আসন্ন ঈদুল ফিতরে বড় বাজেটের বেশ কিছু ছবি মুক্তির খবর শোনা যাচ্ছে। ইতোমধ্যে গলুই, বিদ্রোহী ও শান নামে তিন ছবির হল বুকিংও শুরু হয়েছে। প্রথমসারীর তারকাদের ছবিগুলো মুক্তির মিছিলে থাকায় আগামী ঈদকে ‘সিনেমার ঘুরে দাঁড়ানোর মৌসুম’ মনে করছেন চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্টরা।
গলুই, বিদ্রোহী, শান ছাড়াও ঈদে মুক্তির মিছিলে আরও আছে পাপ-পুণ্য, প্রেম প্রীতির বন্ধন, বৃদ্ধাশ্রম, ক্যাসিনো, রিভেঞ্জ, মিশন এক্সট্রিম-২, ওস্তাদ। বহুদিন পর সিনেমা মুক্তি নিয়ে দর্শকের মধ্যে এমন উৎসবের আমেজ বিরাজ করলেও সিনেমা প্রদর্শন ও বিপণনের সঙ্গে জড়িতদের ‘শঙ্কা’ অন্যখানে! তাদের প্রশ্ন, এতো বড় বড় বাজেটের ছবিগুলো আসলে চলবে কোথায়?
সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, চলচ্চিত্র দেখার জন্য বড় পর্দার (সিনেমা হল) কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু দেশে একের পর এক প্রেক্ষাগৃহ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সিনেমা চালানোর জায়গা কমে এসেছে।
এর মধ্যেই বরগুনা, পিরোজপুর, মুন্সিগঞ্জ, নরসিংদী, নড়াইল, বাগেরহাট, শেরপুরসহ দেশের ২০টির মতো জেলা সদরের সব প্রেক্ষাগৃহ বন্ধ হয়ে গেছে। করোনাকালে এই অবস্থা আরও নাজুক হয়েছে। দেশের অনেক বড় বড় সিনেমা হল চিরতরে বন্ধ হয়ে গেছে।

ঢাকার অভিসার, জোনাকি, সিরাজগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী সাগরিকা, শেরপুরের কাকলী, রাজশাহীর উপহার, রাজমণি, রাজিয়াসহ দেশের অনেকগুলো প্রেক্ষাগৃহ বন্ধ হয়ে গেছে। প্রেক্ষাগৃহ মালিকদের সংগঠন প্রদর্শক সমিতি জানিয়েছে, করোনার পর কিছু বন্ধ সিনেমা হল আবার চালু হয়েছে।
প্রদর্শক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আওলাদ হোসেন চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, এই সপ্তাহে ১০০-এর কাছাকাছি হল চালু আছে। আগামী ঈদের জন্য ১৪৬টি হল প্রস্তুত আছে। এই সংখ্যা ২০০-এর কাছাকাছি গিয়ে দাঁড়াবে। আমরা অধীরভাবে অপেক্ষা করছি ঈদে সিনেমার ব্যবসার জন্য। কারণ, করোনায় গত দুই বছর আমাদের এই সেক্টর একেবারে পঙ্গু করে দিয়েছে।
অথচ এক যুগ আগেও দেশে প্রেক্ষাগৃহের সংখ্যা ছিল প্রায় হাজার খানেক। বছর তিনেক আগেও এ সংখ্যা ছিল প্রায় তিনশোর মতো।
চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করেন, দিনকে দিন হল কমতে থাকা চলচ্চিত্রের জন্য একটি অশনি সংকেত। তবে হল কমার কারণ উল্লেখ করে প্রদর্শক সমিতি জানায়, মানসম্মত ছবির অভাবে হলে দর্শক আসে না। যাদের ছবির দর্শক বেশি হয় তাদের ছবি কম মুক্তি পায়। এভাবে চলতে থাকলে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে প্রায় সব এক পর্দার প্রেক্ষাগৃহ বন্ধ হয়ে যেতে পারে।
প্রদর্শক সমিতি, নামী তারকা ও একাধিক শিল্পীরা জানান, মাঝেমাঝে ভালো ভালো ছবি মুক্তি পেলেও প্রচারণার অভাবে আড়ালে চলে যায়। দর্শকদের যদি সিনেমা দেখার প্রতি আগ্রহী না করা হয় তাহলে তারা এতো বিকল্প থাকা সত্ত্বে নিজ উদ্যোগে সিনেমা হলে যেতে কেন আগ্রহী হবেন?
