পার্বত্য জেলা বান্দরবানে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে সংঘাতে জড়িয়ে পড়া পাহাড়ি সশস্ত্র সংগঠন কুকি চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট বা কেএনএফ দেশবাসীর কাছে এক আতঙ্কের নামে পরিচিত হলেও, রুমা এবং থানচিতে ৩ টি ব্যাংক প্রকাশ্যে লুট করে ফের আলোচনায় কেএনএফ।
পাহাড় বা সমতল সব মানুষের কাছেই কেএনএফ একটি সন্ত্রাসী সংগঠনটি ভয়ের-আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে, সেই সাথে আতঙ্কের এক নাম সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা নাথান বম। তাই সার্চ ইঞ্জিন গুগলে নাথান বমের ব্যাপারে খোঁজাখুজি করছে দেশের নেটিজেনরা।
কে এই নাথান বম?
পাহাড় কিংবা সমতলে, সর্বত্র সমানতালে বিচরণ ছিলো তার, বান্দরবান জেলার রুমা উপজেলার ২ নম্বর রুমা সদর ইউনিয়নের ইডেনপাড়ার বাসিন্দা।
সম্পূর্ণ নাম নাথান লনচেও বম। ১৯৮০ সালে তার জন্মগ্রহণ করেন। বাবার নাম মৃত জাওতন লনচেওর । মায়ের নাম মা মৃত রৌকিল বম। বাবর পেশা জুমচাষ, ময়ের পেশা গৃহিণী। পাঁচ ভাই ও এক বোনের মধ্যে নাথান সবার ছোট। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি বিবাহিত নাথান বমের স্ত্রীর নাম লেলসম কিম বম। ২০০৯ সালে তাদের বিয়ে হয়। লেলসমকিমের বাড়ি ইডেনপাড়াতেই। দুই সন্তানের জনক নাথান দম্পতি।
বড় ছেলে স্কলার বম ১৫ বছর বয়সী ভারতে মামা বাড়ি থেকে লেখাপড়া করে, মামা মিজোরামের রাজধানী আইজল শহরে থাকে। ছোট ছেলে স্কেন্ডী বম ৫ বছর বয়সী, স্থানীয় একটি স্কুলে প্রাথমিকে বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে।
পরিবারের ব্যায়ভার বহন করেন লোলসম কিম বম। নাথান বমের স্ত্রী সরকারি চাকরিজীবী, বর্তমানে তিনি রুমা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নার্স হিসেবে কর্মরত আছেন। নাথান বমের বাড়ীতে এখন স্ত্রী, ছোট ছেলে এবং স্ত্রীর বড় বোন ও তার পরিবার বসবাস করে।
নাথান বমের শিক্ষা জীবন
নাথান বম বান্দরবান থেকে এসএসসি পাস করার চলে যায় রাজধানী ঢাকায়, সেখানে গিয়ে উচ্চ মাধ্যমিকে ভর্তি হন দেশের স্বনামধন্য ঐতিহ্যবাহী ঢাকা কলেজে। সেখান থেকে এইচএসসি পাস করেন।
১৯৯৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর পাস করেন তিনি। বম জনগোষ্ঠীর মধ্যে সর্বপ্রথম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রী লাভ করেন। দেশের দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্য বিষয়ে অধ্যায়নের সুযোগ পেলেও তিনি চিত্রকলা বিষয়ে পড়াশোনার ইচ্ছা থাকায় তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি হন। সেই সময় পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (পিসিজেএসএস) সন্তু লারমার ছাত্র সংগঠন পাহাড়ি ছাত্র পরিষদে (পিসিপি) যোগ দেওয়ার কারণে নাথান বমের পড়াশোনার দায়িত্ব নেন সন্তু লারমা।
নাথান বমের সাংগঠনিক জীবন
