বিশ্ব বাঘ দিবস আজ। সুন্দরবন ছাড়া বাংলাদেশে বাঘের অবাধ বিচরণ ভূমি আর নেই। সুন্দরবনের বাঘও এখন বিলুপ্তির পথে। এখন দরকার দেশের মধ্যে বাঘের নতুন অভরাণ্যর সন্ধান। পৃথিবীতে যেসব এলাকায় বাঘ টিকে আছে, তার মধ্যে সুন্দরবনকে বাঘবিজ্ঞানীরা একটি গুরুত্বপূর্ণ আবাস হিসেবে বিবেচনা করেন। সুন্দরবনের আয়তন ও বাঘের সংখ্যা বিবেচনায় পৃথিবীর পাঁচটি আবাসের মধ্যে অন্যতম।
বাংলাদেশের জন্য সর্বশেষ ভরসার জায়গা। সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী পুরো সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা ২১০, এর মধ্যে বাংলাদেশ অংশে আছে ১১৪টি। বাঘ ও বাঘের খাদ্য-প্রাণীর নির্বিচার শিকার ও মানুষের বসতবাড়ি তৈরিতে বনাঞ্চল ধ্বংস হওয়ায় এসব এলাকা থেকে বাঘ আজ বিলুপ্ত। সুন্দরবনে বাঘ টিকে আছে নানা প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে। এক সময় সুন্দরবনের আয়তন ছিল বর্তমান সুন্দরবনের দ্বিগুণ। মোগল ও ব্রিটিশ শাসকেরা প্রণোদনার মাধ্যমে বঙ্গের নানা এলাকার মানুষকে সুন্দরবনের জঙ্গল পরিষ্কার করে ধানের আবাদে নিযুক্ত করে। উত্তর দিক থেকে সুন্দরবন কাটা শুরু হয়। কোনো উপায় না পেয়ে বাঘ সুন্দরবনের দক্ষিণে দিকে সরতে থাকে। ১৯৭৩ সালে বাঘ হত্যা নিষিদ্ধ করা হলে বিলুপ্তির হাত থেকে বেঁচে যায়।
জলবায়ু পরিবর্তনজনিত চরম ঝুঁকির মধ্যে আছে সুন্দরবন। বিশেষ করে কচিখালী, কটকা, দুবলা, হিরণ পয়েন্ট ও মান্দারবাড়িয়া এলাকার গাছপালা ও বনভূমি বিলীন হচ্ছে আশঙ্কাজনক হারে। এসব এলাকার নদীর দুই পাড় ভেঙে বিলীন হচ্ছে বনভূমি। গত বছরের ডিসেম্বর মাসে বয়ে যাওয়া ঘূর্ণিঝড় জাওয়াদের সময় সুন্দরবনের ভূমিতল জোয়ারের পানিতে নিমজ্জিত ছিল দীর্ঘ সময়। ওই সময় স্থলচর স্তন্যপায়ী, যেমন: বাঘ, হরিণ, বুনো শুয়োরের কী অবস্থা হয়েছিল, আমরা ধারণা করতে পারি। এ কারণে ভবিষ্যতে সুন্দরবন বাঘের জন্য একটি অনিরাপদ আবাসে পরিণত হবে বলে আমরা মনে করি। সুতরাং গর্বের জায়গাটি জারি রাখতে হলে আমাদের এখনই প্রস্তুতিমূলক পদক্ষেপ নিতে হবে।
বিজ্ঞানীরা পৃথিবীতে ৩৬টি জীববৈচিত্র্যসমৃদ্ধ এলাকা চিহ্নিত করেছেন। এলাকাগুলোর নাম দেওয়া হয়েছে বায়োডাইভারসিটি হটস্পট। এর মধ্যে আমাদের পার্বত্য চট্টগ্রামের তিনটি জেলার অধিকাংশ এলাকা ইন্দো-বার্মা বায়োডাইভারসিটি হটস্পটের আওতাধীন। এ ছাড়া পার্বত্য এলাকাটি ‘নামদাফা-রয়্যাল মানাস গ্লোবাল প্রায়োরিটি টাইগার কনজারভেশন ল্যান্ডস্পেপ’-এর আওতাভুক্ত। ২০০৬ সালে পৃথিবীতে বাঘের বিচরণকৃত এলাকার মধ্যে পার্বত্য অঞ্চল ‘টাইগার রেস্টোরেশন ল্যান্ডস্কেপ’ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। অর্থাৎ এই এলাকা একসময় বাঘের আবাসভূমি ছিল বা এখনও আছে। বাংলাদেশ বাঘ সংরক্ষণ কর্মপরিকল্পনাতেও পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঘের আবাস নিশ্চিত করার কথা বলা আছে। খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার উত্তর-পূর্ব এলাকার কাসালঙ সংরক্ষিত বন তুলনামূলকভাবে এখনও অক্ষত। নানা প্রজাতির গাছপালা, পাহাড়-নদী-ছড়াসমৃদ্ধ ভূমির কারণে এ এলাকায় এখনও বিরল প্রজাতির নানা বুনো প্রাণী টিকে আছে। আছে স্থলভাগের সবচেয়ে বড় প্রাণী এশীয় হাতি, দুই প্রজাতির ভালুক, তিন প্রজাতির হরিণ, চিতা, লামচিতা, সোনালি বিড়াল, বুনো শুয়োর, বনগরু, বনছাগলসহ বৃহদাকার নানা স্তন্যপায়ী প্রাণী। প্রাথমিক কিছু গবেষণা থেকে কাসালং বনে বাঘ থাকার উপযোগী পরিবেশ আছে—এমন ইঙ্গিত পাওয়া যায়।
চিরসবুজ নিবিড় বনাঞ্চল ছাড়াও কাসালং সংরক্ষিত বনের চারপাশে রয়েছে খণ্ড খণ্ড পাহাড়ি বন। ক্রমবর্ধমান মানুষের বসতবাড়ি ও চাষাবাদের থাবা থেকে কাসালং এখনও মুক্ত। বাঘের উপস্থিতিও অসম্ভব নয়। কাসালঙ সংরক্ষিত বনের আয়তন আনুমানিক ১ হাজার ৬৪৫ বর্গকিলোমিটার। ভারতীয় উপমহাদেশে পুরুষ ও স্ত্রী বাঘের বিচরণ এলাকা বিবেচনায় নিলে কাসালং বনে ১৫ থেকে ২০টি বাঘ থাকতে পারবে বলে ধারণা করা যায়।
সুন্দরবন যেহেতু দিন দিন বাঘের জন্য হুমকি হয়ে উঠছে। সেহেতু বাংলাদেশের গর্ব বাংলার বাঘকে বাঁচাতে নতুন আবাসস্থলের সন্ধান করতে হবে। গবেষণায় উঠে এসেছে পাবর্ত্য অঞ্চলের কাসালঙ এলাকার কথা। সুতরাং আমাদের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নতুন এই অঞ্চলটিকে বাঘের নিরাপদ আবাস হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে। অন্যথায় বড় বড় বুলি দিয়ে বাংলাদেশ থেকে বাঘ বিলুপ্তি রোধ করা যাবে না।