দিন দিন উন্নত হচ্ছে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তি। বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাড়ছে এর ব্যাবহার। কর্মক্ষেত্রে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা এআই এর ব্যাপক ব্যাবহার বৃদ্ধির ফলে চাকরি হারাচ্ছে অনেকেই।
বিবিসি সম্প্রতি বিষয়টি নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে বলেছে, এমন কিছু ব্যক্তি শুধুমাত্র কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কারণে চাকরি হারিয়েছেন, যারা কখনও ভাবতেই পারেননি তাদের চাকরি এআই দ্বারা প্রতিস্থাপিত হতে পারে।
কপিরাইটারের চাকরি চলে গেল কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কাছে
ডিন মিডোক্রফট নামক একজন ব্যক্তি একটি মার্কেটিং কোম্পানিতে কপিরাইটারের কাজ করতেন। প্রেস রিলিজ লেখা, সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট দেওয়াসহ কোম্পানির জন্য বিভিন্ন কন্টেন্ট তৈরি করতে হতো তাকে। কিন্তু গত বছর শেষ দিকে তার কোম্পানি আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্স (এআই) ব্যবস্থা চালু করে। প্রাথমিক ভাবে বলা হয়, তাদের সাথে সমান্তরালভাবে কাজ করবে এই ব্যবস্থা। এতে তাদের কাজ সহজ ও দ্রুত হবে।
তবে এআই যেসব কাজ করে দিচ্ছিল তার মান নিয়ে সন্তুষ্ট ছিলেন না মিডোক্রফট। তিনি বলেন, এগুলো ব্যবহার করে সেসব কন্টেন্ট তৈরি হচ্ছিল সেগুলো খুবই সাদামাটা গোছের, সবগুলোই প্রায় একইরকম লাগছিল, ভিন্নধর্মী কিছু বের করা যাচ্ছিলোনা। এআই ব্যবহার করে তৈরি লেখাগুলো আবার আরেকজনকে খুঁটিয়ে দেখতো হতো যেন সেগুলো অন্য কোথাও থেকে হুবহু নকল না হয়।
কিন্তু এআই এর সাহায্যে খুব দ্রুত কাজ হচ্ছিল। যে কপি লিখতে একজন কপিরাইটারের এক থেকে দেড় ঘণ্টা লাগে, এআই দিয়ে তা ১০ মিনিট বা আরো কম সময়ে লেখা যাচ্ছিল। আর তাই এআই চালুর চার মাসের মাথায় মিডোক্রফটের টিমের চার জন সদস্যের চাকরি চলে যায়। মিডোক্রফট শতভাগ নিশ্চিত না হলেও তার দৃঢ় বিশ্বাস এআই এর কারণেই তাদের চাকরি গেছে।
ইউটিউবে ভয়েস ওভার দিচ্ছে এআই
জনপ্রিয় একটি ইউটিউব চ্যানেলে গতবছর তিনমাস ধরে ভয়েস ওভার বা কণ্ঠ দেওয়ার কাজ করছিলেন আলেহান্দ্রো গ্রাও। তিনি ভাবছিলেন এই কাজে ভালো ভবিষ্যৎ রয়েছে। কারণ ইংরেজি ঐ ইউটিউব চ্যানেলের সব কন্টেন্ট স্প্যানিশ ভাষায় তাকে ভয়েস ওভার করতে হতো। গত বছরের শেষদিকে ছুটিতে গিয়ে ফেরার আগেই তিনি দেখলেন ইউটিউব চ্যানেলটি স্প্যানিশ ভাষায় ভয়েসওভার করা একটি নতুন ভিডিও আপলোড করেছে যেটিতে তিনি কণ্ঠ দেননি।
