চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ

বঙ্গবন্ধু হত্যার পর প্রতিবাদী ছাত্র আন্দোলন

জাতির পিতা ও রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট প্রত্যুষে ধানমণ্ডি ৩২ নম্বর সড়কের ৬৭৭ নম্বর বাড়িতে নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ডের শিকার হন খুনি মোশতাক-ফারুক-রশিদ-জিয়াউর রহমান চক্রের গভীর ষড়যন্ত্রে। মহীয়সী নারী বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, জাতীয় ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ পুত্র শেখ কামাল, তার স্ত্রী ও বাংলাদেশের সেরা নারী অ্যাথলেট সুলতানা খুকী, বঙ্গবন্ধুর অপর পুত্র সেনাবাহিনীর তরুণ অফিসার শেখ জামাল ও তার স্ত্রী রোজী জামাল, বঙ্গবন্ধু কনিষ্ঠ পুত্র শিশু রাসেল, বঙ্গবন্ধুর কনিষ্ঠ ভ্রাতা শেখ নাসেরসহ অনেককে ওই বাড়িতেই হত্যা করা হয়। মন্ত্রিসভার সদস্য ও বঙ্গবন্ধুর ছোট ভগ্নীপতি আবদুর রব সেরনিয়াবাত এবং বাকশাল কেন্দ্রীয় কমিটির অন্যতম সম্পাদক বঙ্গবন্ধুর আরেক বোনের পুত্র শেখ ফজলুল হক মনির বাড়িও একই সময়ে সামরিক বাহিনীর একদল বিপথগামী সদস্য আক্রমণ করে। এ দুটি বাড়িতেও নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়। খুনিচক্র সোল্লাসে বেতার-টেলিভিশনে বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের সদস্যদের হত্যার খবর প্রচার করে। একই সঙ্গে চলতে থাকে বঙ্গবন্ধুর পরিবার সম্পর্কে মিথ্যা ও কুৎসা রটনা।

ওই অভিশপ্ত দিনেই চ্যান্সেলর হিসেবে বঙ্গবন্ধুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিদর্শনে আসার কর্মসূচি ছিল। মাত্র দুই মাস সাত দিন আগে গঠিত জাতীয় ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বয় রেখে বঙ্গবন্ধুর ক্যাম্পাসে আগমনকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য কাজ করে। তার কর্মসূচিতে ছিল ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র মিলনায়তনে সমাবেশে ভাষণদান। জাতীয় ছাত্রলীগ তখন একক ছাত্র সংগঠন। তিনি নতুন ধারার ছাত্র আন্দোলন গড়ে তোলার বিষয়ে দিকনির্দেশনা দেবেন, এটা আমাদের প্রত্যাশা ছিল।

কিন্তু ছাত্রসমাজ ও দেশবাসীর দুর্ভাগ্য, বঙ্গবন্ধু আসতে পারেননি। এর পরিবর্তে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং আশপাশের এলাকায় তার ঘাতকরা উপস্থিত হয় ট্যাংক ও মেসিনগানসজ্জিত সাঁজোয়া গাড়ি নিয়ে। ক্যাম্পাসের পাশে শাহবাগের বেতার কেন্দ্র এবং সোহরাওয়ার্দি উদ্যানেও মোতায়েন হয় খুনি বাহিনী।

এ হত্যাকাণ্ড গোটা জাতিকে হতভম্ব ও গভীর হতাশায় নিমজ্জিত করে। সংবিধান এবং ন্যায়-নীতি, মূল্যবোধ চরমভাবে লঙ্ঘন করে রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসীন খোন্দকার মোশতাক চক্র এক সপ্তাহ যেতে না যেতেই জিয়াউর রহমানকে সেনাবাহিনী প্রধানের পদে নিযুক্ত করে।

নতুন ধারার ছাত্র আন্দোলন গড়ে উঠুক, বঙ্গবন্ধু চেয়েছিলেন। এ নিয়ে তাঁর সুনির্দিষ্ট ভাবনা ও কর্মকৌশল ছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবেশ থেকে তিনি নিশ্চিতভাবেই এ বিষয়ে কথা বলতেন। কিন্তু ইতিহাস ভিন্ন পথে চলে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ড. জিল্লুর রহমান খান ‘বঙ্গবন্ধুর সম্মোহনী নেতৃত্ব ও স্বাধীনতার সংগ্রাম’ গ্রন্থে লিখেছেন, ১৫ আগস্ট প্রত্যুষে ঘাতকদের উদ্ধত মেসিনগানের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধুর নির্ভীক উচ্চারণ ছিল ‘যদি বাঙালিরা তাদের জাতির পিতাকে হত্যা করতে চায়, তিনি জীবন দিতে প্রস্তুত রয়েছেন। কিন্তু এর পরিণত বাঙালিদের জন্য শুভ হবে না। তাদের জীবন কখনোই আগের মতো হবে না এবং তাকে হত্যার সঙ্গে সঙ্গে গণতন্ত্রকেও তারা হত্যা করবে এবং মানবিকতা বিদায় নেবে।’ [পৃষ্ঠা ২৬১]

