তামাকের ভয়াবহ প্রভাবের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত বাংলাদেশও। ২০৪০ সালের মধ্যে তামাকমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার প্রধানমন্ত্রীর স্বপ্ন পূরণ করতে সাম্প্রতিক সময়ে সরকার কর্তৃক তামাকের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান গ্রহণের মাধ্যমে বাংলাদেশ ধূমপানের ক্ষতিকর প্রভাব রোধে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিয়েছে। তবে লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো, দীর্ঘকালীন প্রাপ্তবয়স্ক ধূমপায়ীরা কোন বিকল্প ছাড়া ধূমপান ত্যাগে মোটেই আগ্রহী নয়।
সাম্প্রতিক বছরগুলোয়, বিশ্বব্যাপি ধূমপান ও এর বিকল্প মাধ্যমগুলোয় উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এসেছে। বাংলাদেশে প্রায় ৬২লাখ প্রাপ্তবয়স্ক ধূমপায়ী রয়েছে, যার বড় একটি অংশ যুবসমাজ। তাই দেশের ভবিষ্যতের সুরক্ষায় বিজ্ঞানসম্মত উদ্ভাবনী পদক্ষেপ এবং ক্ষতি হ্রাসকারী বিকল্পগুলো সহজলভ্য করা অপরিহার্য হয়ে উঠেছে।
এমন সমস্যা নিরসনে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক নিজ দেশে ‘সোয়াপ টু স্টপ’ প্রোগ্রাম চালু করেন। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে তার এই উদ্ভাবনী ধারণাটি অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করতে পারে।
‘সোয়াপ টু স্টপ’ প্রোগ্রামটি সিগারেটের তুলনামূলক নিরাপদ বিকল্প ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ করে। অর্থাৎ, ধূমপান বন্ধ করতে তামাকের পরিবর্তে বিকল্প হিসেবে এমন কিছু দেওয়া, যা তামাকের ব্যবহার কমাবে ও নিকোটিনের চাহিদা নির্মূল করবে। প্রোগ্রামটি ধূমপান বন্ধে বিধিনিষেধ আরোপের পরিবর্তে কৌশলগতভাবে ধূমপায়ীদের তামাকের ক্ষতি সম্পর্কে সচেতন করতে এবং সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে সাহায্য করে। এই প্রোগ্রামটি চালুর মাধ্যমে যুক্তরাজ্যে বিধি নিষেধমূলক ব্যবস্থার বিপরীতে নূন্যতম বিকল্পের সাথে সিগারেট ত্যাগে ধূমপায়ীদের উৎসাহিত করা হচ্ছে। এর থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়, এই প্রোগ্রাম থেকে শিক্ষা নিয়ে যথাযথভাবে প্রয়োগের মাধ্যমে তামাকমুক্ত জাতি গঠনের স্বপ্নের বাস্তবায়ন বাংলাদেশের জন্যও অনেক কঠিন কিছু নয়।
‘সোয়াপ টু স্টপ’ প্রোগ্রামটি ধূমপায়ীদের এমন একটি বিকল্প প্রদানে গুরুত্বারোপ করে, যা তাদের নিকোটিনের চাহিদাও পূরণ করবে, একইসাথে স্বাস্থ্যঝুঁকিও কমাবে। প্রযুক্তিগতভাবে তুলনামূলক নিরাপদ বিকল্প গ্রহণে উৎসাহিত করার মাধ্যমে বাংলাদেশেও ধূমপানের ফলে সৃষ্ট ক্ষতি অনেকাংশে প্রতিরোধ করা সম্ভব।
প্রোগ্রামটি বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্য-কৌশলের একটি অংশ। এর আগেও যুক্তরাজ্যে ক্যালোরি লেবেলিং ও স্থূলতাবিরোধী ওষুধে বিধিমালার মতো তথ্যমূলক ব্যবস্থা গৃহীত রয়েছিল। এই পদ্ধতিগুলো বাংলাদেশের জাতীয় স্বাস্থ্য লক্ষ্যসমূহের সাথে সামঞ্জস্য রেখে স্বাস্থ্য সচেতন ব্যক্তিদের সাহায্য করবে।
