিউ ও নান খাই। এখানে আগেই অর্ডার দিতে হয়। আমরা সন্ধ্যায় অর্ডার দিয়ে রেখেছিলাম। রাত নয়টায় আমরা খেতে বসি। অসাধারণ টেস্ট। খাওয়া শেষ করে বৃষ্টিতে ভিজে কটেজে ফিরে আসি। সেখানে বারান্দায় বসে আবার বৃষ্টি দেখা। আবছা অন্ধকারে পাহাড়ের রূপ দেখা। এক সময় ঘুমুতে যেতে হয়।
পরদিন সকালে ঘুম থেকে জেগে দেখি বৃষ্টি নেই। আকাশ পরিষ্কার। এতে মনটা আনন্দে নেচে উঠে। আজ তাহলে আমরা ফিরতে পারছি। আসলে সাজেক যত সুন্দরই হোক, দুই রাতের বেশি থাকাটা খুব একটা আনন্দের নয়। তা ছাড়া আমাদের রাতের গাড়িতে ঢাকায় ফেরার টিকেট কাটা আছে। আজ যেতে না পারলে টিকেটের টাকাটাও মাটি হবে!
যাহোক এমন সাত-পাঁচ ভাবনা ভাবতে ভাবতেই আবার সেই মুষলধারে বৃষ্টিধারা শুরু হলো। বৃষ্টিতে ভিজেই আমরা নাস্তা সারলাম। সব কিছু গুছিয়ে দশটা বাজার অপেক্ষায় আছি। সাড়ে নয়টায় জানা গেল, হ্যাঁ আজকে গাড়ির বহর রওনা হবে। সবাই একযোগে চিৎকার করে আনন্দ উল্লাস করল। আসলে সবারই ঘরে ফেরার তাগাদা আছে। একদিন আটকে পড়াতে অনেকেরই অনেক রুটিন কাজে হেরফের হয়েছে। শেষ পর্যন্ত যাওয়া যাবে শুনে সবার মনে আনন্দ জাগা স্বাভাবিক। আমরা হোটেলের লেনদেন শেষ করলাম। দেড় হাজার করে দুই দিনের জন্য দুই রুম ছয় হাজার টাকা। এর মধ্যে ‘লায়নের গেস্ট’ হিসেবে প্রতিরুম এক হাজার টাকা কনসেসন। মোট বিল পাঁচ হাজার টাকা।
শেষপর্যন্ত সেনাবাহিনীর অনুমোদন নিয়ে বৃষ্টির মধ্যেই আমরা খাগড়াছড়ির উদ্দেশ্যে সাজেক ছাড়লাম। পথের বিভিন্ন স্থানে পানি জমে থাকার চিহ্ন দেখতে পেলোম। অনেক জায়গায় ভূমিধসেরও নজির রয়েছে। রাস্তার ওপর থেকে গাছপালা ও মাটি সরানো হয়েছে-এমন নমুনাও আমাদের চোখে পড়ল। আমাদের সিএনজি নির্বিঘ্নে এগিয়ে চলছিল। কিন্তু বাঘাইহাটের পাশে এসে পুরো গাড়ি বহর থেমে গেল। জানা গেল সামনের রাস্তায় প্রায় কোমর পানি। ওই পানি মাড়িয়ে কোনো গাড়ি আর যেতে পারবে না। কাজেই এখানেই নেমে পড়তে হবে। পায়ে হেঁটে কিংবা নৌকায় পানি পার হয়ে আবার গাড়িতে করে খাগড়াছড়ি পৌঁছতে হবে। এখানে আমাদের অটোচালক কুদ্দুসকে বিদায় জানাতে হয়। একরাত বাড়তি থাকার কারণে কুদ্দুসকে আরও একহাজার টাকা বাড়িয়ে মোট পাঁচ হাজার টাকা দিই। আমাদের এভাবে বেজায়গায় নামিয়ে বিদায় জানাতে গিয়ে কুদ্দুসকেও কিছুটা বিষন্ন মনে হলো।
আমরা লাইন দিয়ে নৌকায় চড়ে পানি পার হলাম। পাহাড়ে বেড়াতে গিয়ে মূল সড়কে নৌকায় উঠার বিরল অভিজ্ঞতা নিয়ে আমরা আবার একটা সিএনজি ভাড়া করে দীঘিনালা যাই। সেখান থেকে আরেকটি সিএনজি নিয়ে খাগড়াছড়ির গাইরিং হোটেল।
হোটেলে একটু হাতমুখ ধুয়ে আমরা বেরিয়ে পড়ি। হাঁসের মাংস দিয়ে দুপুরের খাবার খেয়ে সাতশ টাকা চুক্তিতে সন্ধ্যা পর্যন্ত আরেকটি সিএনজি ভাড়া করি। প্রথমে যাই আলুটিলা। তারপর জেলা পরিষদ নির্মিত ঝুলন্ত ব্রিজ। সবশেষে আদিবাসীদের বাজার। সেখানে কলা, কলার মোচা, কচি বাঁশ ইত্যাদি কিনে সোজা হোটেল। হোটেলে পাওনা পরিশোধ করতে গেলে ম্যানেজার ছেলেটি বিনয়ের সঙ্গে জানায়, আপনাদের কোন টাকা দিতে হবে না। আপনারা তো আর রাত ছিলেন না, একটু রেস্ট নিয়েছেন। এরপর বেড়াতে এলে আমাদের এখানে থাকবেন। তাতেই হবে। আমি কিছু টাকা রাখতে পীড়াপীড়ি করি, কিন্তু ও নাছোড়! ওর ভদ্রতায় আমরা মুগ্ধ হই! সঙ্গে জাগে সহকর্মী নবলেশ্বর তথা লায়নের প্রতি কৃতজ্ঞতা।
হোটেল থেকে বাসস্ট্যান্ড, সেখান থেকে এস আলম পরিবহনে সোজা ঢাকা!
