বিএনপি নেতাদের ১৭ মিনিটের এক ভার্চুয়াল মিটিংয়ে ট্রেনে আগুন দেওয়া ও ভোট কেন্দ্রে ককটেল বিস্ফোরণ ঘটনোর সিদ্ধান্ত নেওয়ার একদিন পর রাজধানীর গোপীবাগ এলাকায় বেনাপোল এক্সপ্রেস ট্রেনে আগুন দেওয়া হয় বলে দাবি করেছে ডিবি।
এ ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক মোহাম্মদ নবী উল্লাহ নবীসহ ৮ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এসব তথ্য নিশ্চিত করেছে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। আগুনের ঘটনায় অর্থদাতা হিসেবে গ্রেপ্তার এ বিএনপি নেতাকে শনিবার রাজনৈতিক সহিংসতার মামলায় আদালতে হাজির করা হয়।
ডিবি প্রধান হারুন অর রশীদ জানান, গত বৃহস্পতিবার (৪ জানুয়ারি) সন্ধ্যায় ভার্চুয়াল মিটিংটি হয়। ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুববদলের আহ্বায়ক খন্দকার এনামুল হক এনামের সভাপতিত্বে মিটিং থেকেই একজনকে ট্রেনে আগুন দেওয়ার দায়িত্ব দেওয়া হয়। মিটিংয়ের পরদিন শুক্রবার (৫ জানুয়ারি) রাত ৯ টা ৫ মিনিটে বেনাপোল এক্সপ্রেস ট্রেনে আগুন দেওয়া হয়।
নবীউল্লাহ নবী ৩ দিনের রিমান্ডে
বিএনপির ঢাকা মহানগর দক্ষিণের যুগ্ম-আহ্বায়ক নবীউল্লাহ নবীকে তিন দিনের রিমান্ড পাঠিয়েছে আদালত। বেনাপোল এক্সপ্রেস ট্রেনে গত শুক্রবার রাতে আগুনের ঘটনায় অর্থদাতা হিসেবে গ্রেপ্তার এ বিএনপি নেতাকে শনিবার রাজনৈতিক সহিংসতার মামলায় আদালতে হাজির করা হয়। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) এসআই আশরাফুল আলম নবীকে আদালতে হাজির করে ৭ দিনের রিমান্ড আবেদন করলে ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট ফারজানা শাকিলা সুমু চৌধুরী তিন দিনের রিমান্ডের আদেশ দেন।
গত বছরের ৫ নভেম্বর যাত্রাবাড়ী থানায় গাড়িতে অগ্নিসংযোগ ও পুলিশকে দায়িত্ব পালনে বাধা দেওয়ার অভিযোগে এসআই রফিকুল ইসলাম বাদী হয়ে ওই মামলা করেন। আদালতে নবীর জামিন চেয়ে করা আবেদন খারিজ করে দেন ম্যাজিস্ট্রেট।
দগ্ধদের শঙ্কামুক্ত বলা যাচ্ছে না
বেনাপোল এক্সপ্রেসে আগুনের ঘটনায় নিহত হয়েছেন চারজন। দগ্ধ হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ৮ জন। দগ্ধরা হলেন- ৩০ বছর বয়সী আসিফ মোহাম্মদ খান, ৩২ বছর বয়সী ডা. কৌশিক বিশ্বাস, ২২ বছর বয়সী নাফিস আলম, ৩১ বছর বয়সী মাসুদ রানা, ৪০ বছর বয়সী ডেইজি আক্তার রত্না, ৬ বছরের শিশু রিহান, ১১ বছরের দিহান এবং ৪৮ বছর বয়সী মোহাম্মদ ইকবাল হোসেন।
আট রোগীর মধ্যে তিনজনকে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) রাখা হয়েছে। তারা হলেন- আসিফ মোহাম্মদ খান, নাফিস আলম ও ডা. কৌশিক বিশ্বাস।
শেখ হাসিনা বার্ন ইনস্টিটিউটটের সমন্বয়ক ডাক্তার সামন্ত লাল সেন বলেন, ‘দগ্ধদের বার্নের (পোড়া) পরিমাণ কম। অনেকের বাইরে কোনো বার্নই হয়নি। তবে সবচেয়ে বিপজ্জনক হলো, তাদের সবারই শ্বাসনালি পুড়ে গেছে। আমরা দেখতে পেলাম, তাদের অনেকের ভেতরে অসুবিধা আছে, ম্যানেজ করতে সময় লাগবে। এখনই তাদের শঙ্কামুক্ত বলা যাচ্ছে না।’
ডিবি জানায়, গ্রেপ্তারের পর ট্রেনে আগুন দেওয়ার পরিকল্পনার বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় যুবদল নেতা কাজী মনসুরকে। তিনিই ভার্চ্যুয়াল মিটিংয়ের তথ্য নিশ্চিত করেন। জানান, মিটিংয়ে উপস্থিত ছিলেন ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির আহ্বায়ক খন্দকার এনামুল হক এনাম, যুবদল নেতা রবিউল ইসলাম নয়নসহ আরও অনেকে। মিটিংটা ১৭ মিনিট ধরে চলে।
ট্রেনে কে আগুন দিতে পারবে?
