চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার আইনের অধিকতর সংশোধনী খুবই জরুরী

তামাকদ্রব্য ব্যবহারের ভয়াবহতা এখন আর কারও অজানা নয়। এর পারিবারিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষতি এখন সর্বত্র। প্রতিবছর তামাকে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু এবং রোগীর সংখ্যা বেড়েই চলছে। বিশেষজ্ঞ ডাক্তাররা বলছেন, প্রতিবছর যারা ফুসফুস রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন এর মধ্যে তামাকসেবীরাই বেশি। বিশেষজ্ঞরা তাই বারবার হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করছেন।

তামাকের ব্যবহার কমিয়ে আনতে নানাকৌশল অবলম্বন করছে সরকার ও বেসরকারি সংগঠনগুলো। আইন তৈরির পাশাপাশি তামাকজাত পণ্যের উপর অধিক করারোপ করে তামাকের সহজলভ্যতার পথ বন্ধ করে দেওয়ার দাবি চলমান রয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে অনেক নীতি-কৌশল অবলম্বণ করা হয়েছে। কিন্তু তবুও তামাকের ব্যবহারে মিরাকল কোনো পরিবর্তন আসছে না। বরং তামাক আইন আইনের ফাঁকফোঁকর দিয়ে তামাকের ব্যবহার বেড়েই চলেছে।

দেশে তামাকের ব্যবহার কমিয়ে আনতে সামাজিক ও উন্নয়ন সংগঠনগুলো ভীষণ সক্রিয়। তারা বরাবরই সিগারেটসহ বিভিন্ন তামাক পণ্যের উপর অধিক করারোপের পক্ষে জোর মতামত দিয়ে চলেছেন। তাদের যুক্তি অধিক করারোপ করা হলে, সিগারেটের দাম বাড়লে ধূমপানে আসক্তরা আস্তে আস্তে ধূমপান করা থেকে বিরত থাকবেন। ফলে ধূমপায়ীদের হার কমে আসবে। এতে করে ধীরে ধীরে জনস্বাস্থ্য সুরক্ষিত হবে। তামাকের উচ্চ ব্যবহারের কারণে শ্বাসনালী ও ফুসফুসের রোগসহ বিভিন্ন রোগব্যধি নিয়ে যে মৃত্যুর পরিমাণ তাও কমে আসবে। একই সাথে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০৪০ সালের মধ্যে তামাকমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার যে ঘোষণা দিয়েছেন সে পথে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে।

সন্দেহ নেই দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থা এবং বৈশ্বিক সমস্ত চ্যালেঞ্জকে সামনে রেখেই প্রধানমন্ত্রী এই লক্ষ্য ঠিক করেছেন। প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার ঘোষণার কারণেই আমরা দেখছি তামাক বিরোধী একটি গণজাগরণও। এ লক্ষ্য সামনে রেখেই সবাই কথা বলছেন। আসলে তামাকের উৎপাদন, ব্যবহার ও বিপণন ধাপে ধাপে কমিয়ে আনতে হলে তামাকের উপর বাড়তি বা আরও করারোপের পাশাপাশি এর আরও কিছু বিষয়ে কাজ করার প্রয়েঅজনীয়তা রয়েছে।

তামাকের সাথে আমাদের কৃষির আবার এক ধরনের নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। দেশে এখনও বৃহৎ পরিসরে তামাক চাষ হলেই বলেই প্রতীয়মান। দেশী বিদেশী বিভিন্ন গবেষণা সংগঠনের তথ্য মতে, বিশ্বে তামাক চাষের জন্যে জমির ব্যবহার হিসেবে বাংলাদেশ ১৪তম দেশ, আর উৎপাদনের পরিমাণ হিসেবে ১২তম অবস্থানে। বিশ্বেও মোট তামাক উৎপাদনের ১.৩% বাংলাদেশে উৎপাদন করা হয়। প্রতিবছরই তামাক চাষের নিবিড়তা বেড়েই চলেছে। অধিক টাকার আসায় চাষীরা দেশী এবং বহুজাতিক কোম্পানীর সহায়তা ও প্ররোচণায় প্রয়োজনীয় খাদ্যশস্যের বদলে তামাক চাষ করছে। বিশেষ করে দেশের চরাঞ্চল এবং দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চলে এই প্রবণতা বেড়েই চলেছে। আগে সমতল বা চরাঞ্চলের একজন প্রান্তিক স্বাবলম্বী কৃষক তার খাদ্য ও পুষ্টি চাহিদা মেটাতে নিজ বা বর্গা জমিতে বৈচিত্র্যময় সব ফসল ফলাতো। কৃষকের বছরওয়ারী একটা নিজস্ব হিসেব থাকতো কোন কোন জমিতে তিনি ধান ফলাবেন এবং একই সাথে বাড়ির আশে পাশের জমিতে কী ধরনের সবজি এবং খরিপ ফসল করবেন। এই চাষবাসের মধ্যে সারাবছরের একটি পঞ্জিকা থাকতো, যেটা অনুসরণ কওে চাষাবাদ করা হতো। কিন্তু হালে চিত্র পাল্টে গেছে। বেশি লাভের আশায় কৃষক প্রায় সব জমিতেই তামাক চাষ করছেন।

