বরগুনার রিফাত শরীফ হত্যায় জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেপ্তার হওয়া রিফাতের স্ত্রী আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নির পক্ষে আদালতে কোনো আইনজীবী দাঁড়াননি বলে অভিযোগ করেছেন মিন্নির বাবা মোজ্জাম্মেল হোসেন।
মিন্নির বাবা সাংবাদিকদের জানান: বুধবার সকাল থেকে অনেক চেষ্টা করেও মিন্নির পক্ষে দাঁড়ানোর জন্য কোনো আইনজীবীকে রাজি করাতে পারেননি তিনি। তবে আদালতে আসামী মিন্নিকে নিজের বক্তব্য উপস্থাপনের সুযোগ দেয়া হয়।
বাংলাদেশের সংবিধান অনুসারে অপরাধ প্রমাণিত না হওয়া পযন্ত একজন ব্যক্তি নির্দোষ এবং যে কেউ আইনের আশ্রয় পাওযার অধিকার রাখে। এমনকি আসামীর পক্ষে আইনজীবী নিয়োগ দেয়া না থাকলে তার পক্ষে আইনজীবী নিয়োগ দেয়া সরকারের দায়িত্ব বলেও আইনজ্ঞরা বলছেন।
মিন্নির আইনজীবী না পাওয়াকে নজিরবিহীন ঘটনা বলে মন্তব্য করেছেন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সিনিয়র ডেপুটি ডিরেক্টর নীনা গোস্বামী।
চ্যানেল আই অনলাইনকে তিনি বলেন: আমাদের কাছে যেটা মনে হয়, এটি একটা নজিরবিহীন ঘটনা। মামলা তদন্ত চলাকালীন অবস্থায় নিজেকে ডিফেন্ড করার জন্য প্রত্যেকটি মানুষের আইনজীবী পাওয়ার অধিকার আছে। সে জায়গায় থেকে এটি নজিরবিহীন ঘটনা।
“এই ঘটনা খুবই খারাপ লাগার যে, একজন নারীর পাশে কোনো আইনজীবী দাঁড়াননি”।
এখানে রাজনৈতিক চাপ ছাড়াও যেকোনো রকমের প্রভাবশালীদের চাপ থাকতে পারে বলে মনে করেন তিনি।
মিন্নির পরিবার আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সহযোগিতা চাইলে নিজেদের সামর্থ অনুযায়ী সহযোগিতা করবেন বলেও জানান নীনা গোস্বামী।
এই বিষয়ে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান (ভারপ্রাপ্ত) মো: নজরুল ইসলাম চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন: আমরা মনে করি যে, এটি সঠিক হয়নি।
মিন্নির আইনজীবী না পাওয়ার প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে আইনের আশ্রয় পাওয়ার অধিকার সবার সমান বলে মন্তব্য করেন তিনি।
চ্যানেল আই অনলাইনকে নজরুল ইসলাম বলেন: আমাদের সংবিধানের তৃতীয় ভাগের মৌলিক অধিকার ২৭ নং অনুচ্ছেদে বলা আছে যে, সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টি সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী। আমাদের মানবাধিকারের সনদে একটি অধিকার বিষয়ে বলা হয়েছে, অভিযুক্ত প্রমাণিত হওয়ার আগ পর্যন্ত আমরা সবাই নিরাপরাধ। এখন তার পক্ষে কেউ কেন দাঁড়াবেন না? এখনও তো প্রমাণিত হয়নি যে সে দোষী নাকি নির্দোষ। এই অবস্থায় তার সমান আশ্রয় লাভের অধিকার আছে বলে আমি মনে করি। আইনজীবীরা কোন গ্রাউন্ড থেকে এটা করলেন আমি বোধগম্য নই।
এক্ষেত্রে মানবাধিকার কমিশনের সহযোগিতার সুযোগ আছে কিনা প্রশ্নে বলেন, এখানে অন্য একটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ। মানবাধিকার একটি বড় বিষয়। সবাই সে অধিকার পাওয়ার অধিকার রাখে। তবে আইনেরই একটি বিষয় আছে যে, কোনো মামলা-মোকাদ্দমা সুনির্দিষ্টভাবে থাকলে সেখানে মানবাধিকার কমিশন আর প্রসিড করে না, যদি সেখানে বড় ধরনের কোন ব্যত্যয় না হয় আর কি!
