চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Nagod

মুখোশপরা পাঠশালা: বোধের এক উদোম জমিন

মুখোশপরা পাঠশালা কবিতাগ্রন্থে উন্মোচিত রয়েছে সমাজের গভীর ক্ষয় ও ক্ষরণ। এ ক্ষরণের এক নিংসঙ্গ বংশীবাদক কবি ইমরান মাহফুজ। সমকালীন সমাজবাস্তবতা বিনির্মাণে তিনি বিশেষ মাধুর্য দেখিয়েছেন।

মুখোশ মানেই নকল বা ফেইক। একটি সমাজ কীভাবে মৌলিকত্ব বা নৈতিকতা ছেড়ে মুখোশীকরণ প্রকল্পের আওতায় এসে পড়লো তার ঋদ্ধ বিবৃত্তি উঠে এসেছে এ কবিতা সংকলনে।
কবি ইমরান মাহফুজ বুঝেশুনে কবিতায় শক্র চিহ্নিত করেছেন। ঝুঁকি নিয়েছেন। এটি তাঁর সচেতন অবস্থান। বিদ্যমান সমাজ, রাষ্ট্র ও রাজনীতি তাঁর কবিতার প্রতিপক্ষ। এখানেই কবির দায় ধরা পড়ে। কবি ইমরান মাহফুজ দায়নিরপেক্ষ সত্ত্বা নন। সমাজের ক্লেদের বার্তা জনপরিসরে ছড়িয়ে দিতে তিনি কবিতা নিয়ে মাঠে নেমেছেন। বাংলার কবিচর্চার ইতিহাসের এটিই শানেনূযুল। কবিরা দিনশেষে মানুষের পক্ষে দাঁড়িয়ে যান। নিপীড়নমূলক কর্তৃত্ববাদী অবস্থান অস্বীকার করেন, তা করেন শব্দবানে আর তীর্যকবাক্য। কবি ইমরান মাহফুজ এ ধারার সমকালীন সংযোজন।
তাঁর কবিতার ভাষা সহজ-সরল। সহজ কবি তিনি, ইঙ্গিতময় নন। উপমার বিশেষ ছাড়াছড়ি নেই কবিতায়। চিত্রকল্প ঝকঝকে। বাক্যগুলো বুলেটের তিব্র ও তীক্ষ্ম, নিশানভেদী। অসংখ্য মানুষের অব্যক্ষ ভাবের সমষ্টি হলো মুখোশপরা পাঠশালা কবিতাসমগ্র। হাজারো মানুষের বাক নিজের কণ্ঠে তুলতে পারা সহজ কাজ নয়। কবি তা করেছেন নিপুণ হাতে।
কবিরা হন অন্তরভেদী। ঢুকে পড়তে হয় সমাজের অন্তঃস্রোতে। অবগাহন করতে হ, বাস করতে হয়। তুলে আনতে হয় জীবনের নির্যাস। কবি ইমরান মাহফুজ সমাজ সেচে ক্লেদের সৌঁধ গড়েছেন। এ ক্লেদ পীড়া দেয়। তবে এ পীড়া এক ধরনের সুখের উপলক্ষ্যও বটে। যেকোনো পরিস্থিতি নির্মোহভাবে দেখতে পারার ভেতর এক বিশেষ সুখ রয়েছে । যাকে বলা যায় বেদনাহৃত সুখ। মুখোশপরা পাঠশালা বেদনাহৃত সুখের এক স্মারক অভিব্যক্তি।
কবিতাগুলো বর্গীকরণ করলে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যায়-উৎসনিবিড়তা বা মা সংলগ্নতা, স্মৃতিকাতরতা, উৎকণ্ঠা ও প্রশ্ন, রাজনীতি, রাষ্ট্র, গণতন্ত্র, শিক্ষাসংকট, মহানগর ঢাকা, উন্নয়ন, প্রেম, শান্তি, বাঙালিত্ব, বৈষম্য, পাখি, আকাশ, নদী ও নারী।
কবি নতুন শব্দ প্রয়োগে বিশেষ মুনশিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন। একেকটি শব্দ হয়ে উঠছে হাজার শব্দের প্রতিনিধি। যেমন- কবি সাদা কালো বুদ্ধিজীবীর ঢাকা কবিতার শেষের অনুচ্ছেদে লিখেছেন- ‘‘সরকারি গণতন্ত্র! গণশিক্ষা ও গণমাধ্যমে বেকার মূল্যবোধ, চায়ের কাপে বিবর্ণ ঠোঁটের পরশে উন্নয়নের ধোঁয়া- সাদাকালো বুদ্ধিজীবীরা যেকোনো গল্প করে জায়েজ, তখনই স্বাপ্নিক-সরলপথ ভুলে ঢুকে মুখোশপরা পাঠশালায়।”
জনগণ সরকারি গণতন্ত্রের দীর্ঘছায়ার নিচে বাস করতে বাধ্য হচ্ছে সেই বিবৃতি কবির ভাষ্যে আসছে সসাহসে। শিক্ষা ক্ষেত্রে এবং গণমাধ্যমে সবার যে চরিত্রগত স্খলন ঘঠেছে তা বলতে কবির নেই কোনো দ্বিধা। সরকারি গণতন্ত্রের কালো ছায়ার নিচে পালিত সাদাকালো বুদ্ধিজীবীরা যে রাষ্ট্রীয় যেকোনো উৎপাদ জায়েজ করতে সনদ বিতরণ করছেন তাও কবির চোখ এড়িয়ে যায়নি। কবি সিদ্ধান্ত দিচ্ছেন-‘‘এমন পরিস্থিতিতে আগামীর প্রজন্ম স্বপ্নভুলে মুখোশপরা পাঠশালায় ঢুকে পরছে”।
মুখোশপরা পাঠশালা নির্দিষ্ট কোনো শিক্ষায়তন নয়। গোটা সমাজ মুখোশপরা পাঠশালায় পরিণত হয়েছে। সমাজ কীভাবে মুখোশজীবীতা দীক্ষায়ন পারঙ্গম হয়ে উঠলো-তার নিপাট বুননের সমষ্টি মুখোশপরা পাঠশালা। এটিই হলো পোস্টটুথ পরিস্থিতি যেখানে ব্যক্তি ফ্যাক্টস নয় ফিকশনে বিশ্বাস করে। অপ্রিয় সত্য নয় প্রিয় মিথ্যা শুনতে অভ্যস্ত হয়ে উঠে।
কবি শুয়োর চরিত্রে রাজনীতি কবিতায় ‘স্বৌরাচার উন্নয়ন’ দুটো শব্দযুগল প্রয়োগ করেছেন। নির্বিচার উন্নয়ন তো স্বৌরাচার উন্নয়নই বটেই। রাষ্ট্র প্রকল্পনির্ভর এক নিদারুণ পরিস্থিতি তৈরি করেছে। প্রকল্পনির্ভর উন্নয়ন স্বৌরাচার উন্নয়নের শক্ত পাঠাতন তৈরি করেছে। এ উন্নয়নের রয়েছে বিস্তর রাজনৈতিক অর্থনীতি। ‘স্বৌরাচার উন্নয়ন’শব্দদ্বয়ের তীর্ষক প্রয়োগ সমকালীন রাষ্ট্রচর্চিত উন্নয়ন ডিসকোর্সে হয়ত কালো শব্দ হিসেবে তালিকাভুক্তির আশঙ্কা রয়েছে।
প্রিয়, হারিয়ে যাই জল্লাদের শহর ছেড়ে এ কবিতায় কেন্দ্রিয়চরিত্র ঢাকা শহর। ঢাকা শহরের সমকালীন রুগ্ন শরীর ও মন পুরোটাই ধরা পড়েছে এ কবিতায়। কবি লিখেছেন-‘‘নিম্ন-মধ্যবিত্ত ছাড়াও ঢাকায় আশ্রয় নিচ্ছে অবোধ লোক, মরিয়া জনতা, হিংস্র নেতা, সহায় ভিখারি-অসহায় মানুষ। …বাতাস নেই, নেই বিশুদ্ধ পানি-সবুজহীন জল্লাদের শহর। হতভাগ্যরা উন্নয়ন দেখে মরতে পারে না! আরেক কবিতায় কবি লিখছেন-‘‘মানুষ বাঁচুক কিংবা মরুক এ নীতিতে চলছে উন্নয়ন। রাষ্ট্রে একদিন মানুষ থাকবে না হয়ত থাকবে অমানুষের ইতিহাস।’’
কী অসামান্য এক উপসংহার টেনেছেন কবি এ কবিতায়-‘‘যে শহরে কবি ও কাক অসুস্থ, সে শহর বাসযোগ্য নয়।”ঢাকা মহানগরের বৈষম্য ধরা পড়েছে বেদনার্ত গল্প কবিতা হয়। কবি লিখেছেন- ‘‘কারখানায় ফ্রাই হচ্ছে উচ্চশিক্ষিত যুবক। বেঁচে থাকার সেতার পিষে দিচ্ছে টয়োটার চাকা। চাকরির আশায় যুবতী বিলিয়ে দেয় পুষ্পরেণু।. . . উচ্চবিত্তের পায়ের তলায় মাংস রেখে নিন্মবিত্তর কাঠামো হেঁটে যায়।”
কবির ভেতর রয়েছে এক দ্রোহী সত্ত্বা। যার সন্ধান মেলে অসহায় দেশে করোনা কবিতায়। কবির জবান হলো ‘‘বোহেমিয়ান রাষ্ট্র ব্যবস্থায় বিলুপ্ত প্রায় সমালোচনা, কবি ও কাক সদা ব্যস্ত হাহাকারে। বুদ্ধিও রাজনীতি কেবল প্রশংসার। রাতের বয়স বাড়লে ভাড়া বাড়ে পুলিশের।…নিঃসঙ্গ যুবক হস্তমৈথুন করলেও রাষ্ট্র হাঁকে রাজস্ব।”
কবি গণতন্ত্রকামী। গণতন্ত্রহীনতা কবিকে বিক্ষুদ্ধ করে। গণতন্ত্র এক কৌতুকের নাম-কবিতায় কয়েকটি লাইন হলো-‘‘গণতন্ত্র বাঁধা পড়েছে গাভীর উদরে, বুদ্ধিজীবী যায় না যুক্তিবিদ্যার ঘরে-. . .নতমুখীচোখে রাষ্ট্রপতি ঘুমান নীতিহীন কেদারায়। . . .প্রশংসার দেশে গণতন্ত্র এক কৌতুকের নাম। বুকে আমার আগুন জ্বলে কবিতায় তিনি আরও লিখছেন- গ্রামগুলো সব হারিয়ে গেছে, আশা কোথায় তবে? গণতন্ত্র আজ নির্বাসনে জানিস ফিরবে কবে?’’
দেশের শিক্ষা সংকট কবিকে ভাবিয়েছে গভীরভাবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষা ও নীতিহীনতায় কবি দারুণ ক্ষুদ্ধ। তিনি স্টুপিড শিক্ষকের তা-ব কবিতায় প্রশ্ন তুলেছেন- ‘‘কতগুলো স্বপ্ন হত্যা করলে একজন অধ্যাপক ভিসি হন? হুজুর কেবলা কবিতায় বলেছেন-বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষক, সাংবাদিক ও দলের নেতা-অধিকাংশ শয়তান। কখনো ধর্ম বা কখনো স্বাধীনতাতে মুখোশ হিসেবে করছে বছরের পর বছর।’’
খুব সহজে পাঠকের মন ও মগজে ঢুকতে চান কবি। কিন্তু সমাজ উপজাত যে ক্লেদ কবির হৃদয়ে জমেছে তা প্রকাশ সহজ নয়। এ ক্ষেত্রে তিনি স্ল্যাং ল্যাঙ্গুয়েজের আশ্রয় নিয়েছেন। বলা হয় স্ল্যাং ল্যাঙ্গুয়েজ একটি পরিস্থিতির সমগ্রপ্রকাশ। ইমরান মাহফুজের কবিতায় স্ল্যাঙের প্রভাব রয়েছে। একটি অসংস্কৃত পরিস্থিতি তুলে ধরতে রুচিশীল শব্দের প্রয়োগ একমাত্র অবলম্বন নয়। স্ল্যাং সমাজ উপজাত এক বিশেষ ভাষা। কবির কবিতায় পুরুষাঙ্গ, অন্ডকোষ, বোকাচোদা, হারামজাদা, কুত্তার বাচ্চা, শুয়োর ইত্যাদি শব্দ এসেছে বার কয়েক।
কৃষক জমিনের বুক চিরে যেমন সম্ভাবনা বীজ বপন করেন কবি ইমরান মাহফুজের কবিতা বুননে কৃষককৌশল লক্ষ করা যায়। তিনি পাঠকের অন্তরে থরেথরে গেঁথে দিয়েছেন কবিতার বিন্যাস। বহুমাত্রিক কবিতার বীজ ধারণ করেই তিনি পূর্ণগর্ভবতী কবি হয়ে উঠেছে। কবিরা যে পূর্ণগর্ভবতী হতে পারেন তা এক চল প্রতীক। সমাজ নামে কিছুটা অধরা পুরুষ তাঁর প্রজননের মূলক্ষেত্র। সুক্ষ্মবোধের কবি ইমরাম মাহফুজ। বোধের এক উদোম জমিনের মহাজন। তিনি সমকালীন ও অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক।
কবিতাগ্রন্থটি উৎসর্গ করেছেন- মহামান্য ফ্যাসিবাদ, প্রশংসার দেশে প্রশ্নহীন সমাজ গড়তে অসামান্য ভূমিকা রাখায় নিরন্তর প্রণাম। কবিতাগ্রন্থে নেন কোনো সূচিপত্র। সূচিপত্রের অংশে লেখা হয়েছে- রক্তের সংবিধান যেথায় উপেক্ষিত কাব্যসূচি সেথায় অমূলক। কবি নিয়ত সৃজনশীল। কবিতাগ্রন্থটি প্রকাশ করেছে ঐতিহ্য। অমর একশের বইমেলায় ঐতিহ্যের স্টলে মুখোশপরা পাঠশালা কবিতাগ্রন্থটি পাওয়া যাবে।

Labaid
BSH
Bellow Post-Green View