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে কী ভবিষ্যদ্বাণীই না করেছিলেন!
জাতীয় ছাত্রলীগ নেতৃত্ব এই দুঃসময়েও সাহস ও দৃঢ়তা প্রদর্শন করতে পারে। তবে কাজটি কঠিন ছিল। বাকশালের গুরুত্বপূর্ণ অনেক নেতা জাতির জনকের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করতে দ্বিধা করেননি। বঙ্গবন্ধুর অনুসারী আরেক দল কারাগারে কিংবা আত্মগোপনে। ছাত্র নেতৃবৃন্দ প্রকাশ্যে চলাফেরা করতে থাকা বাকশাল নেতাদের অনেকের কাছ থেকে আশাব্যঞ্জক কিছু না পেয়ে হতাশ হন। পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে পড়ে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পরপর টানা প্রায় দুই মাস রমজান ও শারদীয় দুর্গা পূজার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধু ঘোষণা করায়। ছাত্র আন্দোলন গড়ে তুলতে হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে সামনের সারিতে থাকতেই হবে।তবে প্রকাশ্য কর্মসূচি গ্রহণ করা না হলেও জাতীয় ছাত্রলীগ নেতারা একের পর এক বৈঠকে মিলিত হয়ে ঢাকা ও দেশের অন্যান্য স্থানে নেটওয়ার্ক সক্রিয় করার কাজ করতে থাকেন।

আমাদের গোপন বৈঠকে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত হয় ১. ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় খোলার পর প্রকাশ্য আন্দোলন শুরু হবে। ২. খুনি খোন্দকার মোশতাক বঙ্গভবনে জাতীয় সংসদ সদস্যদের যে সভা ডেকেছেন তা বর্জন করার জন্য সদস্যদের অনুরোধ করা হবে। তবে খুনি চক্রকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য আন্দোলন গড়ে তোলার প্রস্তুতি চলাকালেই বঙ্গভবনে সংসদ সদস্যদের সভা অনুষ্ঠিত হয়, ২৭০ জন সংসদ সদস্য যোগ দিয়েছেন বলে জানানো হয়। এটা কেবল দুর্ভাগ্যজনক ছিল না, ছাত্রনেতাদের জন্য হতাশারও কারণ হয়ে ওঠে। কেবল প্রখ্যাত আইনজীবী সিরাজুল হক বৈঠকে বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ করে বক্তব্য রাখেন। সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী ও অধ্যাপক আবু সাইদসহ মুষ্টিমেয় কয়েকজন ঘোষণা দিয়ে বৈঠক বর্জন করেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নিষিদ্ধ স্লোগান:
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় টানা ৬৭ দিন বন্ধ থাকার পর ১৯৭৫ সালের ১৮ অক্টোবর খোলা হয়। এর আগের রাতেই কলাভবন, সায়েন্স এনেক্স ও কার্জন হলের দেয়ালে দেয়ালে লেখা হয় ১৫ আগস্ট থেকে ‘নিষিদ্ধ’ তিনটি স্লোগান জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু এবং এক মুজিবের রক্ত থেকে লক্ষ মুজিব জন্ম নেবে। এ কাজে বড় ধরনের ঝুঁকি ছিল। রাতে কারফিউ জারি থাকত এবং সামরিক বাহিনী ও পুলিশ-বিডিআরের গাড়ি টহল দিত ক্যাম্পাসে। গোয়েন্দা তৎপরতা তো ছিলই।

জাতীয় ছাত্রলীগ কর্মীরা ২০ অক্টোবর মধুর ক্যান্টিনে সমবেত হয় সকালের দিকে। মুহূর্তে জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু স্লোগানে প্রকম্পিত হয় শত সংগ্রামের পীঠস্থান। ছাত্র-শিক্ষক-কর্মচারীরা বুঝে যায় ‘এক মুজিবের রক্ত থেকে লক্ষ মুজিব জন্ম নেবে’ স্লোগান কেবল কথার কথা নয়। পর দিন মধুর ক্যান্টিন থেকে ফের মিছিল।