যদি আসামীর পক্ষে কোনো আইনজীবী না দাঁড়ায় রাষ্ট্র তাকে আইনী সহায়তা দেবে। সেক্ষেত্রে মানবাধিকার কমিশন কিছু করতে পারে কিনা জানতে চাইলে নজরুল ইসলাম বলেন: তেমন একটি বিধান আছে। তারা যদি আমাদের কাছে কোনো আবেদন করে, তাহলে আমাদের যে কর্তৃপক্ষ বেঞ্চ, সেখানে পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। আমরা মনে করি যে, এটা ঠিক হয়নি। একজন আসামী উকিল পাবে না, এটি ঠিক নয়। অভিযুক্ত প্রমাণিত হওয়ার আগ পর্যন্ত আমরা কেউ অপরাধী নই।
মিন্নির আইনজীবী বিষয়ে বলতে গিয়ে স্বচ্ছ, দুর্নীতিমুক্ত, উচ্চমহলের প্রভাবমুক্ত, রাজনৈতিক চাপমুক্ত, প্রশাসনিক চাপমুক্ত বিচারিক প্রক্রিয়া প্রত্যাশা ও দাবি করছেন বাংলাদেশ মহিলা সমিতির সভাপতি আয়েশা খানম।
চ্যানেল আই অনলাইনকে আয়েশা খানম বলেন, আমি খুব সম্মান রেখে বিচার প্রক্রিয়ার প্রতি, বিচারকদের প্রতি, আইনজ্ঞদের প্রতি দুঃখ-বেদনার সাথে বলতে চাই, ‘স্বচ্ছ, দুর্নীতিমুক্ত, উচ্চমহলের প্রভাবমুক্ত, রাজনীতিক চাপমুক্ত, উচ্চ প্রশাসনিক চাপমুক্ত বিচারিক প্রক্রিয়া যেন এখানে হয়। আধিপত্যমুক্ত, কোনো ধরনের ভয় ভীতিমুক্ত বিচার হচ্ছে এটা আমি বিশ্বাস করতে চাই এবং দাবি করছি।
তিনি বলেন: রিফাত হত্যার ঘটনার শুরু থেকে আমরা সার্বিক বিষয় পর্যবেক্ষণ করেছি। এখানে নারী, সহিংস আচরণ, মাদক, তরুণদের মাদকের সঙ্গে জড়িত হওয়া, বিভিন্ন জনের গ্রেপ্তার হওয়া, র্যাবের হাতে মূল আসামী খুন হয়ে যাওয়া ইত্যাদি বিষয়গুলো নিয়ে আমরা ইতোমধ্যে বিস্তারিত সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছি। আমরা অপরাধীর বিচার চাই বিচারিক প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে।
“বিভিন্ন ক্ষেত্রে রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা, ০০৭ বন্ড বাহিনী গড়ে ওঠা, বড় ধরনের খুন, মাদক ব্যবসায় তরুণদের সম্পৃক্ততা; এসব বিষয় নিয়ে আমাদের মনে নানা প্রশ্ন আছে’- বলেন আয়েশা খানম।
তিনি বলেন: দ্রুত গতিতে আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নিকে বিশেষ রিমান্ডে নেয়া হলো, তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। গতকালকে দায়িত্বপ্রাপ্ত এসপির বরাত দিয়ে সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়েছে, মিন্নি জড়িত থাকার সত্যতা পাওয়া গিয়েছে। মিন্নি একটি প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন। পরবর্তী প্রশ্নের উত্তর দেননি।
“আসলে আমার মনে হয় যে, আমাদের বিচারিক প্রক্রিয়ায় দীর্ঘ সময়ে একটা আস্থাহীনতা তৈরি হয়েছে।”
দেশের আইনজ্ঞ যারা আইনের ব্যাখ্যা করেন তাদের মধ্যে জেন্ডার সংবেদনশীলতা কতটুকু আছে তা জানা দরকার বলেও মন্তব্য করেছেন আয়েশা খানম।
তিনি বলেন: বহু গুরুতর অপরাধ, শত খুনের আসামীর পাশেও তারা দাঁড়ান। নারী নির্যাতন না শুধু হত্যাকারীদের পাশেও দাঁড়ান। বহু হত্যাকাণ্ডে তারা আসামীর পাশে দাঁড়িয়ে বলেছেন যে, মানবাধিকার নীতিমালা অনুযায়ী আসামীরও লিগ্যাল প্রটেকশন পাওয়ার অধিকার আছে।
সুতরাং ইচ্ছা বা অনিচ্ছায়, চাপ বা অন্য কারণে যা কিছু হোক আমরা আশা করবো, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, আইনানুগ, স্বচ্ছ তদন্ত হবে এবং আসামীরও ব্যক্তিগত নিরাপত্তার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে।