নূর হোসেন দিবস আজ। ১৯৮৭ সালের ১০ নভেম্বর গণতন্ত্রের সংগ্রামে জীবন দিয়েছিল অমিত সাহসী যুবক নূর হোসেন। যার বুকে পিঠে লেখা ছিল ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক, গণতন্ত্র মুক্তি পাক’। নূর হোসেনের মতো শত শহীদের রক্তের পথ বেয়ে গণতন্ত্র মুক্তি পেয়েছিল। কিন্তু গণতন্ত্রের প্রকৃত সুফল বাংলাদেশের জনগণ ভোগ করতে পারেনি। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া বারবার ব্যাহত হয়েছে। মানুষের মৌলিক অধিকারগুলো রয়ে গেছে উপেক্ষিত। গণতন্ত্রের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ রাজনৈতিক সংস্কৃতি, রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান এবং সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানসূমহ যথাযথভাবে বিকশিত না হওয়ায় আমরা এখনো রয়ে গেছি অসম্পূর্ণ গণতন্ত্রের সংগ্রামে।
১৯৮৭ সাল, ১০ নভেম্বর। বাঙালি জাতি নিষ্পেশিত হচ্ছে সামরিক শাসনের জাঁতাকলে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার মধ্য দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশে সামরিক শাসনের যাত্রা শুরু হয়। অনেক নারকীয় ঘটনা-দুর্ঘটনার মধ্য দিয়ে ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ ক্ষমতা দখল করেন সামরিক জান্তা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। ১৫ আগস্টের বিয়োগান্তক ঘটনার পর থেকেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী, গণতন্ত্রে বিশ্বাসী, রাজনৈতিক ও সামাজিক শক্তিসমূহ সামরিক শাসন অবসানের লক্ষ্যে আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা করছিল। কিন্তু জগদ্দল পাথরকে এত সহজে সরানো যায় না।
খুনি জিয়া খুন হয়ে যাওয়ার পর রক্তপাতহীন অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে চেপে বসা জগদ্দল পাথরের নব্য সংস্করণ ও ধারাবাহিকতা এরশাদের সামরিক শাসন। ১৯৮২’র ২৪ মার্চ থেকেই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের ছাত্র সংগঠনগুলো ও ১০ দলীয় ঐক্যজোট প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করে। সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন ১৯৮৩-এর মধ্য ফেব্রুয়ারি ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে এক কার্যকর প্রতিরোধ গড়ে তোলে। শহীদ হন জাফর, জয়নাল, মোজাম্মেল কাঞ্চন, দীপালি সাহাসহ হাজারো সাথী, যাদের লাশ গুম করে ফেলে স্বৈরশাসক। আন্দোলনের নবতর যাত্রায় নানা উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে ছাত্রসমাজ ও জনগণ ঐক্যবদ্ধ হতে থাকে। রাজনৈতিক দলসমূহ আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ১৫ দলীয় ঐক্যজোট গঠন করে।
পাশাপাশি খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে ক্ষমতাচ্যুত বিএনপি ৭ দলীয় ঐক্যজোট গঠন করে। কিন্তু আন্দোলনের যাত্রাপথে ১৯৮৬-এর নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ১৫ দলীয় ঐক্যজোটের মধ্যে ভাঙনের সৃষ্টি হয়। ৮ দল, ৫ দল ও ৭ দল এই তিনটি জোটের আবির্ভাব ঘটে। সবার লক্ষ্যই এক ও অভিন্ন। সামরিক শাসনের অবসান ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ফিরে যাওয়া।
সেদিন ছিল ৮ দল, ৫ দল ও ৭ দলের নৌপথ, রেলপথ ও রাজপথ অবরোধের কর্মসূচি। কেন্দ্রীয় কর্মসূচির অংশ হিসেবে সচিবালয়ের সামনে অবস্থান ধর্মঘট কর্মসূচি। কার্তিকের কুয়াশাচ্ছন্ন সকালে দলে দলে জনতা সমবেত হতে থাকে নিজ নিজ জোটের ব্যানারে। ৮ দলীয় জোটের অবস্থান ছিল বর্তমান নূর হোসেন স্কয়ারে। ৫ দলীয় জোটের অবস্থান ছিল হাউস বিল্ডিং ফাইন্যান্স কর্পোরেশনের সামনে ও ৭ দলের অবস্থান ছিল দৈনিক বাংলা মোড়ে। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ৮ দলীয় জোটের অবস্থানে মিলিত হলো এক দল সাহসী যুবকের খণ্ড মিছিল।
ওই মিছিলটি গুলিস্তান থেকে তোপখানা মোড় পর্যন্ত বারবার প্রদক্ষিণ করছিল এবং আন্দোলনকামী জনতাকে অনুপ্রাণিত করছিল। মিছিলের অগ্রভাগে ছিল নূর হোসেন। খণ্ড মিছিলে অংশগ্রহণকারী যুবকদের উদোম গায়ে লেখা ছিল উপরোক্ত স্বৈরাচারবিরোধী স্লোগান। আমরা যারা ৫ দলের ছাত্রকর্মী ছিলাম, তারাও হাউস বিল্ডিং থেকে জিরো পয়েন্ট আবার কখনো দৈনিক বাংলা পর্যন্ত সমবেত আন্দোলনকারীদের স্লোগানে প্রকম্পিত করে উদ্দীপ্ত করার চেষ্টা করছিলাম। ততক্ষণে জননেত্রী শেখ হাসিনাও আন্দোলনস্থলে উপস্থিত হয়েছেন। স্বৈরাচারী এরশাদের পুলিশ বাহিনী প্রথমে টার্গেট করে গুলি করে নূর হোসেনকে হত্যা করে, পরবর্তী সময়ে শুরু হয় জননেত্রী শেখ হাসিনা যে অস্থায়ী মঞ্চে ছিলেন সেই মঞ্চকে টার্গেট করে গুলিবর্ষণ। সৌভাগ্যক্রমে সে দিন জননেত্রী শেখ হাসিনা প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলেন। ৫ দল ও ৭ দলের অবস্থানের ওপরেও পুলিশ জলকামান ও টিয়ারগ্যাস নিক্ষেপ করে সমবেত জনতাকে ছত্রভঙ্গ করে দেয়। কিন্তু জনতার রুদ্ররোষ ঠেকানোর ক্ষমতা স্বৈরাচারের ছিল না।
সেদিন নূর হোসেনের জীবনদান ছিল গণতান্ত্রিক আন্দোলনের এক মাইলফলক, বিষুভিয়াসের আগ্নেয়গিরির এক জ্বলন্ত লেলিহান শিখা, সে দিন নূর হোসেন হয়ে উঠেছিল সমগ্র বাঙালির বাংলাদেশ। ক্ষুদিরাম, মাস্টারদা সূর্যসেন, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার প্রমুখ শহীদ যে পথ দেখিয়ে গেছেন সেই পথেই নূর হোসেন যুক্ত হলেন আরেক স্বাধীনচেতা আত্মোৎসর্গকারী যুবক হিসেবে।
কবি শামসুর রাহমান লিখেছেন ‘বুক তার বাংলাদেশের হৃদয়’ সবার অলক্ষে নূর হোসেনের প্রশস্ত ললাটে আঁকা হয়ে যায়, যেন সে নির্ভীক যোদ্ধা, যাচ্ছে রণাঙ্গনে। উদোম শরীরে নেমে আসে রাজপথে, বুকে-পিঠে রৌদ্রের অক্ষরে লেখা অনন্য শ্লোগান, বীরের মুদ্রায় হাঁটে মিছিলের পুরোভাগে এবং হঠাৎ শহরে টহলদার ঝাঁক ঝাঁক বন্দুকের সীসা। নূর হোসেনের বুক নয়, যেন বাংলাদেশের হৃদয় ফুটো করে দেয়; বাংলাদেশ বনপোড়া হরিণীর মতো আর্তনাদ করে, তার বুক থেকে অবিরল রক্ত ঝরতে থাকে, ঝরতে থাকে।
নূর হোসেন ছিল আওয়ামী যুবলীগের কর্মী, সেই আওয়ামী যুবলীগ বর্তমানে বিভিন্ন কেলেঙ্কারিতে তার গৌরব হারিয়েছে। বড় ঝড় নয়, মৃদু-মন্দ বাতাসেই ভেঙে পড়েছে যুবলীগের কাণ্ডসহ ডালপালা। যে সংগঠন নূর হোসেনের মতো অমিত সাহসী যুবকের জন্ম দেয় সেই সংগঠন এভাবে তার রাজনৈতিক চরিত্র হারাবে এটা ভাবতেও কষ্ট হয়। যুবলীগের নেতারা ভুলে গিয়েছিলেন সংগঠনের জন্ম, সংগঠনের ইতিহাস।
বর্তমান সময়ে আমরা নূর হোসেন দিবস পালন করব তখন, যখন দুর্নীতির বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করা যেকোন সমাজে খুব কষ্টকর। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও দুর্নীতির বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেছিলেন কিন্তু সেই চ্যালেঞ্জ শেষ করার আগেই তাকে হত্যা করা হয়।
গণতন্ত্র ও দুর্নীতি পাশাপাশি চলতে পারে না, দীর্ঘ এগারো বছর ক্ষমতায় থাকার কারণে অনেক বসন্তের কোকিল আওয়ামী লীগের ঘরে বাসা বেঁধেছে, আবার দুঃখের সঙ্গে লক্ষ্য করা যায়, দীর্ঘদিন এ রাজনীতির সঙ্গে জড়িত থেকেও লোভের বশবর্তী হয়ে অনেকেই পথভ্রষ্ট হয়েছেন। নিজেদের গৌরবমণ্ডিত রাজনৈতিক চেহারায় নিজেরাই কালিমা লিপ্ত করেছেন। দেশবাসী চায় এই উভয় রাজনৈতিক ভাইরাস থেকে দেশ মুক্ত হোক।
বাংলাদেশ এগিয়ে গেছে বহুদূর, সব অসাম্প্রদায়িক, মানবিক, গণতান্ত্রিক শক্তির ঐক্যবদ্ধ প্রয়াসের মধ্য দিয়ে তা এগিয়ে যাবে নিরন্তর। আমরা আছি, ছিলাম এবং থাকব। গণতন্ত্র এগিয়ে যাবে শোষণ মুক্তির অভীষ্ট লক্ষ্যে। নূর হোসেন তুমি ঘুমাও শান্তির পতাকাতলে, যে অমিত তেজ নিয়ে জীবন উৎসর্গ করেছ সেই বাংলাদেশ যেন প্রতি মুহূর্তে দৃশ্যমান হয়। অমর হোক তোমার আত্মত্যাগের মহিমা।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)