এক ডিসেম্বরের পর আরেক ডিসেম্বর পেরিয়ে গেলেও বিশ্বকাপ ফুটবলের আবেগ-উচ্ছ্বাসময় সেই রেশ এখনও কাটেনি। ২০২২ সালের ১৮ ডিসেম্বর আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ জয়ের মধ্যে সর্বশেষ বিশ্বকাপ ফুটবলের আনন্দযজ্ঞ শেষ হয়েছিল। সেদিন কাতারের লুসাইল স্টেডিয়ামে আর্জেন্টিনা এবং ফ্রান্সের মধ্যে যে রক্ত হিম করা ফাইনাল ম্যাচ হয়, তা এ যাবৎকালের সেরা ফাইনাল হিসেবেই এখন স্বীকৃত।
সেই দুর্দান্ত, রোমাঞ্চকর ফাইনাল ক্রীড়ামোদীদের হৃদয় এতটাই স্পর্শ করেছিল যে এখনও এই বিশ্বকাপ যেন চোখের সামনে লেপ্টে আছে। কাতারের সেই লুসাইল স্টেডিয়ামে আজ থেকে ৩০ দিনের জন্য শুরু হচ্ছে এশিয়ার ফুটবলের শ্রেষ্ঠত্বের লড়াই। আজ সেই লুসাইল স্টেডিয়ামেই এশিয়ান কাপ ফুটবলের চ্যাম্পিয়নশিপ যুদ্ধের বল গড়াবে। বাংলাদেশ সময় রাত দশটায় গত বিশ্বকাপ ফুটবলের আয়োজক এবং গত এশিয়ান কাপের চ্যাম্পিয়ন কাতার মুখোমুখি হবে ছোট্ট দেশ লেবাননের।
এশিয়ান ফুটবলের এবারের আঠারোতম আসরে চ্যাম্পিয়নশিপের জন্য লড়বে মোট ২৪টি দল। ছয় গ্রুপে ভাগ হয়ে খেলবে এই দেশগুলো। গ্রুপ ‘এ’তে রয়েছে কাতার, চীন, তাজিকিস্তান এবং লেবানন। গ্রুপ ‘বি’তে রয়েছে অস্ট্রেলিয়া, উজবেকিস্তান, ভারত, সিরিয়া। গ্রুপ ‘সি’তে রয়েছে ইরান, আরব আমিরাত, হংকং ও ফিলিস্তিন। গ্রুপ ‘ডি’তে রয়েছে জাপান, ইন্দোনেশিয়া, ইরাক এবং ভিয়েতনাম। গ্রুপ ‘ই’তে রয়েছে সাউথ কোরিয়া, মালয়েশিয়া, জর্ডান এবং বাহরাইন। গ্রুপ ‘এফ’তে রয়েছে সৌদি আরব, থাইল্যান্ড, কিরগিস্তান এবং ওমান।
এবারের আসরে সম্ভাব্য চ্যাম্পিয়ন হিসেবে জাপান, সাউথ কোরিয়া, সৌদি আরব, ইরান, কাতারকে ভাবা হচ্ছে। এরমধ্যে জাপান এবং সাউথ কোরিয়া খুবই আশাবাদী। বিশ্বকাপ ফুটবলের অনন্য পারফরম্যান্সের ধারাবাহিকতায় জাপান এবার চ্যাম্পিয়ন হয়ে গতবার ট্রফি হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার সব দুঃখ ভুলে যেতে চায়। জাপান গতবারের ফাইনালে ৩-১ গোলে হেরেছিল কাতারের কাছে। এটি তাদের জন্য এক হৃদয় ভাঙা দুঃসহ স্মৃতি। এরকম স্মৃতির পুনরাবৃত্তি তারা আর চায় না। অন্যদিকে এশিয়ান কাপের শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে সাউথ কোরিয়ার রয়েছে সমুদ্রসম দুঃখ। সেই কোনকালে ১৯৫৬ এবং ১৯৬০ সালে সাউথ কোরিয়া পরপর চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল, এরপর আর কখনই লাইম লাইটে আসতে পারেনি। বলা প্রয়োজন, এবারের বিশ্বকাপ ফুটবলে জাপান এবং সাউথ কোরিয়া কয়েকটি অঘটন লাগিয়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে ছাড়ে। বিশেষ করে জাপানের খেলায় ছিল অন্যরকম ধার।
এবারের বিশ্বকাপে গ্রুপ পর্যায়ের লড়াইয়ে জাপানের খেলায় ছিল মহাচমক। গ্রুপে জার্মানি এবং স্পেনের মতো দুই ফুটবল শক্তিকে হারিয়ে দিয়েছিল জাপান। জাপানের খেলাতে জাদুকরীও ছিল। তবে কোস্টারিকার সাথে হেরেও জাপান উঠেছিল দ্বিতীয় রাউন্ডে। শেষ পর্যন্ত শত সম্ভাবনা তৈরি করেও জাপান দ্বিতীয় রাউন্ডে টাইব্রেকারে ক্রোয়েশিয়ার কাছে হেরে কোয়ার্টারে ফাইনালে উঠতে ব্যর্থ হয়েছিল।
