ফারুক, পুরো নাম আকবর হোসেন পাঠান। যেহেতু তিনি নায়ক তাই পুরো নাম অনেকদিন আগেই হারিয়ে গিয়েছিল। পরিচিত হয়েছিলেন নায়ক ফারুক হিসেবে। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে সিনেমায় অভিনয় করেছেন। ‘৭৫ এ পেয়েছেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পরপর অনেকগুলো দারুণ ছবি হয়। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর সুজন সখীর সেই বিখ্যাত গান ‘সব সখীরে পার করিতে নেব আনা আনা’ মানুষের মুখে মুখে গীত হয়। সব ছবিতেই ফারুককে দেখলে মনে হতো একটু নেতা গোছের মানুষ। মাতব্বর গোছের মানুষ। যেখানেই বসবেন সেখানেই নেতৃত্ব দেবেন। সারেং বউয়ের ‘ওরে নীল দরিয়া’ গানটির স্বাপ্নিক পিকচারাইজ হওয়া সত্ত্বেও মনে হয় যে ফারুক গান গাইছেন, সেই ফারুক একজন নেতা। পরবর্তী সময়ে যখন তার কাছাকাছি থেকে কাজ করেছি তখন দেখেছি সত্যি তিনি নায়ক।
বঙ্গবন্ধু শতবর্ষ উদযাপন কমিটির একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছিলেন তিনি। তখন দেখেছি, তার অনুজ প্রতীম নায়ক সহকর্মীরা তাকে ডাকতেন ‘মিয়া ভাই’ বলে। শুনেছি, বহুদিন ধরে বহুজনে তাকে এই নামে ডাকে। তাতে মনে হয়েছে ছবি দেখে যে নায়ককে ভেবেছি, তিনি যেখানে থাকেন সেখানে নেতৃত্ব দেন। ফারুকের আরেকটি ডাক নাম ছিল। রেগে গেলে এই নামটা তিনি ব্যবহার করতেন। বলতেন, দুলুকে এসব কথা বলে মানাতে পারবেন না। দুলু সব বোঝে। সব জানে।
আর যে বিষয়ে একবার তিনি না করতেন, সেটা ‘হা’ করানো খুব কঠিন ছিল। তবে সব মিটিং-এ আমি দেখেছি তিনি চলচ্চিত্র জগতের বিভিন্ন জনকে নিয়ে কথা বলতে পছন্দ করতেন। মিটিং এ ঠিক সময় আসতেন এবং মতের মিল না হলে রাগ করে মিটিং শেষ হওয়ার আগেই চলে যেতেন।
তার সঙ্গে আমার সরাসরি তখনও আলাপ হয়নি। দেখলাম ‘সাপ্তাহিক ২০০০’এ এক সাক্ষাৎকারে তিনি প্রচন্ড ক্ষিপ্ত হয়ে বলেছেন, এখন নাকি ইন্ডাসট্রিতে বহু ছবি বানায় ইমপ্রেস টেলিফিল্ম। কেন বানায়, কী বানায় আমি জানি না। কিন্তু সত্যি যদি তারা ভালো ছবি বানাতো বা ইন্ডাসট্রির উন্নতি চাইতো তাহলে তো তারা আমার বা আমাদের মতো মানুষের কাছে আসতো। কত বাজেট না বলে বলতো, একটা ভালো ছবি বানিয়ে দিন। বাজেট নিয়ে ভাববেন না। তাহলেই তো সারেং বউ বা লাঠিয়ালের মতো ছবি তৈরি হবে।
যে সাংবাদিককে ফারুক এই সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন আমি তাকে বলেছিলাম, ফারুক ভাইয়ের এই বক্তব্যের সাথে আমাদের বক্তব্যও নেয়া উচিৎ ছিল। সেটা যখন নাওনি তখন ফারুক ভাইকে নিয়ে একদিন অফিসে এসো। সেবার ফারুক ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হয়নি। দেখা হয়েছিল হজ্ব করতে গিয়ে।
ফারুক ভাই, ভাবী ও তার পরিবার সবাই মিলে হজ্বে গিয়েছিলেন। মক্কা শরিফ থেকে হজ্বে যাওয়ার সময় অনেকেই তাদের যাত্রার গাড়ি মিস করেন। নানা কারণে আমি, কণা, ফারুক ভাইয়ের পরিবারসহ আরও কয়েকটি পরিবার যার মধ্যে ছিলেন বিএনপি নেতা মির্জা আব্বাস, রোকাইয়া আফজাল রহমান এরকম অনেকেই। সবাই মিলে গাড়িতে যেতে না পেরে ভেবেছিলেন এবারের হজ্ব বোধ হয় করাই হবে না। কিন্তু অলৌকিকভাবেই হঠাৎ সব ব্যবস্থা হয়ে গেল। আমরা পৌঁছে গেলাম আরাফাত ময়দানে। সবাই এক জায়গায়। দুপুরের খাবার খেলাম। নামাজ আদায় করলাম।
