এক.
১৯৮৩ সালের অক্টোবর মাস। সামরিক শাসক এরশাদ লন্ডন সফর শেষে নিয়ম মেনে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করলেন পার্লামেন্ট ভবনের দোতলায় এক নাম্বার কমিটি রুমে। ক্ষমতা দখল করে স্বাভাবিক রাজনীতির সকল কর্মকাণ্ড বন্ধ করে দিয়েছিলেন এরশাদ। গণতন্ত্রের সকল অঙ্গসংগঠনকেও ধামাধরায় পরিণত করেছিলেন। রাজনীতি, শিল্প-সাহিত্য, সংস্কৃতি- সবকিছুতে তখন এক শ্বাসবন্ধ পরিবেশ।
সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকরা তাকে দেশের চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে একের পর এক রাজনৈতিক প্রশ্ন করে যাচ্ছিলেন। সেসময় এরশাদ বিরোধী দলগুলোকে রাজনৈতিক সংলাপে ডেকেছিলেন। তার ডাকে সংলাপে সাড়া দিচ্ছিলেন না কেউ। কে স্বৈরাচারের সাথে কথা বলতে আসবে?
সেসময় সংলাপে না আসায় এরশাদ রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর তীব্র উষ্মা প্রকাশ করে বলেছিলেন, আমি কি রেড লাইট জোনে থাকি যে আমার সঙ্গে কেউ কথা বলবে না!
দুই
মে আই আস্ক ইউ এ নন- পলিটিক্যাল কোয়েশ্চেন? সংসদ ভবনের সেই সংবাদ সম্মেলনে স্বৈরশাসক এরশাদ যখন সাংবাদিকদের ক্রমাগত রাজনৈতিক প্রশ্নে জর্জরিত হচ্ছিলেন তখন বাসসের সিনিয়র সাংবাদিক জাহাঙ্গীর হোসেনের এই প্রশ্নে তিনি যেন একটু স্বস্তি ফিরে পেলেন।
এরশাদের সম্মতি পেয়ে জাহাঙ্গীর হোসেন যে প্রশ্ন করেছিলেন তা তাকে বাংলাদেশের সাংবাদিকতার ইতিহাসে আর দশজনের চেয়ে ভিন্নতা দিয়েছে। প্রবাদতুল্য করে রেখেছে। এরশাদের নয় বছরের স্বৈরাচারী আমলে তাকে কখনো এরকম বিব্রতকর প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়নি।
জাহাঙ্গীর হোসেন এরশাদকে প্রশ্ন করেছিলেন, আপনি ক্ষমতায় আসার আগে কেউ জানতো না আপনি একজন কবি। এখন সব পত্রিকার প্রথম পাতায় আপনার কবিতা ছাপা হয়। পত্রিকার প্রথম পাতা তো খবরের জন্য, কবিতার জন্য নয়। বাংলাদেশের প্রধানতম কবি শামসুর রাহমানেরও তো এই ভাগ্য হয়নি। আমার প্রশ্ন হচ্ছে আপনার কবিতা প্রথম পাতায় ছাপানোর জন্য কি কোন নির্দেশ জারি করা হয়েছে?
এরশাদের পাশে বসেছিলেন তার পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ আর এস দোহা। তিনি জাহাঙ্গীর হোসেনের প্রশ্নের উত্তর দেয়ার চেষ্টা করলেন, ‘শামসুর রাহমান ইজ নট দ্য সিএমএলএ (শামসুর রাহমান প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক নন)’।
তিন.
এরশাদ বুঝতে পেরেছিলেন জাহাঙ্গীর হোসেন যে প্রশ্ন করেছেন তার উত্তর পররাষ্ট্রমন্ত্রী দিলে চলবে না। উত্তরটা তাকেই দিতে হবে। তিনি দোহাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, আমি দেশের জন্য এত করি, এটুকু কি আপনি দেবেন না আমাকে? এরশাদের উত্তরের বিপরীতে জাহাঙ্গীর হোসেন পাল্টা প্রশ্ন করলেন, প্রশ্ন করার অধিকার আমার, উত্তর দেওয়ার অধিকার আপনার। কিন্তু আপনি আমার প্রশ্নের উত্তর দেননি। বুদ্ধিমান এরশাদ যা বোঝার বুঝে গেলেন। তিনি জাহাঙ্গীর হোসেনকে বললেন, আপনি যদি চান, আর ছাপা হবে না।
কী লজ্জা! কী লজ্জা! কী লজ্জা!
এ ঘটনার পর তৎকালীন দৈনিক বাংলা, সাপ্তাহিক বিচিত্রাসহ পত্র পত্রিকার প্রথম পাতায় এরশাদের কবিতা প্রকাশ প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। তারপর জাহাঙ্গীর হোসেনের কপালে যা ঘটার তাই ঘটলো। তাকে প্রথমে শাস্তিমূলক বদলি করা হলো চট্টগ্রামে। তিনি যেতে চাননি। এর কিছুদিন পর সরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করে নিশ্চিত জীবনযাপন করার ভাবনা পরিত্যাগ করে চাকরি ছেড়ে দিয়েছিলেন তিনি। এরপর থেকে ফ্রিল্যান্স সাংবাদিকতা করছেন এখনও।
চার.
এখন দিন পাল্টেছে। সরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে জাহাঙ্গীর হোসেনের মতো এরকম সরকার প্রধানের বিরুদ্ধে গঠনমূলক, তির্যক প্রশ্ন করতে পারার সৎ সাহস, যোগ্যতা এখন আর দেখা যায় না বললেই চলে। এখন সংবাদ সম্মেলনে প্রশ্ন করতে আসা তোষামোদকারীদের প্রশংসামূলক প্রশ্নে খোদ সরকার প্রধানই লজ্জায় পড়ে প্রশ্নকারীর দিকে অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকেন।
পাঁচ.
৮৫ ছুঁই ছুঁই জাহাঙ্গীর হোসেন এখনও প্রায় নিয়মিত প্রেসক্লাবে আসেন। নিজের পছন্দমতো জায়গায় বসেন। সময় কাটান। প্রচুর সিগারেট খান। অনুজদের সাথে আড্ডা দেন। জাহাঙ্গীর ভাইকে দেখলে সব বাদ দিয়ে তার পাশে গিয়ে বসি। সময় কাটাই। কথা বলি। উপমহাদেশসহ বিশ্বের শিল্প-সাহিত্য, ইতিহাস-ঐতিহ্য, সংস্কৃত, নৃতত্ত্ব, নন্দনতত্ত্বসহ কত কত ঘটনা যে তার জানা।
প্রিয় অগ্রজ,
জাহাঙ্গীর হোসেন
আপনাকে দেখলে নিজেকে সমৃদ্ধ করি।
আপনার প্রতি অফুরান ভালোবাসা।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)