প্রদর্শক সমিতির সাধারণ সম্পাদক বলছেন, সম্প্রতি কয়েকটি নতুন ছবি মুক্তি পেলেও সেভাবে দর্শক টানতে পারেনি। এরমধ্যে ‘শ্বশুড়বাড়ি জিন্দাবাদ-২’ কিছু কিছু হলে তুলনামূলক ভালো ছিল। অন্য ছবিগুলো মুক্তির দুদিনের মাথায় মুখ থুবড়ে পড়ে। ওইসব নতুন ছবির চেয়েও শাকিব খানের পাঁচ-দশ বছর আগের ছবিগুলোতে দর্শক বেশি হয়। তাই তার পুরাতন ছবি বেশি চলছে।
এদিকে, গত কয়েক বছরে বেড়েছে সিনেপ্লেক্স ও মাল্টিপ্লেক্সের সংখ্যা। তবে এই আধুনিক সিনে থিয়েটারের সংখ্যা বাড়লেও সেসব জায়গায় বাংলা ছবি প্রদর্শনের আগ্রহ কম দেখা যায়। অন্যদিকে ঢাকার আশপাশ ও মফঃস্বলে এক পর্দার বেশির ভাগ প্রেক্ষাগৃহে সিনেমা দেখার পরিবেশ নেই।
তবে সুখবর হচ্ছে, আগামী ঈদে পুরান ঢাকার বাবু বাজার ব্রিজ সংলগ্ন কেরানীগঞ্জে চালু হতে যাচ্ছে নতুন মাল্টিপ্লেক্স ‘জয় লায়ন সিনেমাস’। বঙ্গ-এর পক্ষ থেকে মুশফিক রহমান চ্যানেল আই অনলাইনকে জানান, ৪টি স্ক্রিনে ৮০০ সিটের মাল্টিপ্লেক্সটি পুরোপুরি প্রস্তুত। আগামী ঈদে চালু হবে।
রাঙা বউ, অবুঝ হৃদয়, নাম্বার ওয়ান শাকিব খানসহ অসংখ্য হিট ছবির প্রযোজক ও মিরপুরের সনি সিনেমা হলের কর্ণধার মোহাম্মদ হোসেন মনে করেন, দেখার মতো সিনেমা না থাকার কারণে হল শেষ হয়ে যাচ্ছে।
তিনি বলেন, ‘আমি আরও ৮ বছর আগে সিনেমা থেকে সরে এসেছি। তখন হাজারের কাছে হল ছিল। এখন ভালো সিনেমাই নেই, তাহলে হল থাকবে কেমন করে?’
এদিকে আসছে ঈদে প্রাথমিকভাবে দশটি সিনেমা মুক্তির কথা শোনা গেলেও শেষ পর্যন্ত গলুই, বিদ্রোহী, শান এবং পাপ-পুণ্যকে মোটামুটি নিশ্চিত ধরে পরিকল্পনা আঁটছেন চলচ্চিত্র ব্যবসায়ীরা। তারা মনে করছেন, সময়ের সাথে সাথে হল সংকটের কারণে হয়তো অন্য সিনেমার প্রযোজকরা ঈদে সিনেমা মুক্তির ঝুঁকি নিতে চাইবেন না।
একই সঙ্গে তারা আশঙ্কা করছেন, হল সংকটের কারণে সিনেমা প্রদর্শনের সুযোগ সৃষ্টি না করলে চলচ্চিত্র শিল্পকে খুব বেশি দিন রক্ষা করা যাবে না। তারা মনে করছেন, প্রেক্ষাগৃহ ছাড়া সিনেমার ব্যবসা সম্ভব নয়। আর ব্যবসা না হলে প্রযোজক সিনেমা নির্মাণ করবেন না, ফলে সিনেমার অভাবে হাতে গোনা বাকি যে প্রেক্ষাগৃহগুলো রয়েছে- সেগুলোও ধীরে ধীরে বন্ধ হওয়ার উপক্রম হবে। এগুলো একটি আরেকটির সাথে সম্পর্কিত।
সিনেমা বাণিজ্যের সাথে জড়িতদের জোর দাবী, দেশীয় সিনেমাকে বাঁচিয়ে রাখতে দেশজুড়ে বন্ধ থাকা হলগুলো পুনরায় চালুর উদ্যোগ, সুস্থ পরিবেশ সৃষ্টি এবং নতুন ও আধুনিক প্রেক্ষাগৃহ নির্মাণের বিকল্প নেই।