এ কারণেই এখন দেখা যাচ্ছে কৃষক যে জমি থেকে তার খাদ্যের সংস্থান করতো সেই কৃষক তামাক চাষের কারণে এখন বাজারমুখী হচ্ছেন। বাজার থেকে তাকে অন্য খাদ্য কিনে খেতে হচ্ছে।এভাবে অনেক গরিব কৃষকের খাদ্যের উৎসও শেষ হয়ে যাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার ২০৪০ সালে তামাক মুক্ত বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্নকে সামনে রেখে এখনই তামাক চাষ বিষয়ে একটি নীতিমালা বা বিধি তৈরির প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। কারণ আমরা যদি এখন থেকেই এই কাজটি শুরু না করি তাহলে তামাকের উৎপাদন কোনোভাবেই কমিয়ে আনতে পারবো না। বিশেষজ্ঞদের মতে, তামাক চাষের কারণে অনেক ফসলি জমিতে খাদ্যশস্য উৎপাদন না করে কৃষকরা এখন তামাক চাষ করছে। চরগুলোতেও এ দৃশ্য বেশি দেখা যাচ্ছে। বিশেষ করে উত্তরাঞ্চলের তিস্তার চরে এই প্রবণতা সবচেয়ে বেশি লক্ষ্যণীয়। তামাকের ক্ষতিকর দিকসমূহ নিয়ে মানুষ অবশ্যই আগের তুলনায় অনেক বেশি সচেতন। কিন্তু তামাকের ব্যবহারে আমরা দেখছি এখনও একটি গোষ্ঠী উদাসীন এবং আইন অমান্য করে চলার প্রবণতা। এতে করে তামাকের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ক্ষতি চলমান রয়েছে। সবাই তামাক গ্রহণ করে না। কেউ কেউ করে। কিন্তু আমরা দেখতে পাচ্ছি এখন অনেকেই পাবলিক প্লেসে ধূমপান করাটাকে সেভাবে অপরাধ মনে করেন না। ছোট ছোট দোকানগুলোতে প্রকাশ্যেই সিগারেট বিক্রি হচ্ছে।

অনেককেই আমরা এখন দেখি রিকসায় বসে সিগারেট খেতে। স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের দেখা যাচ্ছে স্ব স্ব স্কুলের ইউনিফর্ম পড়ে ধূমপান করতে। এ দৃশ্যটি খুবই দৃষ্টিকটু। বর্তমান তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন কতোটা শক্তিশালী ও কার্যকর? নাগরিক সমাজ বহু আগে থেকেই এই আইনকে আরও আরও শক্তিশালীকরণের প্রস্তাব দিয়েছে। ২০০৫ সালে ‘ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ আইন’ প্রণয়ন করা হয়। সেখানে অনেকগুলো সুস্পষ্ট নির্দেশনা ছিল। এরপর সরকারের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় প্রধানমন্ত্রীর তামাক মুক্ত দেশ গড়ার নির্দেশনা এবং তামাক বিরোধীদের কাছ থেকে আসা দাবিগুলোর প্রতি যথাযথ সংবেদনশীলতা দেখিয়ে ‘ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ আইন-২০০৫ (২০১৩ সালে সংশোধিত) সংশোধনের জন্য একটি খসড়া প্রস্তাব করে। এর আগে জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সেল ১৯ জুন ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ)আইন, ২০০৫ (২০১৩ সনে সংশোধিত) এর অধিকতর সংশোধনী আনয়নের লক্ষ্যে প্রস্ততকৃত খসড়ার উপর জনগণ/ স্টেকহোল্ডারদের মতামতের জন্য ওয়েবসাইটে প্রকাশ করে।

এই সংশোধনের মূল লক্ষ্য হলো- আইনটিকে অধিকতর শক্তিশালীকরণ ও বাস্তবায়ন করা। নিঃসন্দেহে সরকারের পক্ষ থেকে গৃহীত উদ্যোগটি প্রশংসনীয় এবং সময়োপযোগী। কিন্তু অধিকতর সংশোধনী যুক্ত আইনটি এখনও পাশ হয়নি। তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের অধিকতর সংশোধনীতে অনেকগুলো বিষয়কে প্রয়োরিটি দেওয়া হয়েছে। ধূমপানের নির্ধারিত স্থান বাতিল, বিক্রয় স্থলে তামাক পণ্যের প্রদর্শন বন্ধ, তামাক কোম্পানীর সিএসআর নিষিদ্ধকরণ, সচিত্র সতর্কবার্তার আকার বৃদ্ধি ইত্যাদি। প্রস্তাবিত সংশোধনীতে ই-সিগারেট সম্পূর্ণ নিষিদ্ধের কথা বলা হয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন টোব্যাকো কন্ট্রোলের (এফসিটিসি)’র অনুচ্ছেদ ৫.২ অনুসারে এতে স্বাক্ষরকারী দেশগুলোর জন্য ইলেক্ট্রনিক নিকোটিন ডেলিভারি সিস্টেম (ইএনডিএস) বা ই সিগারেট উৎপাদন, আমদানী, বিতরণ, বিক্রয় এবং ব্যবহার নিষিদ্ধ করা বাধ্যতামূলক। আমরা এখন দেখতে পাচ্ছি ই সিগারেটের বিপুল ব্যবহার। এই সিগারেট থেকে ধোঁয়া বের হয় কয়েকগুণ বেশি। এটি এখন একেবারেই নিয়ন্ত্রণহীন। এমন সব প্রেক্ষিতে তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার আইনের অধিকতর সংশোধনী খুবই জরুরি। অধিকতর সংশোধনী দ্রুত করা না হলে তামাকের বিরুদ্ধে যে চলমান গণজাগরণ তা থমকে যেতে পারে।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)