নাথান বম ছাত্রজীবনে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদে যুক্ত ছিলেন। পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) ছাত্রসংগঠন পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের (পিসিপি) ঢাকা মহানগর শাখা ও কেন্দ্রীয় কমিটির একজন সক্রিয় সদস্যও ছিলেন তিনি। পরবর্তীতে যুক্ত হন জনসংহতি সমিতিতে।
২০০৮ সালে রুমার ইডেন পাড়ায় কুকি-চিন ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (কেএনডিও) নামের একটি এনজিও প্রতিষ্ঠা করেন নাথান বম। কেএনডিও পার্বত্যাঞ্চলের সুবিশাল বনাঞ্চলকে সবুজায়ন, পশু-পাখি ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য সংরক্ষণ সহ তাঁর জনহিতকর কর্মকান্ড পরিচালনা করেছিলো। রুমার ইডেন পাড়ায় এনজিওটির অফিস। সেখানে একটি লাইব্রেরিও আছে। লাইব্রেরিটি সেনাবাহিনী দ্বারা উদ্বোধন করা হয়েছিলো। এখন সেটি পরিত্যক্ত অবস্থায় আছে।
তারপর গঠন করেন সংগঠন, শুরুতেই সংগঠনের নাম ছিলো কুকি-চীন ন্যাশনাল ভলান্টিয়ার্স। প্রথমদিকে তারা শান্তিপূর্ণ কর্মসূচী পরিচালনা করে এবং ভারতের মনিপুর ও বার্মার চীন রাজ্যের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সাথে সম্পর্ক গড়ে তোলে। সেই থেকে গঠন হয় সশস্ত্র শাখা কেএনএফ এর পুর্নাঙ্গ রুপ কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ)।
এ অরাজনৈতিক সংগঠনটি ২০১৭ সালে সশস্ত্র শাখা সৃষ্টির পর রাজনৈতিক সংগঠনের রূপ নেয়। অতঃপর সংগঠনের নামটিও কুকি-চিন জাতীয় উন্নয়ন সংগঠন (কেএনডিও) থেকে কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ)-এ পরিবর্তনে আনা হয়। তবে ২০২২ সালের মে মাস থেকে তাদের কর্মকাণ্ড প্রকাশ্যে আসে।
মূলত সন্তু লারমার জেএসএস থেকে বের হয়ে বম জাতিগোষ্ঠীর কিছু সদস্যকে নিয়ে নাথান বম সশস্ত্র সংগঠনটি তৈরি করেন। যে কারণে এটি বম বাহিনী নামেও পরিচিত। তবে কেএনএফ দাবি করছে, রাঙামাটি ও বান্দরবান অঞ্চলের ছয়টি জাতিগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করছে তারা। সেগুলো হলো বম, পাংখোয়া, লুসাই, খিয়াং, ম্রো ও খুমি। এই ছয়টি জাতি অধ্যুষিত রাঙামাটির বাঘাইছড়ি, বরকল, জুরাছড়ি ও বিলাইছড়ি এবং বান্দরবানের রোয়াংছড়ি, রুমা, থানচি, লামা ও আলীকদম—এই উপজেলাগুলো নিয়ে আলাদা রাজ্য গঠন করা হবে।
নাথাব বমের শিল্প কর্ম
১৯৯৭ সালে পার্বত্য শান্তি চুক্তির পর সহশিল্পী নিম্মী দেওয়ানকে সঙ্গে নিয়ে খাগড়াছড়ি শহরের মহাজনপাড়া এলাকার লারমা স্কয়ারে এম এন লারমার একটি ভাস্কর্য নির্মাণ করেন। তখন হিল আর্টিস্টস গ্রুপের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তিনি। নাথানদের নির্মিত লারমার আবক্ষ ভাস্কর্যটি উদ্বোধন করা হয় ২০০০ সালে। এরপর শিল্পী হিসেবে তাঁর খ্যাতি বাড়ে। তিনি লেখালেখি করতে শুরু করেন।
