চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

এমবাপে-জিরুদের ফ্রান্সের সামনে ‘দুর্ভেদ্য’ বোনোর মরক্কো

ইয়াসিন বোনো, মরক্কোর গোলপোস্টের অতন্দ্র-প্রহরীকে ‘অ্যাটলাসের পর্বত’ উপমা দিলে ভুল হবে না। গোলরক্ষকরা সাধারণত নায়ক বনে যাওয়ার সুযোগ খুব একটা পান না, এমন কথাকে স্রেফ উড়িয়ে দিয়ে চলেছেন বোনো। মরক্কোর জয় তো আছেই, বিশ্বকাপে এপর্যন্ত কোনো প্রতিপক্ষকে দেননি গোল করতে। দুর্ভেদ্য বোনোর সামনে এবার ফ্রান্স। এমবাপে-জিরুদ-গ্রিজম্যানকে আটকে দিয়ে আরেকটি ইতিহাস গড়ার সামনে বোনো ও মরক্কো। পারবেন বোনো?

জিজ্ঞাসাটি আপাতত সময়ের হাতে তোলা। আল বাইত স্টেডিয়ামে রাত একটায় কেউ যে কাউকে ছাড় দেবে না, সেটা বেশ বলা যাচ্ছে। এমন প্রশ্নও উঠছে— কে জিতবে, বোনো নাকি এমবাপে? মরক্কো ইতিহাস গড়বে নাকি টানা দুবার ফাইনালে ওঠার কীর্তি গড়বে ফ্রান্স?

ঝামেলাটা হল, প্রশ্নগুলো ঘিরে পূর্বানুমান-ভবিষ্যদ্বাণী অনেক হতে পারে, বিশ্লেষণ চলতে পারে। কিন্তু সরাসরি প্রশ্নটার উত্তর দেয়ার সাধ্য কারও নেই। তার চেয়ে বরং সম্পূরক প্রশ্নটা নিয়েই আলোচনা চলতে পারে, সেটিও চায়ের টেবিলে কম ঝড় তুলছে না, কারা যাচ্ছে ফাইনালে? ফরাসিদের পক্ষে বাজি ধরার লোকের ঘাটতি না থাকলেও কোনো বাজিকরই মরক্কোকে ছেড়ে কথা বলছে না।

টাইব্রেকারে স্প্যানিশদের দুটি শট আটকে নায়ক হওয়ার পর স্পেন কোচ লুইস এনরিকে বলেছিলেন, আমার সুযোগ থাকলে মরক্কোর গোলরক্ষককে পরিবর্তন করতাম। স্পেনের কোচের কথায়ই অনেকটা প্রমাণ হয় কি করেছিলেন বোনো! ৩০ বর্ষী তারকা এবারের বিশ্বকাপে মরক্কোর হয়ে যা করে চলেছেন, সেটি দিদিয়ের দেশমও দেখেছেন। সেভাবেই পরিকল্পনা আঁটছেন। একটু ভুল হলেই বোনোতে আটকে যেতে হতে পারে বর্তমান চ্যাম্পিয়নদের। খুব শক্তিশালী না হলেও মরক্কানদের আছে দুর্দান্ত ধারাবাহিকতা।

দলটির কোচ ওয়ালিদ রেগ্রাগুইয়ের মতে, এই দলটি বিখ্যাত চলচ্চিত্রের চরিত্র ‘রকি’র মতো। যারা কোনো বাধায় আটকা পড়ে না। ওয়ালিদের ছবিতে যদি রকি চরিত্রে কেউ থাকত, তাহলে তিনি নিশ্চিতভাবে বোনোই হতেন।

মরক্কো আসরজুড়েই দেখিয়ে চলেছে দাপট। বিদায় করে দিয়েছে বেলজিয়াম, স্পেন ও পর্তুগালের মতো ফেভারিটদের। দুর্দান্ত ফুটবল খেলা দেশটি গ্রুপপর্বে ক্রোয়েশিয়ার সঙ্গে পয়েন্ট ভাগাভাগির পর হারিয়েছে কানাডা ও বেলজিয়ামকে। শেষ ষোলোতে স্পেনকে টাইব্রেকারে থামিয়ে দিয়েছে ইয়াসিন বোনোর দল। শেষ আটে কাঁদিয়েছে ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর পর্তুগালকে। এবার সামনে এমবাপে-জিরুদদের উড়ন্ত ফ্রান্স।

রাশিয়া বিশ্বকাপে শিরোপা উঁচিয়ে ধরা এমবাপে চলতি আসরেও আছেন দুর্দান্ত ছন্দে। গত আসরে ৪ গোল করা স্ট্রাইকার এবার পেয়ে গেছেন ৫ বার জালের দেখা। অন্য ফরাসি স্ট্রাইকার অলিভিয়ের জিরুদও উড়ন্ত ফর্মে। পেয়ে গেছেন চার গোল, সেমিফাইনালে আরেকটি গোল পেলে ফ্রান্স আরও দারুণ একটি রেকর্ড গড়বে। ভাগ বসাবেন ২০০২ সালের ব্রাজিলের রোনাল্ড ও রিভালদোর রেকর্ডে। এক বিশ্বকাপে একই দলের দুই বা তার বেশি তারকার ৫ বা ততোধিক গোল আর কোনো বিশ্বকাপে দেখেনি বিশ্ব।