এ মিছিল শেষের সমাবেশ থেকে ঘোষণা দেওয়া হয় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বটতলা থেকে বঙ্গবন্ধুর ধানমণ্ডি ৩২ নম্বর সড়কের বাসভবনে ২৯ অক্টোবর ছাত্র-জনতার মিছিল যাবে। পরে তারিখ পুনঃ নির্ধারিত হয় ৪ নভেম্বর। এ কর্মসূচি ঘোষণা হতে না হতেই খুনিচক্র বলেছে, রাজপথে মিছিল বের করা হলে পাখির মতো গুলি করে হত্যা করা হবে। তাদের পৃষ্ঠপোষকতায় একদল সন্ত্রাসী মাঠে নামে। জাতীয় ছাত্রলীগ নেতাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে যাওয়ার কর্মসূচির কথা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীদের জানানো হয়। এ জন্য ক্লাস চলাকালে কেন্দ্রীয় টিমের সদস্যরা এ কর্মসূচিতে অংশগ্রহণের আহ্বান জানিয়ে বক্তব্য রাখেন। বঙ্গবন্ধু সমর্থক রাজনৈতিক নেতা-কর্মী এবং বুদ্ধিজীবী-শিক্ষাবিদ-সংস্কৃতি সেবীদের কাছেও এ কর্মসূচিতে হাজির থাকার অনুরোধ জানানো হচ্ছিল।

কর্মসূচির দিন ঐতিহাসিক বটতলা ছাত্র-জনতায় পূর্ণ হয়ে যায়। শোক মিছিল বটতলা অতিক্রম করতে না করতেই বাধা পায় মেশিনগান ও অন্যান্য মারণাস্ত্রধারী সেনাবাহিনী সদস্যদের কাছ থেকে। কিন্তু বাধা অতিক্রম করে মিছিল এগিয়ে যায় ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরের সেই বাড়িটির দিকে, যেখান থেকে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতার ডাক দিয়েছিলেন। সেখানে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের জন্য মোনাজাত-দোয়া করা হয়। মিছিল শেষ করে কলাবাগানের মাঠে ছাত্রনেতাদের বৈঠকের সময়ে জেল হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে নিশ্চিত খবর মেলে। সেখানেই ঠিক হয়, জেলা হত্যা ও বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদে ৫ নভেম্বর ঢাকায় অর্ধ দিবস হরতাল পালিত হবে। হরতাল শেষে বায়তুল মোকাররমে গায়েবানা জানাজারও ঘোষণা দেওয়া হয়।

৪ নভেম্বর বিকেলে ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সিনেট সভা, যেখানে ছাত্র প্রতিনিধিদের মধ্যে ইসমত কাদির গামা, মাহবুব জামান ও অজয় দাশগুপ্ত যোগ দেন। সিনেটে ছাত্র প্রতিনিধিরা বৈঠকের শুরুতেই বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের নিন্দা জানিয়ে বক্তব্য রাখেন। ছাত্রনেতারা আনুষ্ঠানিকভাবে শোক প্রস্তাব উত্থাপন করলে সর্বসম্মতভাবে তা অনুমোদিত হয় এবং এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়।

বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের পর এটাই ছিল বাংলাদেশের কোনো প্রতিষ্ঠানের আনুষ্ঠানিক শোক প্রস্তাব। আর সেটা সেটা গৃহীত হয় এমন একটি প্রতিষ্ঠানে, যেখানে তাঁর পরিদর্শন কর্মসূচির দিনেই তাকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়। ৫ নভেম্বর শেষে বায়তুল মোকাররম দক্ষিণ গেটে গায়েবানা জানাজা শেষে অনুষ্ঠিত সমাবেশে কয়েকটি দাবি উত্থাপন করা হয় :

ক) জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমানের মর্যাদা পুনঃপ্রতিষ্ঠা;
খ) বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিতে জাতীয় শোক দিবস ঘোষণা;
গ) রেডিও বাংলাদেশের নাম বাংলাদেশ বেতার পুনর্বহাল;
ঘ) সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি ও উপ-রাষ্ট্রপতির অবর্তমানে স্পিকারের হাতে দেশের শাসন ক্ষমতা অর্পণ;
ঙ) আব্দুস সামাদ আজাদ, জিল্লুর রহমান, আব্দুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমদসহ স্বাধীনতায় বিশ্বাসী সকল রাজবন্দীর মুক্তি;
চ) বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের সদস্যবৃন্দ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, এম কামারুজ্জামান, আব্দুর রব সেরনিয়াবাত, শেখ ফজলুল হক মনি, কর্নেল জামিল প্রমুখকে হত্যার জন্য দায়ীদের বিচার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান।