তিনি বলেন, “আমি যখন ঐ ভিডিওতে ক্লিক করলাম, আমি নিজের কণ্ঠ শুনলাম না। যেটা শুনলাম তা হলো এআই দিয়ে তৈরি একটি কণ্ঠ, যদিও তা একেবারেই মূল কণ্ঠের সাথে ঠিকমত মিলছিল না। জঘন্য লাগছিল। আমি হতবাক হয়ে ভাবলাম এই কণ্ঠই কি আমার সহকর্মী হবে? নাকি আমার জায়গা নিয়ে নেবে? আসলে চ্যানেলটি এআই ব্যবহার করে দেখতে চাইছে তা কাজ করে কিনা। কারণ, এতে তাদের কাজ দ্রুত এবং সস্তায় হয়ে যাবে।
তবে সেই নিরীক্ষা কাজ করেনি। দর্শকরা ভয়েস-ওভার নিয়ে অভিযোগ তোলে। ফলে চ্যানেলটি তাদের এআই ব্যবহার করে ভয়েস ওভার করা ভিডিওগুলো প্রত্যাহার করে নেয়। কিন্তু ঐ ঘটনার পর মি. গ্রাওয়ের ভেতরে ভয় ঢুকে যায়। তিনি মনে করছেন, প্রযুক্তির উন্নতি হবে এবং শেষ পর্যন্ত তার মতো ভয়েস-ওভার শিল্পীরা বেকার হয়ে পড়বেন।
কল সেন্টার সেবায় আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্স
সুইডিশ ফার্নিচার জায়ান্ট আইকিয়া তাদের কল সেন্টারের বিলি নামে একটি এআই সিস্টেম চালুর পর তা দিয়েই তাদের কল সেন্টারের ৪৭ শতাংশ কল মানুষের বদলে মেশিন দিয়েই হ্যান্ডল করা সম্ভব হচ্ছে। কিন্তু তারপরও আইকিয়ার কল সেন্টারের কর্মীদের চাকরি যায়নি। এ মাসে তারা জানায় ২০২১ সাল থেকে তারা কল সেন্টারে কর্মরত ৮৫০০ কর্মীকে ছাঁটাই না করে ডিজাইন পরামর্শকের কাজ দিয়ে রেখে দিয়েছে। কিন্তু কোম্পানিগুলো যেভাবে একে একে তাদের কাজে এআই চালু করছে তাতে শ্রমিক-কর্মচারিদের মধ্যে গভীর শঙ্কা তৈরি হয়েছে।
নতুন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বাজারে আনতে প্রতিযোগিতা
এদিকে গত বছর শেষ দিকে ওপেন-এআই কোম্পানি চ্যাট-জিপিটি বাজারে ছাড়ার পর এআই এর ব্যবহার হুহ করে বাড়ছে। মাইক্রোসফটের সাহায্য নিয়ে তৈরি করা চ্যাট-জিপিটি যে কোনো প্রশ্নের উত্তর এমনভাবে দিয়ে দেয় যা দেখে মনে হবে মানুষই বোধ হয় সেই উত্তর লিখছে। অন্যান্য প্রযুক্তি জায়ান্টরাও তাদের নিজস্ব এআই সিস্টেম তৈরির জন্য হুমকি খেয়ে পড়ছে। যেমন, মার্চে গুগল তাদের নিজস্ব এআই সিস্টেম বার্ড বাজারে ছাড়ে।
যদিও একেবারে নিখুঁত নয়, তারপরও এসব এআই সিস্টেম ইন্টারনেটে ছড়িয়ে থাকা অসীম তথ্যভাণ্ডার থেকে প্রয়োজনীয় তথ্যটি বের করে আনতে সক্ষম, যে কাজ কোনো একজন বা একদল মানুষের পক্ষে প্রায় অসম্ভব। আর এ কারণেই এমন ধারণা অমূলক নয় যে কোনো কোনো চাকরি এখন হুমকিতে পড়ে গেছে।
এ বছরের গোড়ার দিকে আর্থিক প্রতিষ্ঠান গোল্ডম্যান স্যাকসের একটি রিপোর্টে বলা হয় আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের কারণে পূর্ণকালীন কাজ করছে এমন ৩০ কোটি মানুষ বেকার হয়ে যেতে পারে। তবে অর্থনীতির সব খাতে এটির প্রভাব সমানভাবে পড়বেনা। গোল্ডম্যান স্যাকসের ঐ রিপোর্টে আরো বলা হয়, এআই দিয়ে উৎপাদনশীলতা এবং সেইসাথে প্রবৃদ্ধি বাড়বে, ফলে নতুন নতুন কাজের সুযোগ তৈরি হবে।