তারপর থাকার কথা উঠতেই ফারুক ভাই বললেন, আমি বাংলাদেশের তাঁবুতে যাবো। সেখানেই পরিবার নিয়ে থাকবো। কিন্তু এখন কি আপনি জায়গা পাবেন? ভাই সেটা তো আল্লাহর ইচ্ছা। কিন্তু নিয়ত করে এসেছি আরাফাতের ময়দানে আমার দেশের মানুষের সঙ্গে থাকবো। দেখি আল্লাহ কী ব্যবস্থা করেন। তারপর নির্বিকারভাবে হেঁটেে চলে গেলেন ভাবী ও সন্তানদের নিয়ে। পরে শুনেছি খুব ভালোভাবে পরিবার নিয়ে হজ্ব করে দেশে ফিরেছেন।
এরপর বিভিন্ন সময়ে নানা জায়গায় ফারুক ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হয়েছে। চ্যানেল আইতেও অনেকবার এসেছেন সাক্ষাৎকার দিতে। শুনেছিলেন আমার কিডনি জটিলতার কথা। বলেছিলেন, তারও কিডনি জটিলতা আছে। বলেছিলেন সিঙ্গাপুরে তার পরিচিত এক বিখ্যাত ডাক্তার আছেন। তার কাছে নিয়ে যাবেন ‘ছোট ভাই’ হিসেবে পরিচয় দিয়ে। তাহলে ডাক্তার আমার সুচিকিৎসা করবেন। এরপর যতবারই দেখা হয়েছে, আগ বাড়িয়ে আমার খোঁজখবর নিতেন তিনি। পরামর্শ দিতেন। ডাক্তার লি এর কার্ডও দেন আমাকে। তার সঙ্গে যেন আমি যোগাযোগ করি।
ফারুক ভাই আর ববিতা আপা জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে আজীবন তাদের স্বীকৃতিস্বরূপ পুরস্কার পেয়েছিলেন। অনুষ্ঠানটি কিছুক্ষণ দেরিতে শুরু হওয়ায় পরে সংক্ষিপ্ত করতে হয়। সংক্ষিপ্ত করার কারণে পুরষ্কারপ্রাপ্ত দুজনের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করার কথা। ফারুক ভাইকে গম্ভীরভাবে বসে থাকতে দেখলাম। ববিতা আপাকে দেখলাম ছটফট করতে। বললাম, ‘ববিতা আপা আপনি কিছু কি বলতে চান?’ ‘হ্যাঁ তৈরি হয়ে এসেছিলাম। তবে আমি না বললেও হবে। ফারুক ভাই বললেই হবে।’
আমি বললাম, চলুন আপনাকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে নিয়ে যাই। তখন সবাই মঞ্চে। ববিতা আপাকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে নিয়ে গেলাম। প্রধানমন্ত্রী বললেন, কিছু বলবে? ববিতা আপা বললেন, আমি কিছু বলতে চাই। বিচক্ষণ প্রধানমন্ত্রী সঙ্গে সঙ্গে পুরো ব্যাপারটা বুঝে গেলেন। প্রধানমন্ত্রী বললেন, আমি তথ্যসচিবকে বলে দিচ্ছি। ববিতা বক্তৃতা দিলেন। ফারুক ভাই লম্বা কাগজ নিয়ে বিশাল এক বক্তৃতা দিলেন। বক্তৃতায় তিনি স্পষ্ট বলে ফেললেন, রাজনীতি করার ইচ্ছার কথা।
তারপরের ফলাফল আমাদের সবার জানা। ঢাকা ১৭ আসনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ থেকে সংসদ সদস্য পদে মনোনয়ন পেলেন ফারুক ভাই। জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে গেলেন শুধু ‘নেতা’। ফারুক ভাই খুব মনের জোরে চেষ্টা করেছেন সিঙ্গাপুর থেকে সুস্থ হয়ে জনগণের মাঝে ফিরে আসার জন্য। গত বছর চ্যানেল আইকে জন্মদিনে কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেছিলেন, আমি আপনাদের মাঝে ফিরে আসতে চাই।
আকবর হোসেন পাঠান সিঙ্গাপুর থেকে ফিরে আসছেন। জনগণ ফিরে পাবে তাদের প্রিয় নায়ককে। কিংবা রাজনৈতিক নেতাকে। তার আরও অনেক কিছু করার স্বপ্ন ছিল। ঢাকা শহরে যার বাড়ির নাম ‘সারেং বাড়ি’।