আমরা বলতে পারি, বঙ্গবন্ধুর আদর্শে গড়া জাতীয় ছাত্রলীগ কঠিন সময়েও সঠিক দাবি নিয়ে জনতার সামনে হাজির হতে পেরেছিল।

কিন্তু দেশী-বিদেশী দক্ষিণপন্থী শক্তি ফের আঘাত হানে। ক্ষমতার কেন্দ্রে চলে আসেন জিয়াউর রহমান। ১৯৭১ সালে যারা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর গণহত্যা ও নারী ধর্ষণের প্রত্যক্ষ সহযোগী ছিল তাদের রাজনৈতিক অঙ্গনে পুনর্বাসনের প্রক্রিয়া শুরু হয়। একইসঙ্গে বলা হতে থাকে, ‘আওয়ামী-বাকশালী ও রুশ-ভারতের দালালদের’ কোনো রাজনৈতিক অধিকার থাকবে না। বঙ্গবন্ধুর পরিবারের সদস্যদের নিয়ে কুৎসা রটনা ও মিথ্যাচারেরও শেষ ছিল না।
এমন বৈরি পরিবেশেই জাতীয় ছাত্রলীগকে ১৫ আগস্টের পরবর্তী দিনগুলোতে কাজ করতে হয়েছে। জগন্নাথ হলের সাধারণ সম্পাদক ও জাতীয় ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য অজয় দাশগুপ্তের নামে বরাদ্দ জিসি দেব (সে সময়ে উত্তর বাড়ি হিসেবে পরিচিত ছিল) ভবনের ৬৮ নম্বর কক্ষটি সারা দেশের ছাত্র নেতা-কর্মীদের যোগাযোগ কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছিল। কিন্তু অজয় দাশগুপ্তকে আটক করা হয় ১৯৭৬ সালের ১৫ জানুয়ারি। এ দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও আশপাশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ঘেরাও দিয়ে শত শত ছাত্রছাত্রীকে আটক করে সোহরাওয়ার্দি উদ্যানের খোলা মাঠে অভুক্ত অবস্থায় সারা দিন ফেলে রাখা হয়। কিন্তু অজয় দাশগুপ্ত গোয়েন্দাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে সেখান থেকে পালিয়ে আসতে পারেন। এ বছরের শেষ দিকে তাকে গ্রেফতারের আরেকটি চেষ্টাও ব্যর্থ হয়।

প্রকাশ্যে মিছিল-সমাবেশ করা যায় না। সংবাদপত্রে খবর প্রকাশ করা যায় না। কিন্তু প্রতিপক্ষ সক্রিয়, হিংস্র। দেশের নানা প্রান্ত থেকে প্রতিদিন গ্রেফতারের খবর আসছে। এমন পরিস্থিতিতে জাতীয় ছাত্রলীগ নেতাদের নিয়মিত কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে নানা কৌশল অবলম্বন করতে হয়। যেমন, বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে ‘বাঙলা ও বাঙালির জয় হোক’ ছোট কাগজে লিখে সেটা স্ট্যাপলার পিন দিয়ে বটপাতায় লাগিয়ে ছাত্রছাত্রীদের হাতে তুলে দেওয়া। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা মেডিকেল কলেজসহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের হাজার হাজার ছাত্রছাত্রীর হাতে এ শুভেচ্ছা কার্ড তুলে দেওয়া হয়। বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজগুলোতে ছাত্রছাত্রীদের সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলনে সামিল করার জন্যে ধরনের নানা কৌশল আমরা অনুসরণ করি।

বঙ্গবন্ধুর প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী পালন
১৯৭৬ সালের ৩০ জুলাই থেকে ১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ঘরোয়া রাজনীতির সুযোগ প্রদান করে সামরিক শাসকরা। কিন্তু একইসঙ্গে জানিয়ে দেওয়া হয়, বাংলাদেশে রাজনীতি করতে হলে বঙ্গবন্ধুর নীতি ও আদর্শ অনুসরণ করা যাবে না। এমনকি তাঁর নাম পর্যন্ত নেওয়া যাবে না। ৫ আগস্ট বিভিন্ন সংবাদপত্রে একটি সামরিক ফরমান জারি হয়। এতে বলা হয়, ‘প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক গতকাল বুধবার রাজনৈতিক দলবিধি (সংশোধনী) ১৯৭৬ জারি করেছেন। এতে বলা হয়েছে : ‘জীবিত বা মৃত কোন ব্যক্তিকে কেন্দ্র করিয়া কোন প্রকার ব্যক্তি পূজার উদ্রেক বা ব্যক্তিত্বের মাহাত্ম্য প্রচার অথবা বিকাশ’ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ থাকবে।