ভার্চুয়াল এ মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত হয় দুটি। প্রথম সিদ্ধান্ত, ভোট কেন্দ্রে ককটেল বিস্ফোরণ ঘটানো। যাতে ভোটাররা ভয়ে কেন্দ্রে না যেতে পারে। দ্বিতীয় সিদ্ধান্ত হয় ট্রেনে আগুনের। মিটিংয়ে যুবদল নেতা রবিউল ইসলাম নয়ন জিজ্ঞাসা করেন- ট্রেনে কে আগুন দিতে পারবে? অপর এক নেতা এ বিষয়ে সম্মত হয়ে নিজেই ট্রেনে আগুন দিতে রাজি হন।
মনসুর পুলিশকে আরও জানান, মিটিংয়ে রবিউল ইসলাম কিশোরগঞ্জ থেকে আগত কোনো ট্রেন ঢাকায় ঢোকার পর বা নারায়ণগঞ্জ রুটের ট্রেনে আগুন দেওয়ার কথা বলেন।
ডিবি প্রধান হারুন অর রশীদ জানান, দক্ষিণ ঢাকার যুবদল নেতা রবিউল ইসলাম নয়নের তত্ত্বাবধানে সংগঠনটির কয়েকটি টিম লালবাগের কয়েকজন দাগী সন্ত্রাসীদের দিয়ে বেনাপোল এক্সপ্রেসে আগুন লাগানো হয়। ভিডিও কনফারেন্সে বলা হয়- ট্রেনে কে আগুন লাগাবেন? কনফারেন্সে থাকা ১০-১২ জনের একজন বলেন তিনি আগুন লাগাতে পারবেন।
ট্রেনে আগুন দিতে সম্মত হওয়ার ব্যক্তিটি কে, তদন্তের স্বার্থে তার নাম প্রকাশ করা যাচ্ছে না বলে জানান ডিবি প্রধান। তিনি বলেন, ওই ভিডিও কনফারেন্সে অংশ নেওয়া আরও তিন ব্যক্তি আগুন লাগাতে পারবেন বলে জানিয়েছিলেন। তারা ২০১৩-১৪ সালে বিভিন্ন এলাকায় বোমা নিক্ষেপ ও অগ্নিসংযোগ করেছিল। বেনাপোল এক্সপ্রেস ট্রেনটি যাত্রাবাড়ী আশপাশের এলাকায় এলে আগুন দেওয়া হয়।
গ্রেপ্তার ৮ জন
ডিবি জানায়, জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে যানবাহনে আগুন দেওয়া, প্রার্থীদের অস্থায়ী নির্বাচনী ক্যাম্পকে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া, ভোটকেন্দ্রে অথবা তার আশপাশে হাত বোমা নিক্ষেপ করে ভোটারদেরকে আতঙ্কিত করা, প্রচারপত্র বিলি করার কাজসহ গোপীবাগে বেনাপোল এক্সপ্রেস ট্রেনের বগিতে আগুন দেওয়ার অন্যতম পরিকল্পনাকারী এবং জনবল দাতা কাজী মনসুর আলম এবং বিএনপির পক্ষে আশ্রয় এবং অর্থ দাতা নবীউল্লাহ নবীসহ ৮ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। শুক্রবার রাতে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে তাদেরকে গ্রেপ্তার করে ডিবি লালবাগ এবং ওয়ারী বিভাগ। গ্রেপ্তার অন্যরা হলেন- মো. ইকবাল হোসেন স্বপন, মো. রাসেল, দেলোয়ার হাকিম বিপ্লব, মো. সালাউদ্দিন, মো. কবির ও মো. হাসান আহমেদ।