ঢাকায় ফিরেছি, কিন্তু মনে জেগে আছে সেই মেঘদল, মেঘ আর বৃষ্টির কোলাহল। বিকেল থেকে সন্ধ্যা, সন্ধ্যা থেকে রাত, রাত থেকে ভোর-এক অদ্ভূত ঘোরের মধ্যে অবিশ্বাস্য দ্রুততায় কেটে গেছে দুইটি দিন। আর যাবেই-বা না কেন? ওখানে গিয়েই যে আমরা ‘মেঘ-ধরা’র খপ্পরে পড়ে যাই। মেঘেরা আমাদের জাদু করে ফেলে। এ যেন সত্যিই কোন স্বপ্নলোকের মেঘের হাতছানি। সত্যি ‘মেঘের দেশের’ এ রূপের বর্ণনার সাধ্য আমার নেই। এ শুধু দেখবার, উপভোগ করবার, অনুভব করবার। বর্ণনা করলেই সেটা হয়ে যায় বিরাট ফাঁকি! আমরা সেখানে গিয়ে যে সৌন্দর্য দেখেছি ‘ভয়ঙ্কর সৌন্দর্য’ বুঝি একেই বলে। সেখানে না গেলে এ সৌন্দর্য ভাষাহীন হয়ে পড়ে। যেন মেঘের দেশকে শুধু মন দিয়েই অবলোকন করা যায়। দিনের আলো আর রাতের অন্ধকারের তেমন কোনো পার্থক্য পাইনি এ মেঘরাজ্যে। আমার কাছে মনে হয়েছে যেন এক অপার্থিব সৌন্দর্যের আঁধার। চারপাশে শুধু মেঘ আর মেঘ খেলা করে চলেছে। ছোট মেঘ বড় মেঘ, কালো সাদা মেঘ, ঘন মেঘ হালকা মেঘ।
এ এক অন্য জগৎ। পেপার-পত্রিকা নেই, ফেসবুক-ইন্টারনেট নেই, টিভি নেই, এমনকি মোবাইল নেটওয়ার্কও নেই। রবি ছাড়া অন্য নেটওয়ার্ক কাজ করে না। আমাদের সঙ্গে টেলিটক ছিল, কিন্তু খুব একটা কাজ করেনি। রাতে শুধু সেনাবাহিনীর যে কটেজ, সেখানে একটা আলো ছাড়া পুরো পাহাড় অন্ধকারে ছেয়ে থাকে।
ওখানে রাত কাটাবার যেসব কটেজ বা হোটেল নির্মাণ করা হয়েছে, সেগুলোতে সোলার লাইট জ্বলে। আর সন্ধ্যার পর থেকে রাত দশটা পর্যন্ত বড় হোটেল বা কটেজগুলোতে জেনারেটরের সাহায্যে ফ্যান চালানো, ট্যাংকিতে পানি তোলার কাজগুলো করা হয়। তারপর সব অন্ধকার।
আমরা আমাদের রুমের বারান্দায় দাঁড়িয়ে বৃষ্টির ধারা দেখেছি ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে। এ যেন এক নেশা, একটা ঘোর। একটানা বৃষ্টি পড়েই যাচ্ছে। সঙ্গে বাতাসের একটা শোঁ শোঁ আওয়াজ। মায়া জাগানো। আমরা মেঘেদের কান্না দেখেছি বৃষ্টি নামের চপল মেয়ের মতোন। সবুজ বনরাজিকে আরও সবুজ প্রেমাসিক্ত হৃদয়ে বরণ করতেই যেন এই বৃষ্টির আগমনী। সারাক্ষণ ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘ কপোত-কপোতির মত ঠোঁটে ঠোঁট ছুঁয়ে ভেসে চলছিল দূরে বহু দূরে।
রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘কেবলই আঁখি দিয়ে আঁখির সুধা পিয়ে/হৃদয় দিয়ে হৃদি অনুভব/আঁধারে মিশে গেছে আর সব…।’ সাজেকে আঁধারের বুক চিরে অনন্ত তৃষ্ণাকে ধন্য করে অনুভবে-অনুভূতিতে আমরা পরমাশ্চর্য দুটো রাত কাটিয়ে এসেছি। এর রেশ যেন সহজে কাটবার নয়!
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)