কিছু মৃত্যু পাহাড়ের মতো ভারী–এই প্রবাদটি যাদের জন্য, আনিসুল হক নিঃসন্দেহে সেই মানুষগুলোর অন্যতম; যারা স্বপ্ন বোনেন, স্বপ্ন দেখান। ঢাকা উত্তর সিটির মেয়র আনিসুল হক সেরকমই একজন স্বপ্নবান মানুষ যিনি এই মহানগরীর মানুষ স্বপ্ন দেখাতে শুরু করেছিলেন। কিছু স্বপ্নের বাস্তবায়নও করেছিলেন। কিন্তু আরও অনেক কাজ বাকি।
গত বছর একটি টেলিভিশন চ্যানেলের অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, দুই বছরের মধ্যে ঢাকার চেহারা বদলে যাবে। কিন্তু তা আর হলো না। এই স্বপ্নের বাস্তবায়নের আগেই তিনি চলে গেছেন স্বপ্নেরও বহু দূরে। আর তাঁকে আমরা খুঁজে পাব না। তিনি মিশে যাবেন দূর নক্ষত্রে…গোধূলীর লাল মেঘে…রাতের নিকষ অন্ধকারে…শিউলির সাদায়…শীতের কুয়াশায়। …বিদায় নায়ক।
রাজনীতিবিদদের সম্পর্কে আমাদের গড়পরতা যে ধারণা বা বিশ্বাস, তার সঙ্গে আনিসুল হকের ব্যবধান ঢের। রাজনীতির জটিল ও কূটিল পথে তিনি হাঁটেননি। আবার রাজনীতিবিচ্ছিন্নও ছিলেন না। রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায়ই তিনি রাজনীতিবিদদের অতি কাঙ্ক্ষিত ঢাকা সিটির একটি অংশের মেয়র হিসেবে নির্বাচিত হবার পর নানা কাজ এটি প্রমাণ করে দিয়েছিলেন যে, ব্যক্তিগত লোভ-লালসার থেকে দূরে থেকে কিংবা রাজনৈতিক ক্যাডার ও মাস্তান না পুষেও স্রেফ মানুষের জন্য কাজ করা সম্ভব। প্রয়োজন সদিচ্ছা, সাহস আর দৃঢ়চেতা মন। এমন সাহসী আর দৃঢ়চেতা মেয়র এই মহানগরীর মানুষ আনিসুল হকের আগে কি আর দেখেছিল?
তবে তিনি নিজেও স্বীকার করে নিয়েছিলেন যে, সিটি কর্পোরেশনের মাফিয়াদের দৌরাত্ম্য। সদিচ্ছা থাকলেও সব কাজ তিনি করতে পারেন না। কেননা একদিকে লোকবল আর আর্থিক সংকট অন্যদিকে রাজনৈতিক বিবিধি চাপ–সব মিলিয়ে আনিসুল হক যা করতে চেয়েছিলেন এবং যেভাবে করতে চেয়েছিলেন, যে স্বপ্ন তিনি এই মহানগরীর মানুষকে দেখাতে শুরু করেছিলেন, তার অনেক কিছুই অল্প সময়ে করে যেতে পারেননি। বহুবিধ চাপ ও সীমাবদ্ধতা তাঁকে যে আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে রেখেছে, সে ইঙ্গিত তিনি নানা সময়ে দিয়েছেন। তবে কি এমন দূরারোগ্য মস্তিষ্কের ব্যাধি ওই ভীষণ চাপেরই ফল?
বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু বিবেচনায় আনিসুল হকের এই মৃত্যুকে অনেকে হয়তো অকাল মৃত্যু বলে স্বীকার করবেন না। কেননা ৬৫ বছর একেবারে কম সময় নয়। এই সময়ে তিনি দেশের অর্থনীতিকে অনেক দিয়েছেন। দেশের শিল্প-সংস্কৃতিতেও তিনি যা দিয়েছেন, বিশেষ করে যখন বাংলাদেশে টেলিভিশন বলতে মানুষ কেবল বিটিভিকে বুঝত, ওই সময়েও নিজেকে একটি অগ্রসর চিন্তার আধুনিক উপস্থাপক হিসেবে তিনি যেভাবে নিজেকে প্রমাণ করেছিলেন, তা এই সময়ের তরুণদের জন্য নিঃসন্দেহে ঈর্ষার।
তবে রাজধানী ঢাকাকে বদলে দিতে আনিসুল হক যে নতুন লড়াই শুরু করেছিলেন, সেটি অসম্পূর্ণই থেকে গেলো। যারা তার উত্তরসূরি হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন, তারা সেই অসম্পূর্ণ কাজ আদৌ শেষ করতে পারবেন কি না বা করবেন কি না, তা সময়ই বলে দেবে। তবে যে মাফিয়াদের কথা তিনি বলেছিলেন, তারা অনেক্ ক্ষমতাবান। তাদের কাছে মানুষের প্রতি ভালোবাসা বা কমিটমেন্টের বদলে বরং জনগণের পয়সা মেরে নিজের ব্যাংক ব্যালান্স বাড়ানো আর মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোম গড়ে তোলাই ধ্যান-জ্ঞান। সেই জায়গায় আনিসুল হকের সঙ্গে তাদের ফারাক সুস্পষ্ট। সুতরাং যে স্বপ্ন তিনি এই মহানগরীর মানুষকে দেখাতে শুরু করেছিলেন, তার বাস্তবায়ন যে এখন সুদূরপরাহত, তাতে অন্তত ব্যক্তিগতভাবে আমার কোনো সন্দেহ নেই।
মস্তিষ্কের রক্তনালীর প্রদাহ বা সেরিব্রাল ভাসকুলাইটিসে আক্রান্ত হয়ে ১৩ আগস্ট থেকে লন্ডনের একটি হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে ভর্তি ছিলেন আনিসুল হক। এই সময়ের মধ্যে আমরা গণমাধ্যমকর্মীরা তাঁকে বেশ কয়েকবার মেরে ফেলেছি। ব্রেকিং দিয়েছি যে তিনি মারা গেছেন। কিন্তু বারবার এই খবরকে গুজব প্রমাণ করে আনিসুল হকের পালস নড়ে উঠেছে। সবশেষ তার শুভাকাঙ্ক্ষীদের মনে এরকম একটা বিশ্বাস জন্মে গিয়েছিল যে, এত বারবার মৃত্যুর পরে সত্যি সত্যিই হয়তো আনিসুল হক বেঁচে উঠবেন এবং সগর্বে উঠে দাঁড়িয়ে বলবেন, প্রিয় নগরবাসী, আমি ভালো আছি। আসুন আমরা এই শহরটাকে নতুন করে গড়ে তুলি।
কিন্তু আনিসুল হক, তা আর হলো না। আপনি আমাদের ছেড়ে সত্যি সত্যিই চলে গেলেন। আপনাকে নিয়ে যেসব গুজব আর ষড়যন্ত্র তত্ত্বের জাল ছড়ানো হয়েছিল, তা ছিন্ন করে আপনি সত্যি সত্যি বেরিয়ে গেলেন এমন এক দূরলোকে, যেখানে কোনো ধরনের গুজব বা ষড়যন্ত্র তত্ত্ব আপনার টিকিটিও ছুঁতে পারবে না।
গত বছরের মে মাসে ব্র্যান্ড ফোরামের আয়োজনে নর্থসাউথ ইউনিভার্সিটিতে তরুণদের একটি সমাবেশে আনিসুল হক দীর্ঘ বক্তৃতা দিয়েছিলেন। সেখানে তিনি বলেছিলেন, ‘আমার জীবনটা শুরু হয়েছিল একটা অগস্ত্যযাত্রার মতো। এ এক অন্তহীন পথে ছুটে চলা।’ তিনি বলেন, ‘লাইফ ইজ আ ট্রিপ, ওই ট্রিপে কোনো ম্যাপ নেই। এই ম্যাপ নিজেকেই তৈরি করে নিতে হয়। আমাদের কার কতটুকু টাকা আছে, ওটি একটি অংকের হিসাব। কিন্তু তার কতুটুক সময় আছে? জীবনের কোন পথ পর্যন্ত পেরোনোর জন্য বিধাতা লিখে রেখেছন, আমি জানি না। সময়ের হিসাব আমরা জানি না।’ সময়ের হিসাব আসলেই কেউ জানে না। আপনি এখন সময়ের বহু ঊর্ধে। ভালো থাকবেন আনিসুল হক; আমাদের নায়ক।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)