ঋষি সুনাক-এর মতে, বর্তমান বিশ্বে মূলত বাস্তববাদের আগে আদর্শবাদ প্রাধান্য পায়। প্রায়ই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কিছু কঠোর মানদণ্ড নির্ধারণ করে, যা অনেক ক্ষেত্রেই বাস্তবায়নযোগ্য বলে নাও মনে হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, মদ বা অ্যালকোহলকে ‘নো সেইফ অ্যামাউন্ট’ ঘোষণার ক্ষেত্রে একে প্যারাডক্সিকভাবে নো- অথবা কম-অ্যালকোহলযুক্ত পানীয়কে ‘স্বাভাবিক’ পানীয় হিসেবে বিবেচনা করা হয়। অন্যদিকে, বিকল্প ছাড়াই চিনির ব্যবহার কমানোর জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার যে আহ্বান তা ব্রিটিশ এনএইচএস, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন এবং জার্মানির ফেডারেল ইনস্টিটিউট ফর রিস্ক অ্যাসেসমেন্টের মতো প্রতিষ্ঠান কর্তৃক প্রদত্ত পরামর্শের বিরোধিতা করে।
তাই ঋষি সুনাক-এর বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে, চিনিযুক্ত খাদ্য এবং মদ ও তামাকমুক্ত সুস্থ জীবনযাপন করাই আদর্শ জীবনধারা হতে পারে, তবে বাস্তবে এমনটি হতে হলে বিশ্বের শতকোটি মানুষের এমন জীবনধারা বেছে নিতে হবে, যার সম্ভাবনা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ থেকে যায়। তাই দুঃখজনক হলেও বাস্তবে সহজলভ্য ও তুলনামূলক কম ক্ষতিকারক বিকল্পগুলো ছাড়া অনেকেই চিনি, মদ ও তামাক গ্রহণের অভ্যাস চালিয়ে যাবে, যা বর্তমান পরিস্থিতিকে আরও খারাপের দিকে নিয়ে যেতে ভূমিকা রাখবে।
তামাকমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার চেষ্টায় দেশের নাগরিকদের স্বাস্থ্যসম্মত জীবনধারা গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করার ক্ষেত্রে আমরা যে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছি তা স্বীকার করে নিতেই হবে। কার্যকর ও তুলনামূলক কম ক্ষতিকারক বিকল্পগুলো ছাড়া ধূমপান বা অন্যান্য অস্বাস্থ্যকর অভ্যাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নানা চড়াই-উতরাই পেরোতেই হবে।
সিগারেটের বিকল্পের পক্ষে ইতোমধ্যেই বিশ্বব্যাপি ঐক্যমত গড়ে উঠছে। বিশ্বব্যাপি জনস্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠান এবং বিশেষজ্ঞদের নিকট ক্রমশই এই বিকল্পগুলো তামাকজনিত রোগ ও মৃত্যুহার কমানোর গুরুত্বপূর্ণ কৌশল হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। নিঃসন্দেহে বাংলাদেশও এমন কোন উদ্যোগ গ্রহণের মাধ্যমে লাভবান হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, সুইডেনে তামাকের বিকল্প হিসেবে ওরাল টোব্যাকো পণ্য ‘স্নাস’ ব্যাপকভাবে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। বর্তমানে ইউরোপিয়ান দেশগুলোর মধ্যে সুইডেনে ধূমপায়ীর সংখ্যা সর্বনিম্ন, মাত্র ৫%। তামাকমুক্ত বাংলাদেশ গঠনে আমরা এমন সাফল্যের গল্পগুলো থেকে শিক্ষা ও অনুপ্রেরণা নিতে পারি।
আদর্শবাদী বিশ্বে কেউ কখনো ধূমপান শুরু করবে না, তবে বাস্তবতা ভিন্ন এবং প্রেক্ষাপট অনুযায়ী সেরা বিকল্প বা সমাধানের বিপক্ষে থাকা উচিৎ হবে না। ধূমপায়ী, বা ধূমপান ত্যাগে আগ্রহীদের জন্য ভ্যাপিং, স্নাস এবং অন্যান্য ধোঁয়া-মুক্ত বিকল্পগুলো সহজলভ্য করার মাধ্যমে সমস্যার সমাধানে পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে।
বাংলাদেশ তামাকমুক্ত জাতি গঠনের স্বপ্ন পূরণের সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে। যুক্তরাজ্যের ‘সোয়াপ টু স্টপ’ প্রোগ্রাম এবং অন্যান্য বৈশ্বিক সাফল্যের গল্প থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে আমরা জাতির জন্য একটি স্বাস্থ্যকর ভবিষ্যত গঠনের পরিকল্পনা সাজাতে পারি।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)