২০১৫ সালে ইউরোপের শিল্পাঙ্গন ও আর্ট স্কুলসমূহে শিল্পচর্চা করেন। নেদারল্যান্ডস সহ কয়েকটি আর্ট প্রতিষ্ঠান থেকে সার্টিফিকেটসহ ডিপ্লোমা অর্জন করেন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের চিত্রশিল্পীদের তাঁর সম্পর্কোন্নয়ন হলে ইউরোপের বিভিন্ন দেশ কর্তৃক আয়োজিত আর্ট কন্টেস্টেও পুরস্কৃত হন।
নাথান বমের সাহিত্য কর্ম
নাথান বম একজন বম জনগোষ্ঠীর প্রথম ইতিহাস গ্রন্থ প্রণেতা ও এথনোগ্রাফার। ২০০২ সালে বম জনগোষ্ঠীদের সাহিত্য সংরক্ষণ ও চর্চার জন্যে সাহিত্য সংগঠন ‘বম লিটারেচার ফোরাম (বিএলএফ) প্রতিষ্ঠা করেন। কুকি-চিনভুক্ত জাতিগোষ্ঠীর পরিচিতি নিয়ে ‘দ্য বমজৌ’ নামে একটি বই প্রকাশ করেন।
সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ ও সম্পদের বিবরণ
২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও অংশগ্রহণ করতে চেয়েছিলেন নাথান। মনোনয়নপত্র বাতিল হলে শেষ পর্যন্ত তাঁর আর নির্বাচনে অংশগ্রহণ হয়নি। ২০১৮ সালের ২৮ নভেম্বর স্থানীয় নির্বাচনি দপ্তরে হলফনামা দাখিল করেন নাথান বম। সেই নির্বাচনে সেই হলফনামায় নাথান লনচেও বমের পেশার বিবরণে লেখা আছে, ‘চিত্রশিল্পী ও লেখক হিসেবে অঙ্কিত শিল্পকর্ম ও প্রকাশিত গ্রন্থাদি বিক্রয় এবং শিল্পসৃষ্টি’। সেই পেশা থেকে আয় ছয় লক্ষ টাকা।
তিনি এবং তার স্ত্রীর অস্থাবর সম্পদের হিসেবে নিজ নামে তিন লাখ টাকা উল্লেখ করা আছে। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে জমা অর্থের পরিমাণ তার নিজ নামে দুই লাখ এবং স্ত্রীর নামে চার লাখ টাকা উল্লেখ করেছেন। ‘স্বর্ণ ও অন্যান্য মূল্যবান ধাতু ও পাথর নির্মিত অলংকারাদি’ নিজ নামে পাঁচ লাখ এবং স্ত্রীর নামে দুই লাখ টাকা উল্লেখ করেছেন। ইলেক্ট্রনিক সামগ্রী ও আসবাবপত্র তার নিজ নামে উল্লেখ করেছেন যথাক্রমে এক লাখ ও দুই লাখ টাকা।
কৃষিখাত, ব্যবসা, শেয়ার, সঞ্চয়পত্র বা ব্যাংক আমানত, চাকরি ও অন্যান্য বিষয় উল্লেখ করার জন্য নির্ধারিত ঘরগুলো ফাঁকা ছিলো।
অস্থাবর সম্পদের কলামে বন্ড, ঋণপত্র, স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্ত ও তালিকাভুক্ত নয়, এমন কোম্পানির শেয়ার, পোস্টাল, সেভিংস সার্টিফিকেটসহ বিভিন্ন ধরনের সঞ্চয়পত্রে বা স্থায়ী আমানতে বিনিয়োগের পরিমাণ, ‘বাস, ট্রাক, মোটরগাড়ি ও মোটরসাইকেল ইত্যাদির বিবরণী’ ও অন্যান্যের ঘর ফাঁকা রাখা হয়েছিলো।
আর স্থাবর সম্পদের মধ্যে নিজ নামে কৃষিজমি তিন লাখ টাকা, অকৃষি জমি চার লাখ টাকা, দালান সাত লাখ টাকা, বাড়ি বা অ্যাপার্টমেন্ট তিন লাখ টাকা অর্জনকালীন সময়ের আর্থিক মূল্য উল্লেখ করা হয়েছে। এ ছাড়া চা বাগান, রাবার বাগান, মৎস্য খামার ইত্যাদির ঘর ফাঁকা রাখেন। একই সঙ্গে ‘স্ত্রী/পিতার নামে’, ‘নির্ভরশীলের নামে’, ‘যৌথ মালিকানার ঘরগুলোতেও কোনো কিছু লেখা ছিলো না।
নাথান বমের উপদেষ্টা
কেএনএফ প্রধান নাথান বমের উপদেষ্টা হচ্ছেন লালএংলিয়ান বম, যিনি বর্তমানে ভারতের মিজোরাম রাজ্যের রাজধানীর আইজল শহরে বসবাস করেন।
(এই বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)