এ ধরনের নির্দেশ জারির একটিই লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশের স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শ, উদ্দেশ্য সামনে রেখে কোন রাজনৈতিক দল কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে পারবে না। রাজনীতি থেকে বঙ্গবন্ধুকে নির্বাসিত রাখার জন্যই জিয়াউর রহমানের এ ঘৃণ্য অপচেষ্টা, সেটা বুঝতে সমস্যা হয় না।

এ অবস্থাতেই আসে ১৯৭৬ সালের ১৫ আগস্ট, বঙ্গবন্ধুর প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী। সামরিক শাসকদের সঙ্গে হাত মেলানো রাজনৈতিক অপশক্তির কাছে এটা ছিল ‘নাজাত দিবস’। ঘরোয়া রাজনীতির চালু হলেও বঙ্গবন্ধুর কথা বলা যাবে না, মুক্তিযুদ্ধের সাহস ও গৌরবগাঁথা বলা যাবে না। শোকের এ দিবসটি উপলক্ষে ঢাকায় জাতীয় ছাত্রলীগের প্রধান দুটি কর্মসূচি নির্ধারিত হয় এভাবে বঙ্গবন্ধুর ধানমণ্ডি ৩২ নম্বর সড়কের বাসভবনে শ্রদ্ধার্ঘ নিবেদন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদে মিলাদ অনুষ্ঠান। বিপুল সংখ্যক ছাত্রছাত্রীকে এ দুটি অনুষ্ঠানে কোনা না কোনোভাবে সংশ্লিষ্ট করতে হবে, এটাই ছিল লক্ষ্য। বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে মিছিল নিয়ে সামরিক কর্তৃপক্ষ যেতে দেবে না, সেখানে কোনো সমাবেশ করা যাবে না সে বিষয়টি জানা ছিল। এ কারণে ছোট ছোট দল পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়।

ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই রোকেয়া হল ও শামসুন্নাহার হলের দুই ছাত্রনেত্রী বঙ্গবন্ধু ভবনের ফটকে শাড়ির আচলে লুকিয়ে রাখা তাজা ফুল রেখে নীরবতা পালন করেন। কিন্তু ক্রমে পুলিশ উপস্থিতি বাড়ানো হয়। ৩২ নম্বর সড়কের কোনো প্রান্ত দিয়েই কাউকে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনের সামনে যেতে দেওয়া হয় না। কন্ট্রোল রুম থেকে দ্রুতই নির্দেশনা যায় মিরপুর সড়ক. ধানমণ্ডি লেক কিংবা আশপাশের এলাকা, যে যেখানে পারে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করবে। কিন্তু তাতেও বাধা আসে। ছাত্র দেখলেই পুলিশ তাড়া করে।

কিন্তু কোনো নির্যাতনই জাতির পিতার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন থেকে ছাত্রসমাজকে বিরত রাখা যায়নি। রাস্তায় নেমে ফুল দিতে বাধা আসায় অনেকে বাসের জানালা দিয়ে ফুল ছুঁড়ে দেয় বঙ্গবন্ধুকে উদ্দেশ্য করে। ধানমণ্ডি লেকের পানিতেও ভেসে বেড়াতে তাকে নানা রংয়ের ফুল।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মসজিদে মিলাদে ছাত্রদের উপস্থিতি ছিল ব্যাপক। মসজিদের ইমাম সাহেবকে অনুরোধ করায় তিনি উপস্থিত থাকতে সম্মত হন। তবে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করে মোনাজাত পরিচালনা যে ঝুঁকিপূর্ণ সেটাও তিনি বলেছিলেন। এ কর্মসূচির নির্বিঘ্নে সম্পন্ন হয়। ভয়ভীতি, রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে ছাত্রসমাজ এগিয়ে যায় এ শিক্ষা তো বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকেই পাওয়া।

জাতির পিতার প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীর দিনে বাংলাদেশের কোনো সংবাদপত্রে তাকে নিয়ে একটি বাক্যও লেখা হয়নি। এর পেছনে ছিল সামরিক কর্তৃপক্ষের সরাসরি নির্দেশ। তারা চেয়েছে মানুষের মন থেকে বঙ্গবন্ধুকে মুছে দিতে। কিন্তু তাকে মুছে ফেলা যায়নি। কখনও যাবে না। মানুষের মনে তাঁর স্থান সুদৃঢ় ও স্থায়ী। তিনি ইতিহাসের মহানায়ক। বাংলাদেশের মানুষকে উন্নত শিরে এগিয়ে যাওয়ার, একটির পর একটি সমৃদ্ধির সোপান অতিক্রম করার প্রেরণা হয়ে আছে তিনি, থাকবেনও।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)