তবে এশিয়ান কাপে শ্রেষ্ঠত্ব জাপানেরই। জাপান ’৯২ সালে নিজ দেশের মাটিতে সৌদি আরবকে ১-০ গোলের ব্যবধানে হারিয়ে প্রথম চ্যাম্পিয়ন কৃতিত্ব দেখায়। এরপর ২০০০ সালে জাপান একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি করে। সেবার লেবাননের মাটিতে ১-০ গোলে ফের সৌদি আরবকে পরাজিত করে। ২০০৪ সালে জাপান চ্যাম্পিয়নশিপের ধারাবাহিকতা রক্ষা করে। সেবার চীনের মাটিতেই চীনকে ৩-১ গোলে পরাজিত করে। এরপর ২০১১ সালে জাপান কাতারে অনুষ্ঠিত ১৫তম এশিয়ান ফুটবল কাপে অস্ট্রেলিয়াকে ১-০ গোলে পরাজিত করে শেষবারের মতো চ্যাম্পিয়ন হয়।
এদিকে এবারের এশিয়ান কাপ ফুটবলের চ্যাম্পিয়নশিপের অন্যতম দাবিদার সাউথ কোরিয়ার এই টুর্নামেন্টে সুখস্মৃতি বলে তেমন কিছু নেই। ১৯৫৬ এবং ১৯৬০ সালে সাউথ কোরিয়া পরপর চ্যাম্পিয়ন হয়। এরপর তারা আর চ্যাম্পিয়ন হতে পারেনি। তবে ২০১৫ সালে শেষবারের মতো চ্যাম্পিয়নশিপের কাছাকাছি গেলেও অস্ট্রেলিয়ার কাছে ২-১ গোলের ব্যবধানে হেরে রানার্সআপ হয়েই খুশি থাকতে হয়। সাউথ কোরিয়া এবার এশিয়ান কাপের শ্রেষ্ঠত্ব নিতে উজাড় করে খেলবে। এজন্য তারা জার্মান কোচ বিশ্বখ্যাত সাবেক ফুটবলার ইয়ুর্গেন ক্লিন্সম্যানকে গত বছরের ২৭ ফেব্রুয়ারি থেকে প্রধান কোচ হিসেবে নিয়োগ দেয়। তাকে নিয়েই তারা আশার আলো দেখছে। তার নেতৃত্বে সাউথ কোরিয়া এপর্যন্ত ১১টি ম্যাচের মধ্যে জয় পেয়েছে ৬টিতে, ড্র করেছে ৩টি ম্যাচে এবং পরাজিত হয়েছে ২টি ম্যাচে।
জাপানের কোচ হাজিমে মোরিয়াসু চ্যাম্পিয়নশিপকে ঘিরেই তার সব কৌশল প্রণয়ন করেছেন। তিনি বলেছেন, কাউকেই ছোট করে দেখছেন না। চ্যাম্পিয়নই মূল লক্ষ্য। দলের ক্যাপ্টেন লিভারপুলের ফুটবলার ওয়েতেরু এন্ডোকে সামনে রেখে সব পরিকল্পনা করেছেন। কোচ হাজিমে মোরিয়াসু মনে করেন জাপান দলে এই প্রজন্মের দুর্দান্ত সব ফুটবলার রয়েছে। যাদেরকে বিশ্বাস করা যায়। আসলেই জাপান দলে বেশকিছু প্রতিভাবান ফুটবলার রয়েছে যারা ইউরোপিয়ান লিগে নিয়মিত খেলে থাকেন। এটা সত্য এদের কারণেই বিশ্বকাপে জাপান দুর্দান্ত দুটি জয় ছিনিয়ে আনতে সক্ষম হয়। এশিয়ান কাপে আসার জাপান সর্বশেষ থাইল্যান্ডের সাথে একটি ফ্রেন্ডশিপ ম্যাচে ৫-০ গোলে জয়লাভ করেছে। বোঝা যায়, জাপানের পাওয়ার হাউজ শতভাগ ঠিক আছে।
এদিকে এবারের বিশ্বকাপে কাতারের মাঠে উদ্বোধনী ম্যাচেই আর্জেন্টিনার বিপক্ষে অঘটন ঘটিয়ে দেওয়া সৌদি আরবও যে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার জন্য স্বপ্ন ছুঁড়ে দিয়েছে এতে সন্দেহ নেই। ২৭ আগস্ট থেকে সৌদি আরব ইতালির কোচ রবার্তো মানচিনিকে হেড কোচ হিসেবে নিয়োগ দেয়। নিয়োগ পাওয়ার পর রবার্তো মানচিনি উদাত্ত কণ্ঠে বলেন, সৌদিতে ফুটবলের যে জনপ্রিয়তা সামনে এগুচ্ছে সেখানে তিনি যোগ দিতে পেরে খুবই খুশি এবং তার কাজের নতুন সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। রবার্তো মানচিনির এখন প্রধান লক্ষ্যই হল সৌদি আরবকে এশিয়ান ফুটবলের শ্রেষ্ঠ আসনে বসানো। সুতরাং জাপান বা সাউথ কোরিয়াকে মোটে সহজে পার পেতে দেবেন না রবার্তো মানচিনি।
চ্যাম্পিয়নের রেকর্ড অনুযায়ী এপর্যন্ত এশিয়ান কাপের যে ১৭টি টুর্নামেন্ট হয়েছে এরমধ্যে সর্বাধিক চারবার চ্যাম্পিয়ন হয়েছে জাপান। এরপরপরই রয়েছে সৌদি আরব এবং ইরান। এ দুটি দল তিনবার করে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। দুবার করে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে সাউথ কোরিয়া। এরপর একবার চ্যাম্পিয়ন হয়েছে ইসরায়েল, কুয়েত, ইরাক এবং অস্ট্রেলিয়া।