বিশ্বকাপে এপর্যন্ত অপরাজিত থাকা মরক্কো আফ্রিকার দেশ হিসেবে গড়ছে ভুরিভুরি রেকর্ড। এপর্যন্ত কোনো প্রতিপক্ষের কাছ থেকে একটি গোলও খায়নি, তাদের জালে গ্রুপপর্বে একবার মাত্র বল জড়িয়েছিল— সেটিও নিজেদের ডিফেন্ডারের পায়ে লেগে। আফ্রিকার ইতিহাসে প্রথম দেশ হিসেবে তারা এসেছে সেমির মঞ্চে। ফ্রান্সকে হারিয়ে ফাইনালে উঠতে পারলে আফ্রিকান দেশ হিসেবে আরেকটি প্রথম গড়বে।

ফ্রান্স-মরক্কো ১১ বার মুখোমুখি হয়েছে। অফিসিয়ালি পরিসংখ্যানে সংখ্যাটি চার ম্যাচের, বাকিগুলো আনঅফিসিয়াল। সাক্ষাতে এগিয়ে ফরাসিরা, চারটির দুটিতে জয় তুলেছে দুবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়নরা, বাকি দুটি হয়েছে ড্র। সবশেষ ২০০৭ সালে দেখায় ২-২ গোলের হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হয়েছিল। বিশ্বকাপের বড় মঞ্চে এবারই প্রথম একে-অন্যের বিপক্ষে লড়বে হাকিমি-এমবাপেদের দেশ।

হিসেবে আসা ছাড়াও, আরও ৭ বার দেখা হয়েছে ফ্রান্স-মরক্কোর। সত্তর, আশি ও নব্বইরে দশকের সেই খেলাগুলো আনঅফিসিয়ালি খেলেছিল দুদল। মজার বিষয় হচ্ছে প্রথম দেখাতেই ১৯৬৩ সালে জয় তুলে নিয়েছিল মরক্কো।

শক্তি-সামর্থ্য কিংবা ইতিহাস, সবদিক থেকে এগিয়ে ফ্রান্স। তবুও কাতারের পারফর্ম বিবেচনায় মরক্কোকে সমীহ করতে বাধ্য হচ্ছেন দিদিয়ের দেশমের শিষ্যরা। ১৯৭০ সালে বিশ্বকাপ অভিষেকের পর ১৯৮৬ সালে আফ্রিকার প্রথম দেশ হয়ে গ্রুপপর্ব পার করেছিল মরক্কো। এবার ছাড়িয়ে গেছে আগের সব সাফল্য।

১৯৩০ সালে উদ্বোধনী আসরে খেলা ১৩ দলের একটি ফ্রান্স। এ নিয়ে বিশ্বসেরার মঞ্চে ১৬ বার খেলছে দুবার শিরোপা জেতা দলটি। ১৯৯৮ সালে ব্রাজিলের পর প্রথম শিরোপাধারী দল হিসেবে সেমিফাইনালে খেলতে যাচ্ছে তারা। আরও একটি রেকর্ডের সামনে হুগো লরিসের দল, ২০০২ সালে ব্রাজিলের পর প্রথম দল হিসেবে টানা দুই আসরে ফাইনালে খেলার হাতছানিও তাদের সামনে। রয়েছে টানা দুবার বিশ্বকাপ জেতা দল ইতালি (১৯৩৪ ও ১৯৩৮) ও ব্রাজিলের (১৯৫৮ ও ১৯৬২) রেকর্ড ছোঁয়ার সুযোগ।

সপ্তমবারের মতো সেমির মঞ্চে এসেছে ফ্রান্স। আগের ছয়বারের প্রথম তিনবার (১৯৫৮, ১৯৮২ ১৯৮৬) শিরোপার মঞ্চে উঠতে ব্যর্থ হলেও পরের তিনবার ভুল করেনি তারা। ১৯৯৮, ২০০৬ সালের পর ২০১৮ সালেও ফাইনাল নিশ্চিত করেছিল ফরাসিরা। কাতার বিশ্বকাপের গ্রুপপর্বে শেষ ম্যাচটি হেরে গেলেও বর্তমান চ্যাম্পিয়নরা আছে দোর্দণ্ড দাপুটে। অন্যদিকে, শেষ ৬টি ম্যাচের তিনটিতে জয় ও বাকি তিনটিতে ড্র করে যোগ্য দল হিসেবে শেষ চারে এসেছেন হাকিমি-জিয়েচরা।

দিদিয়ের দেশমের ফ্রেঞ্চ শিষ্যদের ফেভারিট ‘না’ ভাবার কোনো সুযোগই দেননি এমবাপে-জিরুদরা। চোট জর্জরিত দলটি গ্রুপপর্বে দাপুটে খেলে নিশ্চিত করে শেষ ষোলো। লেভান্ডোভস্কির পোল্যান্ডকে বড় ব্যবধানে হারিয়ে পড়ে আরেক ফেভারিট ইংল্যান্ডের সামনে। তাতে হাড্ডাহাড্ডি লড়ে শেষ চারে জায়গা পাকা করেছে। টানা দ্বিতীয়বার ফাইনালে ওঠার পথে তাদের বাধা এখন মরক্কো।